ইসরায়েলি চিকিৎসকদের সায় রয়েছে গাজার হাসপাতালগুলোয় আক্রমণে!
গাজার হাসপাতালগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহের জ্বালানি নেই, রোগীদের ক্ষত ধোয়ার পানি নেই– চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধের অভাব প্রকট। প্রতিনিয়ত আহতদের আনা হচ্ছে, আর তারমধ্যেই এসব স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। হাসপাতালকে 'সন্ত্রাসী কার্যক্রম' তথা হামাসের কমাণ্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহারের প্রোপাগান্ডাও চালাচ্ছে জায়নবাদি রাষ্ট্র। শুধু রাষ্ট্রই নয়, ইসরায়েলের চিকিৎসকরাও এ ধরনের বর্বরোচিত হামলাকে ন্যায্যতা দিচ্ছেন।
নিচের এই বিবৃতিটাই পড়ে দেখুন;
'পশ্চিমা নৈতিকতার সুযোগ নিতে গাজার অধিবাসীরা তাদের হাসপাতালগুলোকে সন্ত্রাসীদের আখড়ায় পরিণত করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে। এভাবে তারাই নিজদের ধবংস ডেকে এনেছে। যেকোন স্থানে যেকোন উপায়ে সন্ত্রাসবাদকে নির্মুল করা উচিত। তাই কোনো হাসপাতালের অভ্যন্তরে স্থাপিত সন্ত্রাসী ঘাঁটিকে ধবংস করা ন্যায্য, এমনকী তা আইডিএফ (ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর) অধিকারও।'
প্রথম দেখায় মনে হতেই পারে, এটি কোনো উগ্রবাদী বা রক্তপিপাসু গোষ্ঠীর বিবৃতি, যেখানে সেনাবাহিনীকে হাসপাতালের বোমা ফেলার অনুমোদন ও উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, মূল চমক এই বিবৃতিতে নয়, বরং বিবৃতিতে যারা সই করেছেন– তাদের নিয়ে।
এ বিবৃতিতে সই করেছেন কয়েক ডজন ইসরায়েলি চিকিৎসক, যা ইসরায়েলের বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে।
তার চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হলো– এই বিবৃতি নিয়ে ইসরায়েলিদের মধ্যে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠেনি। বরং এটিকে কেন্দ্র করে– ইসরায়েলের চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিলিস্তিনি হাসপাতালে বোমা ফেলা উচিত নাকি উচিত নয়– এমন আলোচনা চলছে। এই আলোচনাকে 'ন্যায্য'-ই বলছে ইসরায়েলিরা।
আমরা ছয়জন ফিলিস্তিনি চিকিৎসক ইসরায়েলি স্বাস্থ্য খাতে কাজ করছি। কিন্তু, আমাদেরই কিছু সহকর্মীর দেওয়া এমন বিবৃতিতে আমাদের অন্তরাত্মা পর্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে, মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত। কারণ, যে ইসরায়েলি চিকিৎসকদের সাথে হাতহাত মিলিয়ে আমরা রোগীর প্রাণ বাঁচাই, তারাই এখন গাজা উপত্যকার হাসপাতালগুলোতে হামলা করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
আরও পরিতাপের বিষয়, এতে আমরা খুব একটা আশ্চর্যও হইনি। ইসরায়েলি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রশিক্ষিত ও চর্চাকারী হিসেবে আমরা এই সমাজের অন্তর্গত বর্ণবাদ, সমরবাদ ও দ্বিচারিতা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল। অথচ এ খাতের মিথ্যা চিত্র তুলে ধরে দাবি করা হয়– এখানে আরব ও ইহুদিরা পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ বজায় রেখে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে।
আমাদের ইসরায়েলি সহকর্মীরা এমন সময়ে এই বিবৃতিতে তাঁরা দিয়েছেন যখন (গাজায়) চলছে অকল্পনীয় নিধনযজ্ঞ, ইসরায়েলের স্বাস্থ্য খাত কেমন– এটা তারই দৃশ্যমান উদাহরণ। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে কিছু চিকিৎসক প্রকাশ্যে ও নির্লজ্জভাবে সামরিক বাহিনীর পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
তাঁরা নিজ পেশা ও পদবিকে জীবন বাঁচাতে নিয়োজিত না করে, এই সংঘাতে উভয় সমাজের বেসামরিক জনতার যে বিপর্যয়– সেটা তুলে না ধরে এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের কথা না বলে– উল্টো স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় আক্রমণ করাকে বৈধতা দিচ্ছেন। এটা জেনেও যে, এর অর্থ সেখানে থাকা চিকিৎসক, রোগী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা তাতে নিহত হবেন।
যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা– ইসরায়েলি চিকিৎসকদের যা ইচ্ছে তাই বলার ও করার সুযোগ দিচ্ছে, সেটিই আমাদের মতোন ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের কন্ঠরোধ করতে সুপরিচিত দমন কৌশল অবলম্বন করছে। ফলে আমরা এই যুদ্ধ নিয়ে কোন নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় অংশ নিতে পারছি না। আমরা কেবল হামাসের নিন্দা জানাব, আর ইসরায়েলির সামরিক উন্মত্ততাকে সমর্থন দেব– এটাই আমাদের থেকে প্রত্যাশা করা হয়েছে। একই সময় আমাদের ইহুদি সহকর্মীরা ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের হত্যাকাণ্ডে উল্লাস করবে এবং এই মধ্যযুগীয় অবরোধকে সমর্থন দিয়ে যাবেন, আর সেটা আমাদের বসে বসে দেখতে হবে।
এতকিছু যখন ঘটছে, তখন প্রতিদিন আমরা কাজে যাচ্ছি। যাওয়ার পথেই জানতে পারছি পশ্চিম তীর ও গাজায় অসংখ্য মৃত্যু ও ধবংসযজ্ঞের ঘটনা। হাসপাতালে ঢুকেই 'সবকিছু ঠিক আছে' চেহারায় এমন এক অদৃশ্য মুখোশ আমরা পরে ফেলি। আর দৈনিক আনুগত্যের পরীক্ষা দেই, আমাদের সমালোচক সহকর্মীদের বাঁকা চোখের দৃষ্টির সামনে। চা-কফি পানের বিরতির সময় আমাদের ইসরায়েলি সহকর্মীরা যখন 'গাজাকে ধুলার সাথে মিশিয়ে দেওয়া' বা লাখ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করার কথা আলোচনা করেন– আমাদের সেটা নির্বিকার মুখে শুনে যেতে হয়।
আমরা আরও দেখছি, যৌক্তিক কোন কারণ ছাড়াই আমাদের ফিলিস্তিনি সহকর্মীদের জেরা করা হচ্ছে, কখনো চাকরিচ্যুত কখনোবা অপমান করা হচ্ছে। যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আমরা সেবা দেই– সেগুলো যে শৃঙ্খলা শেখানোর শিবিরে পরিণত হয়েছে, তাতো আমরা দেখতেই পারছি। কোন সভ্য দেশ হলে, আমাদের থাকার কথা ছিল রাজপথে। যেখানে আমরা এই যুদ্ধ ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ জানাতে ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের দাবি করতে পারতাম। নিজদের পেশা ও পদবি ব্যবহার কয়রে আমরা স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর অমানবিক হামলার নিন্দা জানাতে পারতাম।
বর্তমান পরিস্থিতি যে নির্দিষ্ট কোন এক পক্ষের হয়ে কথা বলার পক্ষে যথেষ্ট জটিল ও গুরুতর– সে সম্পর্কেও আমরা সম্যক অবহিত। তাই পক্ষ না নিয়েই আমরা বলতে চাই, হারানো প্রতিটি জীবনই মূল্যবান– হোক সেটা ইসরায়েলির বা ফিলিস্তিনির। আর ঠিক একারণেই আমরা এটা জানি, বর্বরতার ইতিহাস গত ৭ অক্টোবরে শুরু হয়নি– আমাদের জনগোষ্ঠী তারও বহু আগে থেকেই জোরপূর্বক উচ্ছেদের শিকার হচ্ছে। নিহত, ক্ষতবিক্ষত ও অপমানিত হচ্ছে দশকের পর দশক ধরে। আর সেই অপরাধের দোসর হয়েছেন আমাদের সহকর্মী ইসরায়েলি চিকিৎসকরা।
ইসরায়েলি বসতি-স্থাপনকারী ও সেনাবাহিনীর দ্বারা আমাদের জনগোষ্ঠী নিহত, নির্যাতিত ও পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছে– এটা জেনেই প্রতিদিন আমরা কাজে আসি। 'এসব ঘটনার নিন্দা জানাবে কিনা' একথাটি কিন্তু আমরা সহকর্মী ইসরায়েলি চিকিৎসকদের জিজ্ঞেস করতে পারি না। অথচ আমাদের প্রতিটি কথায় ৭ অক্টোবরের হামলাকে নিন্দা জানাতে হয়।
ফিলিস্তিনের নিহত হওয়াকে যেখানে স্বাভাবিক ও উদযাপনের বিষয় হিসেবে নেওয়া হয়– তেমনই এক বিষাক্ত, পীড়নমূলক পরিবেশে আমরা বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছি। যেখানে কোন ইসরায়েলির মৃত্যুকে দেখা হচ্ছে ট্রাজেডি হিসেবে, যা নাকি অগ্রহণযোগ্য এবং তার প্রতিশোধ নেওয়াটাই যৌক্তিক।
এই হলো ইসরায়েলি সমাজ, এবং স্বাস্থ্য খাতের প্রতিচ্ছবি। যেখানে ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তার মূল্য সর্বোচ্চ, পক্ষান্তরে ফিলিস্তিনের জাতীয় নিরাপত্তা এক নিষ্ঠুর কৌতুক মাত্র। আমাদের জীবনে, এবং মরণেও ইহুদিবাদের শ্রেষ্ঠত্বকে আরোপ করাটা এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে, বর্তমান সময়ের মতো দুর্ভাগ্যজনক মুহুর্তেই আমাদের ইসরায়েলি সহকর্মীদের কর্মকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে সেটা বোঝাতে হচ্ছে আমাদের। একইসঙ্গে পশ্চিমা দুনিয়া ও তাদের স্বাস্থ্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকৃত চেহারাও আমরা এভাবে তুলে ধরছি।
ফিলিস্তিনিদের অমানবিকীকরণকে স্বাভাবিকভাবে দেখার ঘটনা গাজায় সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের পেছনে পুরো বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতের কলঙ্কিত রক্তাক্ত হাতকে প্রকাশ্যে আনছে। অথচ চিকিৎসা পেশার রয়েছে যুদ্ধ-বিরোধিতা ও মানবিক মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়ানোর সুদীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। রয়েছে যুদ্ধের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করা বর্ণবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বে চিকিৎসা পেশার সুপ্রাচীন এই মূল্যবোধ ও আদর্শ আজ মৃত। আর বিশ্ব বিবেকের দাবিদাররা! এই সংঘাতে তাদের পক্ষপাতিত্ব, মিথ্যাচার আজ কারোরই অজানা নয়। গণতন্ত্রের প্রবক্তারা গণহত্যার অস্ত্র, রসদ যোগাচ্ছে।