‘তিশার ভালবাসা’ নিয়ে ভিডিও দেখতে আপত্তি নাই, কিন্তু বই বিক্রিতে আপত্তি কেন?
বইমেলা নিয়ে আজকাল কিছু লিখতে ইচ্ছা হয় না। বইমেলায় যেতেও ইচ্ছা করে না। কারণ, ব্যক্তি আমি সেই টানটাই অনুভব করি না, যা দশবছর আগেও করতাম। বইমেলার পরিসর বাড়লেও মান কমেছে, বইয়ের স্টলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চটপটি, ফুচকা, বিরিয়ানি ও কাবাবের স্টল। বাইরে রয়েছে খেলনাসহ চুড়ি-ফিতার দোকান।
বই নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেন এরকম একজন বললেন, গত কয়েকবছর ধরেই বইমেলায় কেনার মতো বইয়ের সংকট তৈরি হয়েছে। উনি মনে করেন সংকটের অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের মনোজগতে তৈরি হওয়া এক ধরনের দীনতা। আমাদের বই পড়ার হার কমেছে, জানার ইচ্ছা কমেছে। তাই বই কেনার ইচ্ছাও কমেছে। এর বাইরে নিজেরাই নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করেছি। এই বিধিনিষেধ এতোটাই উগ্র যে অন্যের পছন্দের উপর ছড়ি ঘুরাতেও একবার ভাবি না।
অথচ বইমেলার পরিস্থিতি ও এই সমাজ আগে এমনটা ছিল না। আগের সমাজ ছিল উদার ও অংশগ্রহণমূলক। সবাই সবার মতামত দিতে পারতেন, গলা খুলে কথা বলতে পারতেন। আগে বইমেলায় আহমদ শরীফের বই বিক্রি হতো, হুমায়ুন আজাদ স্যার খেয়াল খুশি মতো কথা বলতেন, লেখকে-লেখকে তর্ক-বিতর্ক চলত। মেলা চত্বরে বসত মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার মানুষদের আলোচনা সভা। ক্রমশ সেই আয়োজন বিবর্ণ হয়ে গেছে। সেই মাপের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, আঁকিয়ে, শিক্ষকদের অনেকেই মারা গেছেন। যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই অনুপস্থিত থাকছেন। এর মধ্যে কুপিয়ে মারা ও অন্য মত গ্রহণ না করার প্রবণতা বইমেলার সার্বজনীন রূপকে কলুষিত করেছে।
মেলা চত্বরে না গেলেও সবসময় লক্ষ্য করি কী কী নতুন বই আসছে, পরিচিতদের মধ্যে কাদের নতুন বই বের হচ্ছে? বিভিন্ন বইয়ের রিভিউ দেখছি, ছবি দেখছি, দলেবলে ঘুরে বেড়ানোর গল্প জানতে পারছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাড়াও পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন দেখতে পারছি। কোনো বই কেনার প্রয়োজন বোধ করলে কাউকে দিয়ে কিনিয়ে নিয়ে আসি। এর মানে বইমেলার সাথে যোগাযোগটা আছেই।
হঠাৎ করে আজ বইমেলা নিয়ে লিখতে বাধ্য হলাম কেন? বাধ্য হলাম অসম্ভব বিরক্তি থেকে। যে বইমেলার সাথে আমাদের ইতিহাস, আবেগ, সৃজনশীলতা ও বইয়ের ব্যবসা জড়িত, সেই 'অমর একুশে বইমেলা ২০২৪' নিয়ে যখন ফাইজলামি ও অসভ্যতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে, তখন আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। এই মেলাতে প্রতিদিন শিশু-কিশোরসহ অসংখ্য মানুষ ভিড় করেন। অনেক প্রবীণ-নবীন লেখকরাও আসেন। এরা আসেন বইমেলা থেকে বই কিনতে, পরিচিত মানুষের সাথে দেখা করতে, ফাঁকা জায়গায় বসে গল্প করতে। তাই সুন্দর ও শান্তিময় একটি পরিবেশ বইমেলার জন্য অবশ্য কাম্য।
সেই বইমেলার নবম দিনে 'তিশার ভালোবাসা' বইয়ের লেখক মুশতাক আহমেদ ও তার স্ত্রী তিশাকে নিয়ে যা ঘটেছে, তা সত্যিই লজ্জাজনক ও অসহ্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মিজান পাবলিশার্সের সামনে উপচে পড়া ভিড় ছিল দর্শনার্থীদের, তারা সেখানে মুখে হাসি নিয়ে উপভোগ করছিলেন দুই অসম বয়সী মানুষের ভালোবাসার উপাখ্যান। 'তিশার ভালোবাসা' বইটি হাতে নিয়ে পাঠকদের বই কিনতে উৎসাহিত করছিলেন মুশতাক-তিশা দম্পতি। হঠাৎ একদল দর্শনার্থী তাদের দুয়োধ্বনি দিয়ে তাড়া করেন এবং মেলা প্রাঙ্গণ থেকে তাদের বের করে দেওয়া হয়।
এই ঘটনায় কেউ বিরক্ত হয়েছেন, কেউ সাধুবাদ দিয়েছেন। তিশা-মোশতাক দম্পতির বিপক্ষের মানুষরা বলছেন, এরা সমাজে লজ্জাজনক একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এজন্যই সচেতন মানুষ তাদের তিরস্কার করে তাড়িয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, কিছুদিন আগে রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ একই কলেজের শিক্ষার্থী তিশাকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন। তাদের বিয়ের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। লোকজন উপচে পড়ে সেই ভিডিও ও রিল দেখতে থাকেন। দর্শক-শ্রোতারা এতদিন এগুলো এনজয় করেছেন, ভিউ বাড়িয়েছেন। এতে করে মুশতাক আহমেদ উৎসাহিত হয়ে লিখে ফেলেন 'তিশার ভালোবাসা' বইটি।
এই দম্পতিকে মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেওয়া প্রসঙ্গে প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে মেলা কর্তৃপক্ষ এই বইটিকে মেলায় প্রকাশ করার অনুমতি দিলেন কেন? আর যদি দিয়েই থাকেন তাহলে লেখকের বই বিক্রির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নেই কেন? আমি নিজেও হাসাহাসি করেছি এই বই লেখা নিয়ে। প্রেম, বিয়ে, রিল ও ভাইরাল হতে না হতেই বই বের করে ফেললেন মোশতাক সাহেব। কীভাবে এত সহজে এই কাজটি করলেন? তাহলে বই লেখা কি এতটাই সহজ? কিন্তু তাদের সম্পর্ক নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নাই। তারা পরস্পর ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। এই ঘটনা নিয়ে তারা ইউটিউব কাঁপিয়ে তুলেছেন। আমরা দেখছি, মন্তব্য করেছি, শেয়ার করেছি তাহলে আপত্তির জায়গাটা কোথায়?
মেলায় যেসব বই প্রকাশিত হয়, এর সবই কি মানসম্মত? ঠিকমতো এডিট করা হয়? বাক্য, বানান কি ঠিক থাকে? পরিচিত অনেকের বই নিয়ে আমরা নিজ মহলেও হাসাহাসি করি, ভুল ধরি কিন্তু সামনে কিছু বলি না। বইমেলায় যারা দুয়োধ্বনি দিয়েছেন, তারা তো জানেন বইমেলা অথরিটি এই প্রেম কাহিনি মেলায় রাখার অনুমতি দিয়েছেন। আপত্তি জানাতে হলে তাদের আপত্তি জানাতে হতো কর্তৃপক্ষের কাছে। মেলা থেকে এইভাবে দুয়োবাদ দিয়ে বের করে দেওয়ার এই পদ্ধতিটাই ঠিক হলো না।
মেলায় যেমন বহু লেখকের বই উঠবে, তেমনি বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস ও মতামতের বইও থাকবে মেলায়। একেক পাঠক একেক ধরনের বই পছন্দ করবেন। মোশতাক সাহেব যদি তার প্রেম ভালবাসা নিয়ে বই লেখেন, কেউ সেটা কিনতে চাইলে কিনবেন, না কিনতে চাইলে কিনবেন না। কিন্তু বই মেলা থেকে এই দম্পতিকে তাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা খুব নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। এর আগেও আমরা দেখেছি মতের সাথে মিলছে না বলে লেখক, কবি, ব্লগারকে পিটিয়ে বা ছুরিকাঘাত করে হত্যা করতে। এই পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলে মনে করা যায় না। কাউকে কোন গোষ্ঠীর পছন্দ হলো না বলে তাকে থামিয়ে দিতে হবে কেন?
ভিন্নমত দমনের পরিণতি কখনও ভালো হয় না। লেখক দম্পতির মতের সঙ্গে আমি একমত হতে না পারি, কিন্তু তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার অধিকার আমাকে কে দিয়েছে? যারা তাদেরকে তাড়িয়েছেন, আমার তো মনে হয়, এরাই একদিন সমাজ থেকে সব ভিন্নমতকে বিতাড়িত করতেও পিছপা হবে না।
যে বইমেলার প্রতি আমার বা আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল, কী কারণে তাতে ভাটার সৃষ্টি হলো? এরশাদ আমলে আমরা যখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, তখন একুশের বইমেলা ছিল আমাদের প্রাণের মেলা, শক্তি, প্রেরণা ও তারুণ্যের উৎস। প্রতিদিন নিয়ম করে বইমেলায় যেতাম, গল্প করতাম, অল্পবিস্তর ও প্রয়োজনীয় বই কিনতাম, আলোচনাগুলো শুনতাম এবং চা-বাদাম ইত্যাদি খেতাম। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল বড় বড় জ্ঞানী ও প্রথিতযশা মানুষকে কাছ থেকে দেখা, তাঁদের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করা। সন্তানকে নিয়েও নিয়মিত গেছি, বই কিনে দিয়েছি এবং কবি সাহিত্যিক, চিত্রকর ও রাজনীতিবিদদের চিনিয়েছি। সেই সময় রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকেই বিকেলে বইমেলায় ঢুঁ দিতেন।
আমাদের এই বইমেলার ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এই ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ (বর্তমান মুক্তধারা প্রকাশনী) থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা বই। ১৯৮৪ সালে খুব সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়। বাংলা একাডেমি চত্বরে স্থান সংকুলান না-হওয়ায় ২০১৪ সাল থেকে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্প্রসারণ করা হয়।
এখন সময় বদলে গেছে। বদলেছে আমাদের পরিচিত বইমেলা। অর্থ, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও রাজনীতির কাছে চাপা পড়ে গেছে বইমেলার মান ও উৎকর্ষ। নতুন লেখকদের লেখার মান নিয়ে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক জমে ওঠে। কোন কোন প্রকাশনী নিম্নমানের বই ছাপাচ্ছে, কেন ছাপাচ্ছে এইসব নিয়েও কথা হয়। অভিযোগ উঠেছে যে টাকা দিয়ে বই প্রকাশের কারণে মানহীন বই প্রকাশের সংখ্যা বাড়ছে। পাঠক ও ক্রেতার চেয়ে লেখকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
অনেকে মনে করেন টাকার বিনিময়ে নতুন লেখকের বই প্রকাশ করলেও লেখার মান দেখা দরকার। লেখক কী লিখছেন, এর চাইতেও বড় কথা হচ্ছে বইয়ের বিষয়বস্তু, ছাপা, প্রচ্ছদ, নির্ভুল বানান, নির্ভুল বাক্যগঠন, সম্পাদনা, গবেষণা ইত্যাদির মান কেমন। পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে বইমেলায় বইয়ের মানের ব্যাপারে কোনো কোনো প্রকাশক চরম উদাসীন। শুদ্ধ বানান ও বাক্যগঠনের মতো বিষয়েও রয়েছে অনীহা। যেহেতু অনেক পাঠকও সচেতন নন, তাই দেদারসে বিক্রি হচ্ছে এমন সব বই। তবে এইসব দুর্বলতা দেখার জন্য কেউই নেই। বাংলা একাডেমি বইয়ের বিষয়বস্তু দেখার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করলেও বইয়ের মান দেখা তাদের কাজ নয় বলে জানিয়েছে। তাহলে বইয়ের মানটা দেখার দায়িত্ব কার?
কথা বলছি বইয়ের মেলা নিয়ে, বাণিজ্য মেলা, প্রীতি আয়োজন বা উদ্যোক্তা মেলা নিয়ে নয়। এখানে মানুষ বন্ধু ও পরিবার নিয়ে আসেন বই দেখতে, বই কিনতে। কে কী বই বের করল, কোন সাহিত্যিক, লেখক কী লিখল তা দেখতে, প্রয়োজনীয় গবেষণালব্ধ বই খুঁজতে, সাহিত্যজগতের গতিপ্রকৃতি বুঝতে। সেখানে বই প্রদর্শনের আগেই যাচাই-বাছাই যা করার তা, করতে হবে। যদি তা না করে, তাহলে বুঝতে হবে একাডেমি স্টল বরাদ্দের টাকা দিয়ে শুধু কামাই করতে চাইছে।
আখেরে যে এর ফল শুভ হয় না, এর প্রমাণ দেশে মানুষ বাড়লেও, একাডেমির স্টল ও মেলায় ভিড় বাড়লেও মেলায় বই বিক্রি কমছে। ২০২৩ সালে মেলায় প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ২০২২ সালে প্রায় ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ২০২১ সালে মহামারির কারণে বিক্রি কমে গিয়েছিল। ২০২০ সালে ৮২ কোটি টাকার, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। ২০১৮ সালে ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে মেলায়। ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। সেই ২০১৬ সালে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই চিত্র একটা অশনিসংকেত। মানুষের ভালো বই কেনা কমে গেলে, বাড়বে অন্ধত্ব।
বইমেলার এক স্টলে বই দেখছিলেন এমন এক পাঠিকার কাছে একজন রিপোর্টার জানতে চেয়েছিলেন তিনি কী ধরনের বই তিনি কিনবেন। ওই পাঠিকা বলেন, 'প্রোগ্রামিংয়ের বই কিনতে এসেছি।' রিপোর্টার বললেন, এসব বইতো সারাবছর নীলক্ষেত থেকেই কেনা যায়। বইমেলায় যেহেতু এসেছেন কাজেই অন্য কোনো বই দেখবেন বা কিনবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বই তো পড়ি না, শুধু শুধু কিনব কেন।' এই সহজ স্বীকারোক্তিটি কিন্তু অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট