নামকাওয়াস্তে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা কতটা যৌক্তিক হয়েছে এবং হবে?
তিতুমীর কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে যা যা করেছেন, তার কোনোটাই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি; বরং অসুবিধা ও বিরক্তির কারণ হয়েছে।
মনে হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের স্বার্থে অন্যদের ভোগান্তিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন। অবশ্য এই আচরণ রাজনীতিক, পেশাজীবী, শ্রমিক সবাই-ই করে থাকেন স্ব স্ব দাবি আদায়ের জন্য।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর থেকে পাড়ায় পাড়ায় বা জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমে যে আন্দোলন করছেন, তাতে আদোতে লাভটা কী হবে? দেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত নয় বলে, বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী সেখানে ভর্তি হতে চান না। তারা পছন্দ করেন, হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। তাহলে সেই প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান না বাড়িয়ে, কেন নতুন করে এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার হচ্ছে?
দেশে সব মিলিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫৫টি, অথচ এর অধিকাংশই শিক্ষার্থীদেরকে আগ্রহী করে তুলতে পারছে না। এরপরেও ছাত্রছাত্রীরা দাবি জানাচ্ছেন, প্রায় প্রতিটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হোক।
বিগত সরকার নিজেদের স্বার্থেই অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। জেলায় জেলায় এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করা হয়েছিল বিভিন্ন পক্ষ থেকে। এর ফলে হয়তো একদল লোকের চাকরি হবে, আরেকদল পাবে সনদ। কিন্তু দেশের শিক্ষার মান কিংবা জ্ঞানচর্চায় এতোটুকু উন্নতি হবে না; বরং শিক্ষা ব্যবস্থা আরও ধ্বংস হবে। প্রতি পাড়া-মহল্লায় কলেজ এবং পরে সেখানে অনার্স-মাস্টার্স চালু করে কী লাভ হয়েছে দেশের?
বিশ্ব র্যাংকিং এ বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই বললেই চলে। এমনকি, নিয়োগযোগ্য শিক্ষার্থী গড়ার তালিকায় নেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। ফরাসি পরামর্শক ফার্ম ইমার্জিংয়ের জরিপে 'গ্লোবাল এমপ্লোয়েবিলিটি ইউনিভার্সিটি র্যাঙ্কিং অ্যান্ড সার্ভে (২০২৫)'- এ বিশ্বের সেরা ২৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জায়গা করে নিতে পারেনি। মূলত নিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন চাহিদার ওপর জরিপ চালিয়ে এটি করা হয়েছে।
তাহলে কী দাঁড়ালো? কেন আমরা অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় করার পরেও পিছনের সারিতে পড়ে আছি। এর উত্তর একটাই— শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের মান, বোঝার ক্ষমতা, ভাষাগত দক্ষতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কোনোদিক দিয়েই আমরা এগিয়ে নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত ৭টি কলেজকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করেছেন এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত থাকতে তাদের অসুবিধা কোথায়? যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে ৭টি কলেজ আছে, সেগুলো ঢাকার বাহিরের যেকোনো কলেজ থেকে ভালো অবস্থায় আছে সত্য। কিন্তু তারপরও অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর মতো দক্ষ ও যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক, ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি সুবিধা সেখানে নেই। কিন্তু এভাবেই লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করছেন। এতে শিক্ষার মান বাড়ছে না, কিন্তু ছাত্র ভর্তি ও পরীক্ষার ফি ইত্যাদি দিয়ে আয় হচ্ছে।
২০১৭ সালে যখন ৭ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল, তখন অনেকেই সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। সেইসময় কোনো আপত্তিতে কান না দিয়ে ৭ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল। এরপর গত ৭ বছর এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা নানান ধরনের সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থেকে বের হয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের দাবি তারা এভাবে তোলেননি এবং কঠোর অবস্থানেও যাননি কখনো।
শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে অভিযোগ করেছেন, তারা শিক্ষা বৈষম্যের শিকার। অবকাঠামাগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা দেওয়া হয় না। এই কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত শিক্ষক-শ্রেণিকক্ষ-গবেষণাগার, কোনোটাই নেই। চালু হয়নি সেমিস্টার পদ্ধতি। তাদের এইসব অভিযোগ অমূলক নয়। তাহলে এই সমস্যার সমাধান না করে, এই কলেজগুলো নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করলে শিক্ষার মান কি বাড়বে?
অন্যদিকে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেসব কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স পড়ানো হয় সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। সেখানে সামান্য কয়েকজন শিক্ষক, ভর্তির কোনো মাপকাঠি নেই, শিক্ষকরাও সাধারণ, মাস্টার্স ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কয়েকটি ছাড়া শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার মাপকাঠি খুব দুর্বল। শিক্ষকদের গবেষণাপত্র নেই। অভিযোগ আছে, এনজিও'র কাজ করে অনেকে সেগুলোকেই সুবিধামতো গবেষণার কাজ বলে দেখান।
সেজন্যই বারবার প্রশ্ন উঠছে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে আদতে কতটি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার? যেখানে শিক্ষার হার অনেক কম, সেখানে উচ্চশিক্ষা দরকার কতজনের এবং এই উচ্চশিক্ষা নেওয়ার ও দেওয়ার মতো যোগ্য কতজন আছেন, সেটাও ভেবে দেখা দরকার। বড় বড় পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জানার ইচ্ছা, শিক্ষার মান কেমন তা কি কখনো মূল্যায়ন করা হয়েছে?
এতদিন সরকার দলীয় লোক নিয়োগের একটি জায়গা হিসেবে অসংখ্য কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেছে। মান উন্নয়নের কথা ভাবেনি। প্রতিবাদ জানালেও শুনেনি। তাহলে সেই একই কাঠামো বজায় রেখে এখনো কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল যে কাজ, অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া, সেই কাজে বরাদ্দ খুবই কম। নগণ্য বরাদ্দ দিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং-এ থাকবে বলে আমরা আশা করি কীভাবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা, কারিকুলাম, পরীক্ষা পদ্ধতি কোনোটাই ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাথে মেলে না। অন্যদিকে, সাতটি কলেজ নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে নানান ধরনের সমস্যাও দেখা দেবে। এতগুলো কলেজের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম এক সিস্টেমের অধীনে চালানো কঠিন হবে বলে অনেকেই মনে করেন। এছাড়া রয়েছে অবকাঠামো, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক প্রশিক্ষণ সবকিছুর অভাব।
দেশের পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে ভাবতে হবে কলেজগুলোর এক্সিলেন্স কীভাবে বাড়ানো যায়? এই কলেজগুলোতে কারিগরি সাবজেক্টে জোর দেওয়া সম্ভব কিনা? ছাত্রছাত্রীরা যে বৈষম্যের শিকার, তা দূর করা যায় কিনা? কলেজগুলোতে যদি অবকাঠামোগত সুবিধাদি বাড়িয়ে শিক্ষকের অভাব দূর করা যায়, গবেষণার সুযোগ দেওয়া যায়, স্বয়ংসম্পূর্ণ ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করা যায় ও উন্নত একাডেমিক ক্যালেন্ডার চালু করা যায়, তাহলে অবশ্য এইসব কলেজেই ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় হঠকারি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই অসংখ্য কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। মানবৃদ্ধি না করে বিশ্ববিদ্যালয় করাই যে একমাত্র সমাধান নয়, এটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেসব সমস্যার কথা বলছেন, সেগুলো আগে সমাধান করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও ছাত্রসংখ্যা বেশি হলেই যে সবাই উচ্চশিক্ষা অর্জনের যোগ্য হবেন, এমন কোন কথা নেই। সবাই উচ্চশিক্ষিত হলেই যে ভালো চাকরি পাবেন, তাও নয়। মাস্টার্স পাশ করে চাকুরি না পেলে সময় এবং টাকা দুটোই নষ্ট হয়। শিক্ষিত বেকার মানুষ বেশি হতাশায় ভোগেন।
বাংলাদেশের প্রতি জেলায় যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই বিশেষায়িত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা বা ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এগুলোর অবস্থা বেশ দুর্বল। তাহলে আর বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে আমরা কী করবো? কয়েকটি বাদে বিভিন্ন সরকারি ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে তাতে শিক্ষার মান অর্জিত হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা সার্টিফিকেট পাচ্ছেন, কিন্তু মানসম্মত পড়াশোনা না করায় কর্পোরেট, মাল্টি ন্যাশনাল, গার্মেন্টস, বড় কারখানা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যাংকিংসহ বহু জায়গায় ভালো চাকরি পাচ্ছেন না। দেশের শ্রমবাজারে বিদেশিরা জায়গা করে নিচ্ছেন। বিশেষ করে গত ৫/৬ বছর যাবত সরকারি চাকরির জন্য শিক্ষার্থীদের ঝোঁক পুরো ব্যবস্থাটাকেই দুর্বল করে ফেলেছে।
রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার এই উদ্যোগ আসলে এক ধরনের রাজনীতি; এই সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। 'নতুন প্রতিষ্ঠিত ২০টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমি নেই। সেগুলো পরিচালিত হচ্ছে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ভবনে কিংবা ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবন ভাড়া করে। ফলে চরমভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে এই নবাগত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম'। (সূত্র: প্রথম আলো)
কলেজগুলোকে হরেদরে বিশ্ববিদ্যালয় করে ফেলা ও নামকাওয়াস্তে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার চেয়ে বিদ্যমান কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাঠামো, পাঠ্যক্রম, শিক্ষক-শিক্ষিকা, গবেষণা, প্রশাসনিক কার্যক্রম, প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ, গ্রন্থাগার, স্বাস্থ্য সুবিধা, খাদ্যের মান ও আবাসিক সুবিধাদি বাড়াতে হবে। ছাত্রছাত্রীদেরও বুঝতে হবে পড়াশোনার মান ও সুবিধা উন্নীত করাই আসল, শুধু নামকরণে বিশ্ববিদ্যালয় নয়। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে না পারলে কিসের উচ্চশিক্ষা?
মানবসম্পদ উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই শুধু সংখ্যা বাড়ানো নয়, মানসম্মত উচ্চশিক্ষাই হওয়া উচিৎ মূল লক্ষ্য। আর সবচেয়ে বড় কথা অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হচ্ছে কেন? এই সরকারের মূল কাজ একটি ভালো নির্বাচনের আয়োজন করা, শিক্ষা বিষয়ক বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া নয়।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।