ছাগল ও রাসেল’স ভাইপারের ঢাকা
বলার দরকার নেই 'মেঘে ঢাকা তারা' একটি চলচ্চিত্র। মূল গল্পটি শক্তিপদ রাজগুরুর। শতাধিক বই লিখেছেন তিনি। সবচেয়ে জনপ্রিয় 'মেঘে ঢাকা তারা'। আর ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় এটি চতুর্থ সিনেমা। ব্যবসা সফলতার দিক থেকে প্রথম।
'মেঘে ঢাকা তারা' শব্দগুচ্ছকে উল্টে দিলে হয় 'তারা ঢাকা মেঘ'। এটা গদ্য নয়। কাব্য। কবিতা এ রকমই। ভাবের জগত। 'দুই বোনের কবিতা'য় জয় গোস্বামী এ 'নিরীক্ষা' করেছেন। তবে কবিতাটি রম্য ধাঁচের। জয় সেখানে লিখেছেন:
"তারা ঢাকা মেঘ, মেঘে ঢাকা তারা
পাশের বাড়িতে উঠে এল তারা।
ঠ্যালা গাড়ি ভরা মালপত্তর
কত অ্যাডভান্স? মাসে কত ভাড়া?
একতলা বাড়ি, কলোনির পাড়া,
বাবা ভোরবেলা ডিউটিতে গেলে
বাড়িতে মায়ের কোমল পাহারা।"
কিন্তু, আমাদের জীবনে রম্য আর কাব্য করার সময় কোথায়!
আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয় ছাগল নিয়ে। বিশেষ করে ছাগলের দাম যখন ১৫ লাখ টাকা। পণ্ডিত মশাইয়ের স্কুল পরিদর্শনে আসা সারমেয়র পা ছিল তিনটি। এই ছাগলের চার চারটে পা-ই ঠিকঠাক। তাহলে ছাগলের এক পায়ের দাম আমাদের কয় মাসের বেতনের সমান? সেটা হিসাব কষতে বসলে কবিতাপাঠের অবসর কোথায়?
তাই আমরা অংক কষতে বসি। বসি ঠিকই, মেলাতে পারি না। এই যেমন আজ সব সাংবাদিক ভিড় করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের তসরিফ রাখার কথা ছিল। দিনভর অপেক্ষার পরও তার দেখা মিলল না।
পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় এটা কোনো কাজ না। গণিতেও না। রবিঠাকুর তাই ছন্দে ছন্দে ছড়া কেটেছেন:
"ভোলানাথ লিখেছিল তিন চারে নব্বই
গণিতের মার্কায় কাটা গেল সর্বই।"
কিংবা ষোড়শ শতকের কবি জ্ঞানদাস যেমনটা লিখে গেছেন:
"সুখের লাগিয়া
এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল |
অমিয়া-সাগরে
সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।"
শুধুই কি সাংবাদিকদের জন্য সকলি গরল ভেল! দুর্নীতি দমনের হর্তা-কর্তারাও সারাদিন অপেক্ষায় ছিলেন। আসলে ত তাদেরই কাজ এটা। তাদের অপেক্ষায় অপেক্ষায় মেঘ করে বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু পাখি নীড়ে ফেরেনি। এভাবে মেঘে তারা ঢাকা পড়েছে। কিংবা মেঘ ঢাকা পড়েছে তারায়। আর তখন দ্বারের পাশে বসে দুদক। যেমনটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন:
"মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,
আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে
থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি
তোমারি আশ্বাসে।"
আশ্বাসে যে কাজ হবে না, সেটা সাংবাদিকরা আগে থেকেই জানতেন। তারপরও উপযাচক হয়ে তারা সেখানে গিয়েছিলেন। উপযাচকই বটে। পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে প্রায় সহস্র শব্দের বাণী দেওয়ার পরও সাংবাদিকরা খবরের লোভ সামলাতে পারেননি।
নিয়ম-নীতি মেনে সাংবাদিকতা করতে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশেনের বিবৃতির পরও সাংবাদিকরা যে শুধু খবরের খোঁজই করছেন এমন না। সাংবাদিক ইউনিয়ন, রিপোর্টার্স ইউনিটি, ব্র্রডকাস্ট জার্নালিস্টস সেন্টার পাল্টা বিবৃতি দেখানোর দুঃসাহসও দেখাচ্ছে। নিশ্চয় এ সাংবাদিকরা অনেক চেতনা থেকে বিচ্যুত। না হলে এত সাহস তারা পায় কীভাবে!
তবু রক্ষা যে এখনো রাজস্ব অ্যাসোসিয়েশন কোনো বিবৃতি দেয়নি। পুত্রের ছাগলকাণ্ডের পর যেভাবে সাংবাদিকরা মতিউর রহমানের ওএসডি হওয়া, সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ হারানো আর দুদকের অনুসন্ধানের খবর প্রকাশ ও প্রচার করছে, তাতে তারাও না নতুন কোনো চেতনার বলে বলীয়ান হয়ে সাংবাদিকতা শিক্ষা দিতে আসে।
সমস্যা হচ্ছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে। সাংবাদিকরা সত্যের উন্মোচন করে। সাংবাদিকরা সবসময় জেগে থাকে। যেমনটা জীবনানন্দ দাশ বলেছেন:
"যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে—
যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো;
জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়।"
সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকরা হচ্ছে সেই নিশ্চয়তা যেখানে মানুষের রূপে রাসেল'স ভাইপাররা ছড়িয়ে পড়তে পারে না। আবার রাসেল'স ভাইপার নিয়ে যত মিথ্যা, সেটাও তুলে ধরে সাংবাদিকতা। সৎ কর্মকর্তাদের সৎ সাংবাদিকতাকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। যে ভয় পায়, তার ভয় পাওয়ার কারণ নিশ্চয় আছে। তবে সাংবাদিকদের মধ্যেও যে রাসেল'স ভাইপার নেই, সেটাও কিন্তু না।
এই যে সাংবাদিকরা নিজেদের সমালোচনা করতে পারে, প্রকাশ্যে বলতে পারে, এটাই সাংবাদিকতার শক্তি। এজন্য সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই। সাংবাদিকের বন্ধু থাকতে নেই। থাকলেই শতেক বাধা। মুখ দেখা বন্ধ হলেও তাই সাংবাদিক বন্ধু হারাতে রাজি। এমনকি সেটা প্রাতিষ্ঠানিক বন্ধুও। তাই আবার জয় গোস্বামীর কবিতা থেকেই ধার করে বলি:
"মুখ দেখা আজ বন্ধ করেছে
প্রাণের বন্ধু কাল ছিল যারা।
দল বেঁধে আর বসছে না কেউ
একা পথ চায় যতেক বেচারা। তারা ঢাকা মেঘ মেঘে ঢাকা তারা।"
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।