অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর সমঝোতার প্রত্যাশা
করোনা মহামারি সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন বেরোচ্ছে তখন আমরা হাঁটছি কোন পথে? সেপ্টেম্বর মাসের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে এক কঠিন চিত্র ফুটে উঠেছে। গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে নিম্ন রপ্তানি। এ দুইয়ে মিলে সামনের দিনগুলোয় আমরা যে একটি সংকটময় অর্থনীতির দিকে হাঁটছি, তা যেকোন সাধারণ মানুষের পক্ষেও বোঝা সম্ভব। দেশের মূল রাজনৈতিক শক্তিগুলো কিন্তু ব্যস্ত- আগামীতে কে ক্ষমতায় আসবে অথবা ক্ষমতা ধরে রাখবে- এই দুই নিয়ে।
দীর্ঘকাল পরে আইএমএফ এর কাছ থেকে আমাদের ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে বাজেট ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য। কিন্তু, সামগ্রিক নির্বাচন কেন্দ্রিক যে রাজনৈতিক বিভাজন, তাতে সমঝোতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতনই নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখছেন দেশের মানুষ। টেলিভিশনের টকশো বাড়ছে মার্কিন ভিসা স্যাংশন নিয়ে। বিদায়ী প্রধান বিচারপতিও এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন।
আগামী দিনগুলোয় কিভাবে অর্থনীতি সামাল দেওয়া হবে তার কোন লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে না । বৈদেশিক প্রবাসী আয় বাড়াতে যে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে- তা প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে কোনো সহায়তা করেছে কিনা সে বিষয়ে কখনো কোন তথ্য আমরা পাইনি।
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন বা আকু গঠিত হয়েছিল ১৯৭৪ সালে; এর মাধ্যমে ইরান এবং দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ নিজেদের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক সমঝোতা গড়ে তুলেছিল যে – প্রতি দুই মাস অন্তর দুই পক্ষের আমদানি রপ্তানি আয়-ব্যয়ের চূড়ান্ত হিসাব করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তাদের দায়দেনা পরিশোধ করবে। এ ব্যবস্থায় কিছুটা স্বস্তি ছিল ছোট ছোট আমদানি-নির্ভর অর্থনীতিগুলোর। বিশেষ করে বাংলাদেশের। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে আকুর মাধ্যমে বাণিজ্যিক লেনদেন বন্ধ হওয়ার যে গুজব চাউর হয়েছে, তা সত্যি হলে বাংলাদেশের সংকট আরও গভীরতর হবে। ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রথম এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বা যুক্তরাষ্ট্র কেউই এটি নিশ্চিত করেনি।
এদিকে দেশের খোলা মুদ্রাবাজারের সাথে সরকার নির্ধারিত মার্কিন ডলারের দরে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। এই ব্যবধান মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে ডলার সঞ্চয় করতে। প্রবাসী আয়ের নিম্নমুখী প্রবাহও তার অন্যতম কারণ সম্ভবত। প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের আয়ের সিংহভাগ হয়তো প্রবাসেই সঞ্চয় করছে, যেন আগামীতে ডলারের দর বাড়লে তখন পাঠিয়ে বিনিময় মানে টাকা আরো বেশি পাবেন– এই আশায়।
এরকম কিছু উড়ো কথা শোনা যাচ্ছে নির্বাচনের পরে ডলারের সাথে বিনিময় হারে টাকার বড় মূল্যপতন ঘটবে। প্রবাসীরা এতে কান দিচ্ছেন কিনা কে জানে!
ক্ষমতা এমন একটি বিষয়, যা অর্জনের জন্য জনগণের চূড়ান্ত দুর্দশাও রাজনৈতিক চিন্তার পরিবর্তন ঘটায় না অভাগা এ দেশে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পরবর্তী ঘটনা মনে পড়ে, সাধারণ মানুষ কতটা কষ্ট ভোগ করেছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির ধকলের মধ্যেও আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন আরও যেন তীব্র। ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতাও নতুন সংকট। আইনের ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষ বোঝে না। আমাদের সাধারণ মানুষের বোধগম্য বিষয়গুলো নিয়ে তাই আলোচনা হওয়া দরকার।
২০০৭-০৮ সনের গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার সময় দেশের রাজনীতিবিদদের নামে হাজার হাজার মামলা দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এমন বহু মামলা পরবর্তীকালে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এসব বিষয় দেশের সাধারণ মানুষও জানে। আইনি ব্যাখ্যার চেয়ে এ সময়ে জরুরি সামাজিক সমঝোতা। আমাদের দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির কাছে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপতি যেকোন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেও ক্ষমা করতে পারেন এবং ফাঁসির আসামীকেও ক্ষমা করার ইতিহাস আছে আমাদের দেশে।