বিচার বিভাগ কোন দিকে হাঁটছে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে এক চলচ্চিত্র নায়ক সোহেল রানার আবির্ভাব ঘটেছিল। এরপরে নানান সময়ে এই নামটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা গেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। চলচ্চিত্রের নায়ক হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এই সোহেল রানা নাম। তবে বিচার বিভাগের যে সোহেল রানার আগমন ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে সেই নায়ক সোহেল রানার থেকেও ক্ষমতাশালী।
কুমিল্লার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোন শক্তি বলে হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে মামলার চার্জ গঠন করেছিলেন। হাইকোর্টের প্রথম নির্দেশ ছিল চার মাসের জন্য স্থগিত করার; তারপরের নির্দেশ ছিল উচ্চ আদালতের আবেদনটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত মামলাটি স্থগিত থাকবে। সেই আদেশকে অমান্য করে অভিযুক্ত দম্পতির একজনের অনুপস্থিতিতে তাকে পলাতক ঘোষণা করে মামলার চার্জ গঠনের নির্দেশ দেন এই সোহেল রানা; যে ঘটনাটি সকলকেই চিন্তিত করে তুলেছে।
বিচার বিভাগ কোন দিকে হাঁটছে? এর আগেও হাইকোর্টের নির্দেশকে অমান্য করতে দেখা গেছে এবং আদালতে উপস্থিত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে ক্ষমা লাভ করেছেন ওই সমস্ত ব্যক্তিরা। অবশ্য মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত সোহেল রানার ক্ষেত্রে এবার একটু ব্যতিক্রম ঘটেছে। তিনি স্বশরীরে এসে ক্ষমাপ্রার্থনা করার পরেও তাকে ক্ষমা প্রদান করা হয়নি।
কিন্তু তার থেকে অদ্ভুত যে ঘটনা ঘটেছে তা হলো, হাইকোর্টের তিন ঘণ্টার মধ্যে তাকে জামিন মঞ্জুর করা। সাজা ঘোষণার সময়েই তাকে আপিল করার সুযোগ দিয়ে রায়ের কার্যকারিতা ৩০ দিনের জন্য স্থগিত করা যেত। কিন্তু তা না করে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে সাজা দিয়ে আবার তিন ঘণ্টার মধ্যে জামিন মঞ্জুর করা এক অভিনবত্ব বটে। উচ্চ আদালতের ক্ষমা না দেওয়াটা যথার্থ কিনা সে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। এই ক্ষমা গ্রহণ না করার ফলে একটি উদাহরণ সৃষ্টি হবে। কারণ একজন বিচারিক আদালতের যুগ্ম জেলা জজ সকল নিয়ম-কানুন জানার পরেও কোন বিবেচনায় উচ্চ আদালতের নির্দেশকে অমান্য করলেন তা এখন গভীর আগ্রহের বিষয়ে।
অতীতে হাইকোর্ট বিভাগের অনেক আদেশ নিম্ন বিচারিক আদালত এবং প্রশাসনের কোন কোন ব্যক্তিকে অগ্রাহ্য করতে দেখা গেছে; বিষয়টি উচ্চ আদালতের নজরে আসার পর তাদের অনেকেই স্বশরীরে হাজির হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। অতীতে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ক্ষমা করে দেওয়ার উদাহরণ আছে। একমাত্র ট্রাফিক পুলিশের সেই স্যালুট করাকে কেন্দ্র করে পুলিশের আইজির চাকরি যাওয়া ছাড়া আর কোন আদেশের কথা জানা নেই। এ সমস্ত ঘটনায় বারংবার ক্ষমা প্রদান করাই বর্তমানের ঘটনার জন্ম দিয়েছে কিনা সেটি একটি প্রশ্ন।
ঘটনাটি ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শাস্তি দেওয়ার পেছনে গণমাধ্যমের কাছে উঠে এসেছে, জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের প্রতিবাদী ভূমিকা। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানা যায়, মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে তারা আলোচনা করেছেন এবং মাননীয় মন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন বিষয়টি নিয়ে তিনি প্রধান বিচারপতির সাথে কথা বলবেন। দুই দফা লিখিত ক্ষমা চেয়েছেন বলেই তাকে ক্ষমা পেতে হবে- এমন ধারণা জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশনের।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ আদালত অবমাননার অভিযোগ আনার ক্ষমতা সংরক্ষণ করেন। জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন বিচারকদের একটি সংগঠন। কখনো কখনো মনে হয় এটি একটি ট্রেড ইউনিয়ন। বেশ কয়েকটি ঘটনায় তাদের ধারণা জন্মে যে, ক্ষমা চাইলেই তো ক্ষমা পাওয়া যায়।
গণমাধ্যমে আরও এসেছে, অভিযুক্ত বিচারকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেওয়া যেতে পারত। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি কখনো সুস্পষ্ট নয়। অমনি তার আদেশ হলে সাধারণ মানুষ বুঝতো না যে এটি বিচারকের ভুল না অপরাধ। মামলাটি নিঃসন্দেহে এর পরে আপিল বিভাগে যাবে এবং আপিল বিভাগ কী করবেন তাও এখন দেখার বিষয়। অতীতের মত যদি আপিল বিভাগ থেকে উনি ক্ষমা পান তাও একটি নিদর্শন হবে।
তবে বলে রাখা দরকার এই ধরনের ক্ষমা সমাজকে ভুল তথ্য দেয়। পরবর্তী সময়ে মানুষকে উৎসাহী করে এই ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত নিতে; তা-ই দেখা গেছে গত কয়েকবারের ঘটনা থেকে। যদিও আমাদের নিম্ন আদালতের সকল বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের সুপ্রিম কোর্টের কাছে এককভাবে ন্যস্ত নয়। তা সত্ত্বেও কেন এই ঘটনা ঘটলো যা সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে? বিশেষ করে উচ্চ আদালতের এ বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।
নানা বিষয়ে একের পর এক বিতর্ক ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের উচ্চ আদালত বিচার বিভাগকে নিয়ে। কয়েকদিন আগেই হাইকোর্টের এক বিচারপতির মন্তব্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সারাদেশের বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা সকলকে ভাবতে হবে। এরপরেই নতুন করে আবার এই ঘটনাটি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হলো।