বেগম রোকেয়াকে নিয়ে কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নয়
বেগম রোকেয়াকে নিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না এবং মানা উচিৎও নয়। বেগম রোকেয়া এমন একটি অবিস্মরণীয় নাম, যাঁকে অপমান করার অধিকার কারো নেই। উনি বাঙালি মুসলিম নারী শিক্ষার প্রচারক, নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত। কিন্তু হঠাৎ করে কেন, কী উদ্দেশ্যে এই মহীয়সী মানুষটিকে নিয়ে ক্ষেপে উঠেছে একটা গোষ্ঠী?
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) নাম পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠাকালীন 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' নাম পুনর্বহালের দাবিতে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের কেন মনে হলো, এই নামটি পরিবর্তন করতে হবে? বেগম রোকেয়া নিশ্চয়ই মুজিব পরিবারের অথবা আওয়ামী লীগের কেউ নন। অবশ্য বেরোবি ভিসিও মনে করেন এই দাবি ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের একটি অংশ।
যেহেতু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয়টির নামফলক ও নাম পরিবর্তন করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) করেন, তাই এখন এই নাম পরিবর্তন করতেই হবে। তারা আরও বলতে চাইছেন, বেগম রোকেয়া সরকারি কলেজ, বালিকা বিদ্যালয় আছে, তাহলে আবার বিশ্ববিদ্যালয় কেন? উপমহাদেশের মুসলিম বাঙালি নারী জাগরণে বেগম রোকেয়ার যা অবদান, তাতে তো রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় না হয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ আরও সম্মানজনক হওয়ার কথা। কারণ বেগম রোকেয়া রংপুরে জন্মগ্রহণ করে একে পুণ্যভূমির মর্যাদা দিয়েছেন।
প্রায় একই সঙ্গে লক্ষ্য করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের সামনের দেওয়ালে 'বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ' বেগম রোকেয়ার একটি গ্রাফিতির চোখ ও মুখ কালো রঙের স্প্রে দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন ওই হলেরই একজন শিক্ষার্থী। যে এই গ্রাফিতি কালো রঙ করেছেন, তিনি বলেছেন, 'ছবিগুলোর মুখের কারণে বারান্দা থেকে নামাজে একটু সমস্যা হয়।' এবং 'বারান্দায় গেলে ওই মুখগুলো আমায় বিরক্ত করতো। তাই আমি সেগুলোকে ঝাপসা করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।'
কী অদ্ভূত যুক্তি। যাঁর অবদানে মেয়েটি আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারছেন, তাঁকেই অপমান করছেন। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেছেন, কিন্তু সে কি কারো দ্বারা আদিষ্ট হয়ে কাজটি করেছে কি–না, তা খুঁজে দেখা দরকার বলে মনে করছি। কারণ মেয়েটির কথায় অসামঞ্জস্য রয়েছে।
এই দুটো ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে মনে হচ্ছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নারী অধিকারকর্মীরাও মনে করেন, এর পেছনে অশুভ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। এই দুটো ঘটনাই আসলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ও ধর্মীয় রাজনীতির বাড়াবাড়ির ফল। যেখানে বেগম রোকেয়াকে শত্রু বলে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নারীকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, নিজের সম্মান রক্ষা করার, অধিকার আদায়ের ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়েছেন বেগম রোকেয়া।
ফরাসি লেখক ও দার্শনিক সিমন দ্য বোভোয়ার বলেছেন, 'নারীর সচেতনতা যত বাড়বে, পুরুষ তত হিংস্র হয়ে উঠবে।' সেই কথা অনুযায়ী, বেগম রোকেয়া মৌলবাদী পুরুষ শক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বোভেয়ারের প্রবন্ধ গ্রন্থ 'দ্য সেকেন্ড সেক্স' প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। অনেকেই মনে করেন নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের উত্থান মূলত সিমন দ্য বোভোয়ারের 'দ্য সেকেন্ড সেক্স' বইটি দ্বারা প্রভাবিত।
অন্যদিকে, ১৮৮০ সালে জন্মগ্রহণ করা এই বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক যা বলে গেছেন— তা আজকের নারী সমাজের জন্য এখনো প্রযোজ্য। প্রচুর আইন, নিয়ম ও পরিবর্তন সত্ত্বেও বাংলাদেশের মেয়েদের মুক্তি ঘটেনি। রোকেয়া নারী–পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতার কথা বলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা উনি নারীর অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, এটাই বোধকরি তাঁর অপরাধ ছিল। এত বছর পরেও মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের সামনে তা নতুনভাবে ফুটে উঠেছে।
বেগম রোকেয়া ১৯০৪ সালে লিখেছেন, 'কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলন করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন-রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।'
সেদিন রোকেয়া বুঝতে পেরেছিলেন, নারীরা পুরুষভিত্তিক সমাজে মূলত দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচিত। এখনো অধিকাংশ নারীর পরিচয়ই তাই। পুরুষ, বিশেষ করে মৌলবাদী পুরুষ ও নারী দুই-ই সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। তারা আধিপত্যবাদী বলেই ভিন্নমত সহ্য করতে পারেন না এবং সবাইকে জোরজবরদস্তি খাটিয়ে নিজেদের মতের স্বপক্ষে আনার চেষ্টা করেন। আমাদের সমাজে নারীরা সাধারণত দুর্বল ও নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকেন, আর এই সুযোগটাই গ্রহণ করে শোষণকারী সমাজ।
এই যে এত বড় একটা বিপ্লব হয়ে গেল ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টে। নারী–পুরুষ ও ছাত্রছাত্রীরা সমানভাবে অংশ নিয়েছেন। অথচ দেখেন ক্ষমতায় বসেছেন পুরুষ প্রতিনিধিরা। হিরো হয়েছেন তারাই, জনগণ তাদেরই চেনেন, তাদের কথাই বলেন। নারীর আন্দোলন বা আন্দোলনে নারীর অবস্থান সেই দ্বিতীয় লিঙ্গই রয়ে গেছে। কাজের সময় আছেন, কিন্তু ক্ষমতায়িত হওয়ার সময় নেই।
এই আন্দোলনে নারীরা লড়েছেন সমানতালে, এখন কেন আড়ালে? ঠিক এই বিষয়টিকে সামনে রেখেই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে 'গণ-অভ্যুত্থানের নারীদের সংলাপ, নারীরা কোথায় গেল?' শিরোনামে সেমিনার। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন আরও কয়েকজন নারী। আন্দোলনে সমানতালে লড়াই করে কেন আন্দোলনের পর তাঁরা কোনো আলোচনায় নেই, সেই প্রশ্ন ছিল তাঁদেরও।
উমামা ফাতেমা ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে সমন্বয়ক হিসেবে তাঁর ভূমিকা ও পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণণা করেন এভাবে, '৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে খেয়াল করি, দৃশ্যপট থেকে আমি কমপ্লিট (সম্পূর্ণ) নাই। ভ্যানিশ (অদৃশ্য) হয়ে গেছি। ক্যামেরা কিছু ছেলেদের ফোকাস (আলোকপাত) করে, তাঁরা আন্দোলনের মহানায়ক। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, তাঁরাও একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।' (সূত্র: প্রথম আলো)
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, 'আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নারীদের 'মাইনাস' করা শুরু হলো।'
নোয়াখালীর শিক্ষার্থী সুমাইয়া রিশু বলেন, 'আন্দোলনের সময় নারী-পুরুষ কোনো ভেদাভেদ ছিল না। এখন অনেকেই আছেন দখলদারিত্ব নিয়ে, নিজেদের তুলে ধরা নিয়ে। ঢাকার বাইরে যেসব নারী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের কোনো অবস্থানই নেই এখন।'
'শুধু পুরুষদের জন্য না, এই আন্দোলন সফল হয়েছে ব্যাপকভাবে নারীদের অংশগ্রহণের কারণেই। মেয়েরা অনেক কৌশল করে, বাড়িতে মিথ্যা বলে, কোচিংয়ের কথা বলে, মায়ের পা ধরে সামাজিক ঘেরাটোপ ভেঙে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। আন্দোলনের পর ওই নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক হারে হয়রানির শিকার হন। সরকারকে বলার পর মনে হয়েছে, এটাকে তাঁরা বড় বিষয় মনে করেনি। এমনকি, কোনো নারী শহীদের কথাও উঠে আসেনি রাষ্ট্রীয় স্মরণসভায়। হোসেন মারওয়াসহ কয়েকজন নারীর ছবি রাখা হয়েছিল একটি বেদির ওপর। নারীরাই এই নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন,' যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে নারী শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর প্রাধান্য লক্ষণীয়। রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব চোখে পড়ার মতো, কৃষিতে নারীর অবদান প্রায় পুরুষের কাছাকাছি। দেশে খেলার মাঠে নারী, ব্যবসা চালাচ্ছেন নারী, প্রযুক্তি খাতে বেড়েছে নারীর প্রবেশাধিকার, সংসার সামলাচ্ছেন নারী এবং সেইসাথে দেশের সার্বিক এসডিজি লক্ষ্য অর্জনে নারীর ভূমিকার কথাও গুরুত্ব দিয়ে বলা হচ্ছে। গ্রাম বা শহর সবখানেই কাগজে-কলমে নারীর এগিয়ে যাওয়া চোখে পড়ার মত। কিন্তু এরপরও সিংহভাগ নারীকে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ণ সহ্য করতে হচ্ছে। একক নারী, নারীর একক পরিবার এবং একক মা এবং সর্বোপরি নারীর অর্জনকে সমাজ করুণার চোখে দেখে।
এই আধুনিক পরিসরেও নারীকে এক ধরনের ভয়ের পরিবেশে চলাফেরা করতে হয়। ঘরে বাইরে, পরিবহনে, শিক্ষাক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারীর যতোই অর্জন থাকুক না কেন— নারী তাদের কাজের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা ও অধিকার কতটা পাচ্ছেন? গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর সার্বিক উন্নতি হলেও এই একটা জায়গায় এসে যেন স্থবির হয়ে আছে নারী। সেখানে গ্রামের একজন খেটে খাওয়া নিরক্ষর নারীও যা, শহুরে শিক্ষিত নারীও তা। সবসময়ই তাকে অন্যের আশ্রয়ে, প্রশ্রয়ে, শাসনে, শোষণে বাঁচতে হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধ, নিয়ম-কানুনের বেড়াজালে পড়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। যার কারণে অনেক নারী প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত হতে পারেননা। নারী যতই যুদ্ধ করে এগিয়ে যাক না কেন, সমাজ তাকে পেছন থেকে টেনে রাখে ।
নারী ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিশালী আন্দোলন করছেন ঠিকই– কিন্তু ঘরের ভেতরে, সহযোগীদের সাথে, নিজস্ব সংগ্রামে পরাজিত হচ্ছেন। তারা অ্যাক্টিভিস্ট হয়ে ওঠেন মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, প্রচারণা চালানোয় এবং তারা এসব আন্দোলনে পুরুষের সমান সংগ্রাম করেন, কিন্তু স্বীকৃতি দেওয়ার মালিক সেই পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা।
দাবি জানাই, কোনোভাবেই যেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা না হয়। বেগম রোকেয়াকে নিয়ে সব ধরনের রাজনীতি বন্ধ হোক, সে প্রত্যাশা রাখি।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।