পুতিনের উত্তর কোরিয়া সফর কী বার্তা দিচ্ছে?
দুই যুগ পর উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গেল বুধবার পিয়ংইয়ংয়ে পৌঁছালে তাকে জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্বাগত জানায় উত্তর কোরিয়া। বিমানবন্দরে পুতিনকে স্বাগত জানান উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং–উন। পুতিনকে গার্ড অব অনারসহ জমকালো লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পিয়ংইয়ংজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যস্ত সময় পার করেন পুতিন। একান্তে বৈঠকের পাশাপাশি প্রতিরক্ষাসহ বেশ কয়েটি চুক্তি সই করেন দুই রাষ্ট্রনেতা। এরই মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনামের উদ্দেশে উত্তর কোরিয়া ছেড়েছেন। সেখানে তিনি দুই দিন থাকবেন। পুতিনকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উন।
২৪ বছর পর প্রেসিডেন্ট পুতিনের উত্তর কোরিয়ায় প্রথম সফর। সবশেষ ২০০০ সালে তিনি যখন এসেছিলেন— তখন কিম জং ইল— বতর্মান নেতা কিম জং উনের বাবা ক্ষমতায় ছিলেন। উত্তর কোরিয়া সফরের জন্য কিমের আমন্ত্রণটি পুতিন গ্রহণ করেন গেল বছরের সেপ্টেম্বরে। বহু জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে সম্পন্ন হলো এ সফর।
উত্তর কোরিয়া সফরে পুতিন কৌশলগত প্রতিরক্ষাসহ বেশকিছু চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনের সঙ্গে তিনি একান্ত বৈঠক ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেন।
এবার পুতিন এমন এক সময়ে উত্তর কোরিয়া সফরে এসেছেন, যখন উভয় দেশই আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দুই দেশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে নানান রকম পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা।
যেসব চুক্তি হলো—
পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া। এই চুক্তির মধ্যে একটি ধারায় কোনো দেশ বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে, অন্য দেশের পাশে থাকার অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন বুধবার এই চুক্তি সই করেন।
দ্য গার্ডিয়ান জানায়, পিয়ংইয়ংয়ে কয়েক ঘণ্টা আলোচনার পর এই চুক্তি চূড়ান্ত হয়। এদিন পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর কিম জং উন এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন। চুক্তিটিকে তিনি 'বিস্তৃত কৌশলগত অংশীদারিত্ব' বলে উল্লেখ করেন— যা উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়ার মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর আশঙ্কা বাড়াবে।
পুতিন বলেন, "আজ সই করা ব্যাপক অংশীদারিত্ব চুক্তিতে, এক পক্ষ আক্রান্ত হলে অন্য পক্ষ তাকে সহায়তা করবে।" তবে সেই সহায়তা কেমন হতে পারে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি। যদিও পুতিন উত্তর কোরিয়ার আত্মরক্ষার অধিকার উল্লেখ করে চুক্তিটিকে 'প্রতিরক্ষামূলক' অভিহিত করেন।
তবে কিম বলেছেন, মস্কোর সঙ্গে পিয়ংইয়ংয়ের যে চুক্তি হয়েছে— তাতে রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা জোরদার হবে। তিনি এই চুক্তিকে 'সম্পূর্ণ শান্তিকামী ও প্রতিরক্ষামূলক' বলে উল্লেখ করেন।
এর আগে, দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকের শুরুতে কিম ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়াকে পূর্ণ সমর্থন এবং রাশিয়ার সমস্ত নীতিতে নিঃশর্ত সমর্থন প্রকাশ করেন।
এ সময় ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সরবরাহ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর অন্য সদস্যদের দেওয়া সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রসঙ্গও টানেন রুশ প্রেসিডেন্ট।
কিম জং-উন বলেন, তার দেশ কিংবা রাশিয়া কোনো ধরনের 'ঘটনা বা যুদ্ধের' মুখে পড়লে কোনো দ্বিধা ছাড়াই এর জবাব দেবে উত্তর কোরিয়া। অবশ্য 'ঘটনা' বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন, তা স্পষ্ট করেননি কিম। দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া চুক্তিকে 'সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও আত্মরক্ষামূলক' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
যে কারণে সফর
পুতিনের এই সফরের ওপর গভীর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া। মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের সামরিক চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে তারা। উল্লেখ্য, সামরিক সহায়তার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ধরনা দিয়েছিল ইউক্রেন। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া তাতে সম্মত হয়নি।
তাই এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়া নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের কথা চিন্তা করবে কি–না।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার দুই নেতার গেল বছরের বৈঠকটি দেখা হয়, দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপনের প্রক্রিয়া হিসেবে। আর এবারের সফরকে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের বন্ধন যে আরও দৃঢ় হয়েছে সেটি বোঝানোর উপলক্ষ।
১. সামরিক সহযোগিতা
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর প্রায় আড়াই বছর পর এসে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে, কারণ দুই দেশই পরস্পরকে নানান সহায়তা করছে।
সম্ভাবনা রয়েছে, বৈঠকটি শুধুমাত্র সামরিক বিষয় চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং কী করে উত্তর কোরিয়া গতানুগতিক সব অস্ত্রও সরবরাহ চালু রাখতে পারে ও কী করে যৌথভাবে অস্ত্র তৈরির প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করা যায়— সেটিও নজরে রাখা হয়েছে। তবে দেশ দুটি সামরিক চুক্তির ব্যাপারে 'ধরি মাছ না ছুই পানি' অবস্থান নিয়েছে কৌশলগত কারণে।
সম্প্রতি ইউক্রেনে পশ্চিমা অস্ত্র প্রবেশ ও রাশিয়ার জন্য সেগুলো হুমকি হয়ে ওঠার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এমনকি, তিনি প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনার কথাও বলেন।
তবে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র বিনিময় বা এ নিয়ে সহযোগিতার বিষয়টি, কোরিয়ান পেনিনসুলা এবং উত্তরপূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো দেশগুলো থেকে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
আর সে কারণেই ধারণা করা যায়, এই বৈঠকে পারমাণবিক ইস্যুতে কোনো আলোচনাই হয়তো সেভাবে প্রকাশ করা হলো না।
২. অর্থনৈতিক সহযোগিতা
কী করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বাড়ানো যায়, সেই বিষয়েও রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যে নিশ্চিতভাবেই আলোচনা হয়েছে। এর মানে হল, রাশিয়ায় আরও শ্রমিক পাঠানোর সংখ্যাটা উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে বাড়তে পারে।
যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো পুর্ননির্মাণের জন্য রাশিয়ারও জনশক্তি দরকার। অর্থনীতি আবারও আগের পথে ফিরিয়ে আনা ও যুদ্ধের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রচুর পরিমাণ কর্মী দরকার রাশিয়ার।
তবে, উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল থেকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞায় বলা আছে, উত্তর কোরিয়ার কোনো শ্রমিক দেশের বাইরে কাজ করতে পারবে না এবং যারা আগে থেকে করছে তাদের ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে ফেরত যেতে হবে।
ফলে নিরাপত্তা কাউন্সিলের স্থায়ী সদস্য দেশ হিসেবে রাশিয়ার জন্য এটি কঠিন হবে আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর কোরিয়ার কাছে শ্রমিক চাওয়া, কারণ এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করবে।
তাই মূলত নজর থাকবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কূটনৈতিক চাপ ও বিরোধীদের নানা চাপের মুখে দুই দেশ কী করে একে অপরের সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা চালিয়ে নিতে পারে, সে দিকে।
৩. সংস্কৃতির বিনিময়
উত্তর কোরিয়ায় পর্যটক পাঠানো শুরু করেছিল রাশিয়া— যা পরবর্তীতে কোভিড-১৯ এর জন্য বাতিল হয়ে যায়। পাশাপাশি এ মাসের শুরু থেকে গত চার বছরের মধ্যে প্রথমবার রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস শুরু হয়েছে।
রুশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে চারশোরও বেশি রুশ পর্যটক উত্তর কোরিয়া ভ্রমণ করেছেন। রাশিয়ার ট্রাভেল এজেন্সি ভস্তোক ইন্ট্রু তাদের ওয়েবসাইটে উত্তর কোরিয়ায় পাঁচ দিন, চার রাতের ট্যুর প্যাকেজ বিক্রি করছে ৭৫০ মার্কিন ডলার করে।
এদিক থেকে উত্তর কোরিয়ায় পর্যটনকে দেখা হয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে, যা অর্থনীতির বাইরেও তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নয়নের হাতিয়ার।
উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সামরিক সহযোগিতা নিয়ে নতুন চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই মস্কোর প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে দক্ষিণ কোরিয়া। এ অবস্থায় 'নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম না করতে' রাশিয়াকে সতর্ক করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা চ্যাং হো-জিন।
এদিকে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সম্পর্ক এতোটাই দৃঢ় হয়েছে যে, ধারণা করা হচ্ছে— এখন আর শুধু 'পারস্পরিক বোঝাপড়া' নয় বরং দুই দেশের মধ্যে 'মিত্রতা' তৈরি হয়েছে— সেই মিত্রতা আবারও নতুন করে নবায়ন করা হলো এবারের বৈঠকে।
এখন আন্তর্জাতিকভাবে যেভাবে ভাঙা-গড়া চলছে, আবার যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৈশ্বিক শক্তিও আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে এসেছে; ফলে এটি রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের নতুন কৌশলের অংশও হতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ভবিষ্যতে নিজেদের জন্য কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দেবে, তা রাশিয়াকে বিবেচনায় নিতে হবে।
সব মিলে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠক থেকে শুধুমাত্র আলোচনা নয়, বরং সত্যিকারের ফলাফল আসবে বলে অনেকেই মনে করছেন।