পঞ্চাশে বাংলাদেশ: ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ যেভাবে আজ ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে
১৯৭২ সালের কথা। সদ্যই পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেওয়া নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আখ্যায়িত করেন 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে। কিন্তু ইতিহাস তার এই উক্তিকে ভুল প্রমাণিত করেছে।
দু'বার নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ — একবার পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ১৯৪৭ সালে, এবং অন্যবার ১৯৭১ সালে, বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে। দুবারই এ ভূখণ্ডটি অর্থনৈতিকভাবে ছিল পশ্চাৎপদ। কিন্তু আজ দেশটি রয়েছে সাধুবাদ জানাবার মতোই একটি অবস্থানে। বিশেষত গত ১৫ বছরের কল্যাণে, একজন গড়পড়তা বাংলাদেশির আয় যেকোনো গড়পড়তা পাকিস্তানি বা ভারতীয়ের চেয়ে বেশি।
এর মাধ্যমে কিন্তু এমন দাবি করা হচ্ছে না যে বাংলাদেশের সামগ্রিক গ্রোস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট (জিডিপি) তার দুই 'অভিভাবক' দেশের চেয়ে বেশি; ২০২০ সালে, বাংলাদেশের জিডিপি ছিল পাকিস্তানের জিডিপির ৮৩ শতাংশ, এবং ভারতের জিডিপির মাত্র ১১ শতাংশ।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেশটিতে দেখা গেছে দ্রুততর বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, নিম্ন সামগ্রিক জনসংখ্যা, এবং সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, নিম্ন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। গেল ১৫ বছরে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (১৮ দশমিক ৭ শতাংশ) ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (২১ শতাংশ) চেয়ে কম। এগুলোর সুবাদেই, বাংলাদেশের জনপ্রতি জিডিপি এখন উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
কিন্তু এসব বড় বড় সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিসংখ্যানের বাইরেও, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়েছে আরো নানাভাবে। আর এক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ হেঁটেছে অনেকটাই ভিন্ন পথে। ভারত যেখানে একটি কৃষিজীবী অর্থনীতি থেকে চাকরি-নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে শিল্পখাতের টেকসই উত্থান।
এই উত্থান ত্বরান্বিত করেছে বিভিন্ন শ্রম আইন, যার ফলে বড় বড় ফার্মগুলো গড়ে উঠেছে এবং নিজেদের কার্যক্রম ঠিকভাবে পরিচালনা করতে পেরেছে। এতে করে ওইসব ফার্ম থেকে শত কোটি টাকা বেরিয়েছে, এবং শিল্পখাতে পূর্বাপেক্ষা ভালো মজুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। আলাদা করে বলা যায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পোশাক খাতের কথা। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বসেরার কাতারে। ভারত, পাকিস্তানকে তো যোজন যোজন ব্যবধানে পিছনে ফেলেছেই, এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে চীন, তাইওয়ানের বিরুদ্ধেও।
বাংলাদেশের অভাবনীয় সাফল্যের পেছনে আরো রয়েছে সামাজিক ও মানব উন্নয়ন সূচকগুলোতে অগ্রগতি। যেমন তারা অনেক এগিয়ে গেছে স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, বাণিজ্যিক অন্তর্ভুক্তি এবং নারীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায়। উদাহরণস্বরূপ, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্টে (২০২১) বাংলাদেশ ১৫৬টি দেশের মধ্যে রয়েছে ৬৫ নম্বরে। অথচ ২০০৬ সালে তারা ছিল ৯১তম অবস্থানে। এদিকে ২০০৬ সালে ৯৮তম অবস্থানে থাকা ভারতের বর্তমান র্যাংকিং ১৪০। বাস্তবিকই, বাংলাদেশের এমন রূপান্তরের পেছনে নারীদের ছিল অসামান্য ভূমিকা। শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার এখন প্রায় ৪০ শতাংশ, যা ভারতের (২২ দশমিক ৩ শতাংশ) চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন সূচক ২০২০-এ বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে মাত্র অল্প কয়েক ধাপ পিছিয়ে। কিন্তু এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, এই সূচকে দুই দেশের গতিপথ কিন্তু অনেকটাই আলাদা। ভারতের স্কোর ও অবস্থান যেখানে এক জায়গায় স্থবির হয়ে রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। যেমন ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এই সূচকে ভারতের অবস্থানের উন্নতি হয়েছে মাত্র এক ধাপ, অথচ বাংলাদেশ এগিয়েছে আট ধাপ। যদিও শিক্ষা সাফল্যের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটুর জন্য হেরে যায়, কিন্তু স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়ন চোখ ধাঁধানো। জন্মলগ্নে বাংলাদেশের গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭২ দশমিক ৬ বছর, যা ভারতের চেয়ে তিন বছর বেশি।
এদিকে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকেও ভারত (১০১) ও পাকিস্তানের (৯২) চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে। অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠীর অনুপাত কিংবা চাইল্ড ওয়েস্টিংয়ের (পেশীর ক্ষীনতা বা উচ্চতার তুলনায় কম ওজন) ব্যাপকতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্কোর ভারতের অর্ধেক।
অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিতেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেছে। বিশ্ববাংকের গ্লোবাল ফিনডেক্সে দেখা যাচ্ছে, যদিও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর অনুপাত ভারতীয়দের চেয়ে কম, কিন্তু অচল ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অনুপাত আরো অনেক কম। একইভাবে স্যানিটেশনের দিক দিয়েও, বাংলাদেশে মৌলিক স্যানিটেশনের আওতায় আসা জনগোষ্ঠীর অনুপাত ভারতের চেয়ে কম হলেও, অনিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের কারণে বাংলাদেশের মৃত্যুহার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম।
তবে সে যা-ই হোক, বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে এখনো দারিদ্র্যের হার অনেক বেশি — এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালে তা ছিল ২০ শতাংশের উপরে। দেশটি ব্যাপক অসাম্যেও জর্জরিত। বিশ্ব অসমতা প্রতিবেদন ২০২২ অনুযায়ী, নিচের দিকের ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয় মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ১৭ শতাংশ। এদিকে প্রথম ১০ শতাংশের হাতেই রয়েছে মোট জাতীয় আয়ের ৪৩ শতাংশ। দুর্নীতিতেও বাংলাদেশের অবস্থা বেশ শোচনীয় — ২০২০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল করাপশান পারসেপশন ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে তাদের অবস্থান ১৪৬, যা ভারত (৮৬) বা পাকিস্তানের (১২৪) চেয়ে অনেক খারাপ।
তবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, সামাজিক-অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন যে বিষয়টি দ্বারা নির্ধারিত হবে, সেটি হলো গভীর গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ-সর্বগ্রাসী প্রবণতা পরিহার।
লেখক: উদিত মিশ্র 'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস'-এর ডেপুটি অ্যাসোসিয়েট এডিটর।
অনুবাদ: জান্নাতুল নাঈম পিয়াল