রম্য রচনা: রুম প্র্যাকটিসের ক্যাপ্টেন, শেভিং ফোমের অলরাউন্ডার
বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণার কথা বললেই আমাদের মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের কথা। একাডেমিক ডিসকাশন হোক, কিংবা রসালো আলোচনা— বিজ্ঞাপন নিয়ে কথা বললেই তাঁর 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে' নামে কবিতাটির কথা মনে আসে। যদিও চর্বিত-চর্বণ, তবু কবিতাটির কয়েক ছত্র বিড়বিড়িয়ে মনে করার লোভ সামলাতে পারছি না।
তিনি লিখেছিলেন:
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
অনেক অনেক বছর আগে এ কবিতাটি লেখার সময় পত্রিকার পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের এক বড় জায়গা ছিল হোর্ডিং। এখনো সেটা আছে। যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও। তবে খেলাপ্রেমীদের বেশি বিজ্ঞাপন দেখতে হয় টেলিভিশনে বা অন্য ডিজিটাল প্লাটফর্মে সরাসরি খেলা দেখার সময়।
দর্শকদের জন্য তখন যন্ত্রণার আরেক নাম হয়ে দাঁড়ায় বিজ্ঞাপন। কিন্তু, কী করবেন! বিজ্ঞাপন না দেখালে তারা খেলাটি কীভাবে লাইভ সম্প্রচার করবে! সুতরাং, এ যন্ত্রণা আমাদের মেনে নিতেই হবে।
সেটা মেনে নিলেও সমস্যা হয় অন্য জায়গায়। একজন ব্যাটসম্যান যখন গোল্ডেন ডাক মেরে ব্যাট হাতে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন, তখন যদি তাঁরই মডেল হওয়া কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখতে হয়, তখন কীরকম লাগে বলুন!
আর বিজ্ঞাপনের বিষয়টি যখন বাস্তবেও ঘটে যায় তখন! এ পুরো টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপজুড়ে আমরা বিজ্ঞাপনে দেখলাম আমাদের ক্যাপ্টেন রুমের ভেতর ব্যাটিং প্র্যাকটিস করছেন। দেওয়ালে লাগা বলের দাগ মুছে দিচ্ছেন বাড়িওয়ালা।
এখন যদি তার পারফরম্যান্সে কেউ বলেন যে, রুমে প্র্যাকটিস করা রুম প্লেয়ার তুমি রুমেই থাকো, মাঠে যাওয়ার দরকার নেই— তাহলে কি দোষ দেওয়া যাবে?
কিংবা কেউ যদি শেভিং ফোমে শেভ করে চকচকে গালের অলরাউন্ডারকে এসব ছাইপাঁশ নিয়েই থাকতে বলেন— তাকেও কি দোষ দেওয়া যায়!
এসবই হয়ত কথার কথা। আমাদের ব্যাটসম্যানরা যদি অন্তত আজ সফল হতেন, তাহলে কোনো কথাই উঠত না। তখন সেই বিজ্ঞাপনই আমাদের কাছে মনে হতো মধুর।
সেটা কি খুব কঠিন ছিল!
বলা যায়, হেলায় সুযোগ হারিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ভারত এ সুযোগটা করে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে। সুযোগ ছিল অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান তিন দলের সামনেই। পুরোটা অবশ্য নির্ভর করছিল বাংলাদেশের উপর।
আমাদের বোলাররা তাদের কাজটা করেছিলেন। ব্যাটসম্যানরা?
১২ ওভারে ১১৫ করলেই কেল্লা ফতে। সেমিফাইনাল নিশ্চিত হতো বাংলাদেশের। আমাদের ব্যাটাররা সেটা পারলেন না। এমনকি, বৃষ্টির কারণে এক ওভার কমলেও টার্গেট কমেছিল মাত্র ১। সেই ১৯ ওভারেও ১১৪ করতে পারলে অন্তত সুপার এইটে একটি জয় আসতো। তাতে কপাল পুড়তো আফগানদের, সেমিতে যেত অস্ট্রেলিয়া।
কে থাকল, কে ছিটকে পড়ল— সেটা আমাদের ধর্তব্য নয়। আমাদের অন্তত একটা জয় দরকার ছিল। একটা সুপার এইট জয়। সেটাও আমরা পারলাম না।
কিন্তু, টেস্ট যুগের আগে আমাদের এরকম জয় আছে। দুইদিনে হওয়া সেই একটি ঐতিহাসিক ওয়ানডে ম্যাচের কথা মনে আছে নিশ্চয়! বিশেষ করে, মাঝবয়েসী মানুষদের তো অবশ্যই মনে থাকার কথা।
সেটি ছিল আইসিসি ট্রফির ফাইনাল। ওই ফাইনালে উঠেই আমাদের প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়েছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল গৌরবের।
কুয়ালালামপুরে বৃষ্টির কারণে দু'দিনে হয়েছিল সেই ফাইনাল। ১৯৯৭ সালের ১২ এবং ১৩ এপ্রিল। প্রথমে ব্যাট করে কেনিয়া করেছিল ৭ উইকেটে ২৪১ রান। স্টিভ টিকলো একাই করেছিলেন ১৪৭।
বৃষ্টির কারণে খেলা রিজার্ভ ডে-তে গড়ায়। ডি/এল মেথডে বাংলাদেশের সামনে টার্গেট দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। খুবই রাগ হচ্ছিল তখন সকল বাংলাদেশির। ২৫ ওভারে ১৬৬ টার্গেট মানে তো এরকম যে, কেনিয়া ৫০ ওভারে ৩২০+ করেছে।
কিন্তু টাইগাররা সেটি সম্ভব করেছিল। দুই উইকেটে জিতেছিল ওই ম্যাচ।
এখন মনে হতে পারে যে, ২৫ ওভারে ১৬৬ এমন কী! মনে রাখুন, তখনো টি-টুয়েন্টির যুগ আসেনি। তখনো ৫০ ওভারে ২৫০+ রানে তো বটেই, ২০০+ রান করেও ওয়ানডে ম্যাচ জেতা যেত। সেখানে ২৫ ওভারে ১৬৬ অসম্ভব না হলেও প্রায় অসাধ্য তো বটেই। সেটা করেছিলেন নান্নু-আকরাম-বুলবুল-রফিকরা।
এরপর আমরা ক্রিকেটে এলিট শ্রেণিতে প্রমোশন পেয়েছি। শত শত ম্যাচ খেলেছি। শত কোটি টাকার টুর্নামেন্ট খেলছি। কয়েকটা ফ্র্যাঞ্জাইজি লিগ খেলেই কোটিপতি হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ১২ ওভারে ১১৫ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারিনি।
তোমরা তাই মাঠের খেলার চেয়ে বিজ্ঞাপন নিয়েই ব্যস্ত থাকো। সেটাই বোধহয় ভালো। কবিগুরুর কথা মনে করলে বিজ্ঞাপনকে কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারবে না।
আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে:
"রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞাপন দুনিয়ার সঙ্গে কী ভাবে বা কতটা যুক্ত ছিলেন, তার তথ্য আছে নানা জায়গায়। ১৮৮৯ থেকে শুরু করে ১৯৪১, পাঁচ দশক বিস্তৃত সময়ে তিনি প্রায় নব্বইটি বিজ্ঞাপনে নিজের মন্তব্য, উক্তি, উদ্ধৃতি, এমনকি ছবিও ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন।
বিদেশি ও দেশীয় এয়ারলাইন্স, ভারতীয় রেল থেকে শুরু করে গোদরেজ সাবান, বোর্নভিটা, কুন্তলীন কেশ তেল, রেডিয়ম ক্রিম, বাটা-র জুতো, ডোয়ারকিন হারমোনিয়াম, সমবায় বিমা, ছাপাখানা, কটন মিল, ফটো-স্টুডিয়ো, রেকর্ড, বই, মিষ্টির দোকান, ঘি, দই, কাজল-কালি, পেন্টওয়ার্ক, এমনকি মস্তিষ্কবিকৃতি রোগের মহৌষধ পর্যন্ত হরেক পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপনে খুঁজে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথকে। অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার, দ্য স্টেটসম্যান, প্রবাসী, তত্ত্ববোধিনী, ক্যালকাটা গেজেট-এ; আর বিদেশে দ্য গার্ডিয়ান, দ্য গ্লোব-এর মতো পত্রিকাতেও।
নেহাত শখে যে এ সব বিজ্ঞাপনে সম্মতি দিতেন, তা নয়। জানা যায়, মূলত বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ সংগ্রহই ছিল তাঁর বিজ্ঞাপন জগতে আসার কারণ।"
রবিঠাকুর না হয় বিশ্বভারতীর জন্য বিজ্ঞাপন জগতে এসেছিলেন। তোমরা ক্রিকেটাররা ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য বিজ্ঞাপন জগতে থাকলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই, থাকা উচিতও না।
তবে, একটা পরামর্শ আছে। নিজের দাড়ির জন্য ব্লেডের বিজ্ঞাপন করেননি রবিঠাকুর। এটা ভুলে গেলে চলবে না।