মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই!
গাজায় ইসরায়েলের মর্মান্তিক যুদ্ধ ও অপরাধমূলক একের পর এক নীতির দীর্ঘ পরিণতি আত্মঘাতী প্রমাণিত হতে পারে। একইসাথে এটি বর্তমানের যে শক্তিশালী 'ইহুদি রাষ্ট্র', ভবিষ্যতে তার পতন ঘটাতে পারে।
আত্মরক্ষার অজুহাতে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে যে ইচ্ছাকৃত গণহত্যা চালানো হচ্ছে সেটি দেশটির বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতের নিরাপত্তাকে সুরক্ষিত করবে না। বরং এটি আরও বড় পর্যায়ে নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে। তেল আবিবকে আরও বিচ্ছিন্ন করবে এবং সংকটময় অঞ্চলটিতে দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকার সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ন করবে।
প্রকৃতপক্ষে, আমি কখনই ভাবিনি যে, ইসরায়েল নিজেদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার শাসনকে বাদ দিয়ে এবং স্বাভাবিক রাষ্ট্রের যে আচরণ সেটিকে গ্রহণ না করে মধ্যপ্রাচ্যে খুব ভালো একটা ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারবে।
১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে অল্প সময়ের জন্য মনে হয়েছিল, ইসরাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও কিছুটা স্বাভাবিক আচরণে ফিরে আসতে চাইছে। তৎকালীন সময়ে এটি এই অঞ্চলের ফিলিস্তিনি ও আরব রাষ্ট্রগুলিকে একটি শান্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে প্রভাবিত করেছিল। এতে করে মার্কিন মধ্যস্থতায় একটা পারস্পরিক সহাবস্থানের সম্ভাব্য প্রতিশ্রুতির সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু ইসরায়েল নিজেদের ঔপনিবেশিক প্রকৃতির আচরণ থেকে প্রকৃতপক্ষে সরে আসতে পারেনি। এটি তার দখলদারিত্বের অবসান ঘটাতে এবং প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিতে বসবাস করার অসংখ্য সুযোগ নষ্ট করেছে। এক্ষেত্রে ইসরায়েলি কূটনীতিক আব্বা ইবানের কুখ্যাত সেই মন্তব্যের কথা স্মরণ করা যায়, "ইসরাইল সুযোগ হাতছাড়া করার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করেনি।"
দখলদারিত্বের অবসানের পরিবর্তে ইসরায়েল মূলত অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন প্রকল্পে দ্বিগুণ হারে চালিয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিনি ভূমিতে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়েছে। বিশেষ বাইপাস রাস্তা নির্মাণ এবং অন্যান্য পরিকল্পনা প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের বিস্তীর্ণ নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা তৈরি করেছে একটি দ্বিমুখী ব্যবস্থা। একটি উচ্চতরের, যেটি আধিপত্যশীল ইহুদিদের জন্য। আর অন্যটি ফিলিস্তিনিদের জন্য, যাদের নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করছে তেল আবিব।
দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘদিনের জেঁকে বসা বর্ণবাদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। আর অন্যদিকে বিশ্বের আরেক প্রান্ত ফিলিস্তিনে সেটি যেন নতুন করে স্থাপন করেছে ইসরায়েল।
সংঘাত ও ঔপনিবেশিকতার ছায়ায় ইসরায়েল যেন আরও ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছে। জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ইহুদিদের আধিপত্যকেই যেন দেশটি আইনে পরিণত করেছে।
অন্যদিকে সময়ের সাথে সাথে ধর্মান্ধ এবং অতি-ডানপন্থী দলগুলো ইসরায়েলে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ফলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সুবিধাবাদী নেতৃত্বে ক্ষমতার লাগাম দখল করেছে। একইসাথে দেশটির নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলিকে ক্ষুণ্ন করে দুইটি গোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থানের ভিত্তিতে শান্তির সমস্ত সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসরায়েল সরকারের পক্ষ থেকে সমস্ত যৌক্তিক সমঝোতার প্রস্তাবকেই যেন এড়িয়ে চলা হয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের দেশত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টার অংশ হিসেবে অধিকৃত পশ্চিম তীরে অন্যায়ভাবে অবৈধ ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করেছে। এক কথায় বলতে গেলে, ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের পুরোটাই গ্রাস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েল 'বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগার' গাজা উপত্যকায় তাদের অবরোধ আরও কঠোর করেছে। ফলে গত ৭ অক্টোবরের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এটি ইসরায়েলকে মনে করিয়ে দেয় যে, তার ঔপনিবেশিক উদ্যোগটি কোনোভাবেই টেকসই নয়। কেননা ২০ লাখ মানুষকে এভাবে বন্দী করে রাখা যায় না। তাই অবশ্যই সংঘাতের মূল কারণগুলির (দখল, অবরোধ) সমাধান করতে হবে।
বর্তমানে নেতানিয়াহু শাসনের প্রকৃতি ফিলিস্তিনিদের প্রতি বর্ণবাদী অমানবিককরণকে দ্বিগুণ করেছে। একইসাথে গাজায় চলমান গণহত্যা যুদ্ধের পথ যেন আরও প্রশস্ত করছে। প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে একের পর এক ইসরায়েলি নেতা এই ভয়ঙ্কর হামলায় জড়িয়েছেন। যেন অনেকটা এমন দাবি করেছেন যে, গাজায় কোনো নির্দোষ নেই।
যদিও ইসরায়েল অনেকটা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণের মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক আইনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও নিজেদের আধিপত্য সম্প্রসারণে অবিচল। ইসরায়েল গাজার হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ এবং আবাসিক ভবনগুলির বিরুদ্ধেও যেন যুদ্ধ করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা সহযোগীদের অর্থায়ন ও অস্ত্র সরবারাহের মাধ্যমে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক- শিশু, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে। তাদের আচরণ অনেকটা এমন যে, এই বেসামরিক লোকেরাও যেন তাদের শত্রু।
গত ৭ অক্টোবরে হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের নির্বিচারে মানুষ হত্যার বিষয়টি বিশ্বের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। এতে করে পশ্চিমা সাধারণ মানুষের জনমতও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে। এতে করে নিজেদের নৈতিক অবস্থান পরিবর্তন না করলেও বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য পশ্চিমা নেতারা হয়তো কিছুটা হলেও অবস্থান পরিবর্তন করবে। যেমন গাজায় শিশু হত্যা বন্ধের জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ফ্রান্স।
চলমান বিতর্কিত যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইসরায়েলের উচিত হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। এটাই শেষ সুযোগ হতে পারে, যদিও সেটা বর্তমান পর্যন্ত এটা অনেকটা অবাস্তবই শোনাচ্ছে।
গাজায় চলমান যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে ইসরায়েলি বিখ্যাত সাংবাদিক আরি শাভিভ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, ইসরায়েল এমন ধ্বংসাত্মক পথে চলতে থাকলে দেশটি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে। এদিকে গত সপ্তাহে ইসরায়েলের শিন বেত সিক্রেট সার্ভিসের প্রাক্তন প্রধান অ্যামি আয়লোন সতর্ক করে বলেন যে, তেল আবিবের যুদ্ধ ও আঞ্চলিক সম্প্রসারণ 'ইসরায়েলকে শেষে দিকে' নিয়ে যাবে। উভয়েই ইসরায়েলের দখল অব্যাহত রাখলে দেশটির কঠিন ভবিষ্যতের আশঙ্কা করে সতর্ক করে বই লিখেছেন।
গাজা যুদ্ধ যেন শেষ পরিণতির শুরু ডেকে আনতে পারে। তবে সেটা ফিলিস্তিনের জন্য নয়, বরং ইসরায়েলের জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকার রক্তাক্ত আধিপত্যবাদী বর্ণবিদ্বেষী শাসকগোষ্ঠীর যেমন পতন এসেছিল, ঠিক তেমনি শীঘ্রই ইসরায়েলেও পতন হতে পারে।