‘লেট লতিফ’ যারা, কেমন হন তারা?
আমাদের পরিবারে, বন্ধু, সহকর্মীদের মধ্যে অনেকেই আছেন কিছুটা ঢিলেঢালা ধরনের। যে কাজ দশ মিনিটের মধ্যে করা দরকার, তা করতে বিশ মিনিট কাটিয়ে দেন। দিচ্ছি, দেব, করে করে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে কাজ জমা দেন। কোথাও বের হবার সময় অনাবশ্যক দেরি করেন। কোথাও যাওয়ার জন্য সবাই যখন গেটে অপেক্ষা করছেন, গড়িমসি করা সেই ব্যক্তি হয়তো তখন তার কাপড় ইস্ত্রি করছেন বা টয়লেটে গিয়েছেন। এ ধরনের মানুষকে আমরা মজা করে 'লেট লতিফ' বলি। কাজকর্ম না থাকলে বা বাইরে বের হওয়ার তাড়া না থাকলে লেট লতিফদের নিয়ে সমস্যা নাই। কিন্তু কাজের বা যাত্রার তাড়া থাকলে এই শ্রেণির মানুষ নিয়ে ব্যাপক হাঙ্গামা হয়।
লেট লতিফ ধরনের মানুষ সবখানে দেখতে পাওয়া যায়, এদের কারো কারো প্রতি একধরনের প্রশ্রয়ও থাকে আমাদের। যেমন, আমাদের একজন সহকর্মী ছিলেন যিনি প্রতিদিন দেরিতে অফিসে আসতেন, দেরিতে মিটিংয়ে ঢুকতেন, অফিস থেকেও দেরিতে বের হতেন। তাকে একটি দায়িত্ব দেয়ার পর বারবার দেখতে হতো কাজ চালু হলো কি না। অথচ আমাদের সেই ছেলেটিই অফিসের সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ ও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কর্মী। কাজ ও ক্রিয়েটিভিটিতে সেরা বলেই আরিফ হোসেন খানের এই গড়িমসিকে আমরা এবং অফিস প্রশ্রয় দিত। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে এই গুণ দেখা যায় না।
লেট লতিফ টাইপের মানুষ নিয়ে গ্রুপে কাজ করা কঠিন। গ্রুপে একজনের দেরি হওয়া মানে, পুরো টিমের দেরি হওয়া। চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ও পরীক্ষার হলের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে দেরিতে পৌঁছানোর মতো মানুষেরও অভাব নেই সমাজে। ইদানীংকালের শিশু-কিশোর ও তরুণদের মধ্যে দেরি করার এই আয়েশি ভাবটা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এরা অনেকেই রাত জাগে আর দিনে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমায়। এই কারণেই কাজের জন্য কোথাও পৌঁছাতে অনেকেরই দেরি হয়ে যায়।
আবার এমন অনেকেই আছেন যারা রয়ে-সয়ে কাজ করতে গিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে কাজে হাত দেন বা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন, তখন তাদের মধ্যে হন্তদন্ত ভাব বেড়ে যায় এবং টেনশন, মেজাজ সব চড়া হয়ে ওঠে। যারা ইচ্ছা করে এভাবে কাজ দেরিতে শুরু করেন বা শেষ করেন, তারা প্রায়শই নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়েন। আর এ ব্যাপারে অভ্যস্ততা গড়ে উঠলে তো কথাই নেই। প্রয়োজন ছাড়া ও ইচ্ছা করে দেরি করা হলো এমন একটি বদঅভ্যাস, যার কারণে একজন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কাজে দেরি হওয়ার আশঙ্কা শতকরা একশো ভাগ। মিটিংয়ে যোগ দেয়া, চাকরির প্রতিবেদন বা একাডেমিক অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া এবং কারো সাথে চাপমুক্ত পরিবেশে কথা বলা ও সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার মতো কাজ, সবই বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
কাজে দেরি করাটা সবখানে একটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই নেতিবাচকতার কারণে মানুষের মধ্যে তৈরি হতে পারে বিষণ্নতা, নিম্ন আত্মমর্যাদাবোধ, অপরাধবোধ এবং কম উৎপাদনশীলতা। আমাদের মতো দেশে দেরি করাকে ব্যক্তির নিজস্ব একটি সহজাত প্রবৃত্তি বলে মনে করা হয়। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে এ নিয়ে এন্তার গবেষণা চলছে। যেমন পশ্চিমা বিশ্বে সেইসব শিক্ষার্থীরা নাকি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে দেরি করেন, যারা চাইছেন তাদের ফলাফল আগের চাইতে ভালো হোক। তারা এটাও মনে করেন, তাদের যতটা শেখা উচিত ছিল, তারা তা শিখতে পারেননি। তাই আরো বেশি শেখার জন্য বেশি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কাজটি করেন। তবে অনেক শিক্ষার্থীই ধারাবাহিকভাবে দেরি করাকে তাদের জীবনের একটি বড় সমস্যা বলে মনে করছেন।
সবাই কি অভ্যাসবশত বা ইচ্ছা করে পড়াশোনা শেষ করতে বা কাজ শুরু করতে দেরি করেন? মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন অনেকে চাপ বোধ করলে কাজ দেরিতে শুরু করেন। কেউ কেউ চাপের বা কঠিন কাজগুলো করব করব করে দেরিতে শুরু করেন। অনেকে আবার আয়েশ করে কাজটি করবেন বলে ধীরে ধীরে করেন। সাধারণত কাজ জমা দেয়ার সময় যত কাছে আসতে থাকে, ততই 'লেট লতিফ' টাইপ মানুষগুলোর টেনশন বেড়ে যায়। এইভাবে সময়ক্ষেপণ করতে করতে এবং এই চাপ এড়াতে তারা আরও দেরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারেন। মনোবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এই ধরনের আচরণকে কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত শুরু করার আগে উদ্বেগ কমানোর একটি উপায় বলে মনে করেন।
তাহলে যারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কাজ দেরিতে শুরু করেন তাদের এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? কোনো কাজকেই তুচ্ছ বা কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা ঠিক নয়। কাজ এড়ানোর চেয়ে কাজটা শুরু করে ফেলতে পারাটাই জরুরি। ভেবে নিতে হবে অন্য কেউ যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে এসে এভাবে দেরিতে কাজ শুরু করেন, তাহলে সেই কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে আমার কতটা অসুবিধা হতে পারে।
দেরিতে ঘুম এবং স্মার্টফোন ও টিভি আসক্তি, রাত জেগে আড্ডা, ঘোরাঘুরি সবকিছুরই একটি নেতিবাচক প্রভাব আছে মানুষের ঢিলেঢালা আচরণের উপরে। দিনের শেষে এইগুলো আচরণ মানুষের কাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সাধারণত এই ঢিলেঢালা ও খানিকটা আলসে স্বভাবের মানুষদের লোকে পছন্দ করে না। নানারকম সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় তাদের। সবাই জানি, অলসতা একটি খারাপ অভ্যাস। কিন্তু, হালকাধরনের বা অনিয়মিত অলসতার কিছু ভালো দিকও থাকতে পারে। যেমন: অলস ব্যক্তি দীর্ঘ সময় বিশ্রাম নিতে পারেন, তিনি পর্যাপ্ত ঘুমাতে পারেন। আর পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুমের ফলে মানসিক চাপ কমে, কাজে মনোযোগী হওয়া যায় ও স্মৃতিশক্তি উন্নত হয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে উদ্বেগ, হতাশা, দুর্বলতা বাড়ে। তাই মানুষের জীবনে ঢিলেঢালা আচরণ, আলসেমিও মাঝমেধ্যে দরকার হয়ে পড়ে।
জীবন ও জীবিকার প্রয়োজন এখন এতটাই লাগামছাড়া হয়েছে যে আমরা সবাই এর সাথে তাল রাখতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি। আলসেমি, বিশ্রাম, আনন্দ, মুক্তভাবে ঘোরাঘুরি সবকিছু হারিয়ে যেতে বসেছে। অনেকসময় খুব কেজো লোকেরও ইচ্ছা করে কোন কাজ না করে চুপ করে শুয়ে-বসে থাকতে, গান শুনতে, বাঁশি বাজাতে, গল্প করতে, বই পড়তে, বন্ধুর সাথে ঘুরে বেড়াতে, নদীর ঢেউ গুনতে, সিনেমা দেখতে বা হাতের কাজ এমনি এমনি ফেলে রাখতে। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই বা কাজ শেষের নির্ধারিত সময় নেই, জীবনের প্রয়োজনেই এইসব আরাম-আয়েশ ও আলসেমির দরকার আছে কিন্তু অন্যদিকে জীবনের প্রতিযোগিতাই তা পারমিট করে না।
তবে আলসেমি করতে ও লেট লতিফ হতে ভালো লাগলেও তা কাটিয়ে উঠতে পারাটাই জীবনকে সফল করে। তাই যেকোনো কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর কথা বলেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'সাধারণত আমাদের মাঝে আলসেমি ভাবটা তখন আসে, যখন কোনো কাজের জন্য আমাদের মধ্যে আগ্রহ কম কাজ করে অথবা অনেক কাজ জমিয়ে রাখলেও এমনটা হতে পারে। এর বাইরে কেউ যদি মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত হন, সেক্ষেত্রেও আলসেমি ভাব দেখা দিতে পারে। আবার অনেকে চান, কিন্তু আলসেমি কাটিয়ে উঠতে পারেন না। কারণ, আপনার অবচেতন মন আপনাকে কাজের ব্যাপারে উদ্যমী হতে দিচ্ছে না। আলসেমি কাটাতে প্রথমেই নিজেকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। কাজগুলোর গুরুত্ব ও সময়ের গুরুত্ব সব নিয়েই ভাবতে হবে। এটি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে আপনাকে কাজ করার ক্ষেত্রে মনোযোগী হতে সাহায্য করবে। তবে এই অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে।'
যারা ঠিক অলস নয়, কিন্তু লেট লতিফ, তারা চাইলেই নিজেকে আরো উদ্যোগী করে তুলতে পারেন, অন্যের কাছে আরো গ্রহণীয় হয়ে উঠতে পারেন এবং জীবনটাকে করে তুলতে পারেন অর্থবহ। তাদেরকে লক্ষ করতে হবে আলসেমির পেছনে কারণ কী। প্রতিদিনই কাজ জমা দিতে দেরি হচ্ছে কেন? হাতের কাজ শেষ করতে কী কী সমস্যা হচ্ছে? কাজটি সম্পর্কে কোনো ধরনের ভয় আছে কি না? এ ধরনের প্রশ্নগুলোর উত্তর দ্রুত খুঁজে বের করতে হবে। সমস্যার কারণ খুঁজে বের করতে পারলে সমাধানও খুঁজে বের করা সম্ভব হয়। সমাধানের উপায় খোঁজার জন্য কথা বলা উচিত পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু ও সহকর্মীদের সাথে।
যে কাজটি করতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু করতেই হবে, সেই কাজটি নতুন করে শুরু করতে হবে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, একইভাবে একটি কাজ অনেক দিন ধরে করলে সেই কাজের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে যায়। তখন উচিত কাজের ধরন পাল্টে ফেলা বা কাজের প্রক্রিয়ায় নতুনত্ব আনা। টার্গেট ঠিক করে, কাজ শুরু করার জন্য সময় ভাগ করে নিলে ভালো হবে। ইচ্ছাশক্তির ওপর জোর দিতে হবে। ভেবে ঠিক করতে হবে যে কাজ ফেলে রাখছি, সেই কাজ করলে কতটা ভালো ফল বয়ে আনবে এবং না করলে কতটা খারাপ ফল। সময় ব্যবস্থাপনাও খুব জরুরি একটি বিষয়। আর আমরা যদি ধরেই নেই যে ব্যর্থ হবো, তাহলে কিন্তু কাজ পড়েই থাকবে, শেষ হবে না। আর কাজটা শেষ করতে যতোটা দেরি হয়, ততই মানুষ উদ্বিগ্ন ও অলস হয়ে পড়েন। তাই মনোবিজ্ঞানীরা বলেন চটজলদি কাজ শেষ করার জন্য ব্যর্থতার চিন্তা দূর করতে হবে। চাপ কমিয়ে যতটা সম্ভব সহজ পথে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করতে হবে। দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে বা সকাল সকাল বের হয়ে পড়তে হবে এরকম অবস্থায় বাদ দিতে হবে সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি বা মুভি দেখা, টেলিফোনে কথা বলা।
এরপরেও মানুষ তার মন ও আচরণের ওপর নির্ভরশীল। মানুষ মেশিন বা এআই নয়। আবেগ, ভালবাসা, আনন্দ, রাগ, অভিমান এবং আলসেমি সবই তাকে তাড়িত করে। মানুষ নিজের ওপর জোর খাটানোর চেষ্টা করলেও সবসময় সফল হয় না। তাই পরিকল্পনা করলেও হয়তো তা মেনে চলা হয় না সবসময়। এতে হতাশ হওয়া ও ভেঙে পড়া যাবে না। শুধু লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে, যেন হাতের কাজটা পড়ে না থাকে, সময়ের অপব্যবহার না হয়, নিজের ওপর আস্থা নষ্ট না হয়। 'কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে'—কোনো কোনো সময় জীবনকে মুচকি হাসতে দিতে হয়। কারণ মনোবিদরা এ-ও বলেন, 'আমাদের নিজেদের প্রতিও কিছুটা সহমর্মিতা দেখানো উচিত'।
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক