আমাদের দুর্বলতার সুযোগেই জেগে উঠতে পারে যুদ্ধাপরাধীদের প্রেতাত্মারা
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ তার স্ট্যাটাসে স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের স্ত্রী বা জায়াদের কথা। কেমন আছেন তারা? শাওনের এই স্ট্যাটাসটা দেখে মনে হলো, বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদদেরই কোন খবর নাই, সেখানে তাদের জায়া, পুত্র, কন্যা বা পরিবারের কী খবর থাকবে? এর চাইতে অনেক বেশি খবর জানি, বিজয় দিবস উপলক্ষে কোথায় কোন ধামাকা অফার চলছে, কত টাকার বাজি পুড়ানো হবে? কোথায় কোথায় কনসার্ট হবে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনকালে এর চেয়ে বড় অপ্রিয় সত্যি কথা আর হয় না।
একথা ঠিক যে একটি দেশের সব মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমানভাবে ধারণ করবে, তা নয়। কিন্তু তাই বলে কি এমন অবস্থায় চলে যাবে, যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা বা স্মরণ করাকে অতীত নিয়ে টানাটানি মনে করা হবে। যারা যুদ্ধ করেছিলেন, তাদের অনেকেই আজ নাই। যারা আছেন তারাও ভগ্ন মন ও স্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছেন। বছরের দুটি দিনে তাদের নিয়ে কথা হবে, টানাহেঁচড়া হবে, এটা মেনে নিয়েই সুখী হতে হয় তাদের।
বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে এবং জাতীয় নেতাদের হত্যা করার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের যে বীজ বোনা হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল নিশানাকে সরিয়ে দেয়া। এই ষড়যন্ত্রের কাজটা যারা করেছিল, তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, এই কথাটা যেমন সত্য, সেই সাথে এও সত্য এরাই পাকিস্তানের পক্ষের শক্তিকে চেতন বা অবচেতনভাবে পুনরায় ক্ষমতায় নিয়ে এসেছিলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাহিত করা হয়েছিল খুব নিপুণভাবে। ইতিহাসে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথাই লেখা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এই কথাটিই প্রকৃত সত্য। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে এরা একপ্রকারে দেশের স্বাধীনতারই বিরোধিতা করেছে।
এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসতে থাকলো জামাতে ইসলামি ও রাজাকাররা এবং তা মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরেই। এইভাবেই তারা একদিন সেই মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে দিয়ে পুরো রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল। আর তাই তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের মতো বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সহচর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরিকল্পনার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি নিজেই একথা তার বন্ধু, আমার বাবার কাছে কেঁদে স্বীকার করেছিলেন; তার ভুলের কথা, স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে আতাঁতের কথা। তিনি বলেছিলেন কিছু ছদ্মবেশি স্বাধীনতা বিরোধীর প্ররোচনায় তারা এই হীন কাজ করেছেন। বহুবছর অভিশপ্ত জীবন কাটাবার পর, তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যখন দেখেছিলাম মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিষ্টি বিতরণ করছে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে তৎকালীন গণকণ্ঠ পত্রিকায় কর্মরত একজন সাংবাদিক এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আরেকজন প্রতিবেশি, সেদিনই হিসাবটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। খুব ধীরে ধীরে পাকিস্তানী শক্তি আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
'৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেকে ৯০ সাল অব্দি বাংলাদেশে দু'ধরণের কাজ হয়েছে, একদিকে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে যতোটা সম্ভব নিন্দা-মন্দ করে ডুবানোর চেষ্টা করা হয়েছে, অন্যদিকে জামাত-শিবির-রাজাকারদের পুনরুত্থান ঘটেছে। '৭৫ এর হত্যাযজ্ঞের সময়ে এবং এরপরে সেনাবাহিনীর বহু মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে নানা বাহানায়। বেছে বেছে কর্মহীন করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা হয়।
সবচেয়ে বড় আঘাত হানা হয়েছিল পাঠ্যপুস্তকের উপর। কারণ পাঠ্যপুস্তক এমন একটি মাধ্যম, যা দিয়ে শিশুমনের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করা যায়। সেই সুযোগটাই গ্রহণ করেছিল '৭৫ পরবর্তী সরকার। খুব সুকৌশলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল। বই থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলেছিলো বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিবাহিনীর নাম, এদেশের মানুষের উপরে পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারদের অত্যাচারের কাহিনী ও লাঞ্ছনার কথা।
এই দীর্ঘ সময়ে তারা বেশ সফল হয়েছিল। আর সফল হয়েছিল বলেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এদেশে আবার ক্ষমতায় বসতে পেরেছিল। রাজাকারের গাড়িতে উড়েছিল বাংলাদেশের পতাকা। মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। ক্রমে বাঙালির মন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ ম্লান হতে শুরু করেছিল।
অশিক্ষা, কুশিক্ষা, হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, দুর্নীতি, আদর্শহীনতা সেই জায়গা দখল করে নিলো। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কী এবং কীভাবে রক্ষা করতে হবে এটা যাদের জানা উচিৎ, তারা আসলে কিছুই জানলো না এবং এখনো জানতে চায় না। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের দেশে এমন একটা শক্তির উত্থান ঘটছে, যারা কোন কিছু নিয়েই মাথা ঘামায় না। ইতিহাস, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সবই তাদের কাছে একধরণের ক্লিশে বিষয়।
পৃথিবীর এবং নিজের দেশের ইতিহাস নিয়ে আমাদের কোন চর্চা নেই, পড়াশোনা নেই। কত ইতিহাস আছে এই বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে! কিন্তু কই আমরা ইতিহাস ভিত্তিক কোন কাহিনী কি সাফল্যের সাথে নামাতে পেরেছি? তেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারি না বলে আজ আমরা এক সৃষ্টিবিবর্জিত মূর্খ জাতিতে পরিণত হতে চলেছি। কোন মাধ্যমেই আমাদের গৌরবগাঁথাকে তুলে ধরা হয় না। প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে কিন্তু সেগুলো কতটা প্রভাব ফেলতে পারছে নয়া প্রজন্মের উপরে? এর উত্তর দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। গায়ের জোরে বা চমক দিয়ে জ্ঞানকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যকেও তুলে ধরা যায় না।
কিভাবে, কতটা শক্তিশালী ও আধুনিকভাবে আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনাতে পারি, সেইগুলো নিয়ে আমরা কিন্তু ভাবিনা। ভাবিনা এজন্য যে আমাদের ভাবনার শক্তিই হারিয়ে যাচ্ছে। সৃজনশীল পরীক্ষা দিতে গিয়ে, আর জিপিএ ফাইভ তুলতে গিয়ে নিজেদের সৃষ্টিশীলতা মুখ থুবড়ে পড়ছে।
দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা এতোটাই ফিকে হয়ে যাচ্ছে যে, সমাজের ছোট একটা অংশ এখনো দেশপ্রেম, মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার যুদ্ধ, ইতিহাস, পতাকা, বাঙালির চেতনা, ভাষা আন্দোলনকে বুকে চেপে ধরে বসে আছে। অথচ এ কথাই সত্যি যে দেশপ্রেম ছাড়া কোন মানুষ নিজের দেশকে গড়তে পারবে না। আর তাই গোড়াতেই ভেঙে দেয়া হয়েছিল বাঙালির দেশপ্রেমের শক্তি। সেটা নাই বলেই দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী সবাই পারছি দুর্নীতিকে আশ্রয় করে নিজের পকেট ভারি করতে। দেশ গোল্লায় যায়, যাক। আমি বা আমরা যেন থাকি দুধভাতে। তাইতো বছরের পর বছর ধরে দেশ দুর্নীতিতে একনম্বর হলেও, কারো কোন মাথাব্যথা নেই।
বিজয় দিবসকে সামনে রেখে অনেক কথাই মনে হয়। আর এও জানি অনেকগুলো বছর ধরে আমাদের যে ভুল শিক্ষা দেয়া হয়েছে, আমরা তার মাশুল গুনছি। এখন আমরা যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছি, তারা প্রায় সবাই সেই জেনারেশনেরই ছাত্রছাত্রী, যাদের ইতিহাস পড়ানো হয়নি বা ভুল পড়ানো হয়েছিল। আমরাও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সচেতনভাবে সেই ভুলটাই শিক্ষা দিয়েছি।
আমরা এখন আর কেউ মনেই করি না যে, লাল সবুজ পতাকাটা শুধু উড়ানোর বা হাতে ধরে ছবি তোলার জন্য নয়। এই পতাকা আমাদের আবেগ অনুভূতি আর ভালবাসার প্রকাশ। কত মানুষের, কত অবদানে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে সে কথা তুলে ধরার কোন চেষ্টা চোখে পড়ে না। বরং চোখে পড়ছে আতশবাজির জৌলুস, ব্যানার-ফেস্টুনের ছড়াছড়ি, আলোকসজ্জা, পটকার আওয়াজ, লাল সবুজ শাড়ি-পাঞ্জাবী, উৎসব, আয়োজন। সব আছে শুধু হারিয়ে গেছে দেশের প্রতি ভালবাসাটা। দুর্বল মন নিয়ে সবসময় প্রার্থনা করি, 'তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি'। খুব ভয় হয় এই ভেবে যে, কি জানি আবার কবে আমাদের দুর্বলতার সুযোগে যুদ্ধাপরাধীদের প্রেতাত্মারা জেগে উঠবে, যারা এখনো লুকিয়ে আছে এই বাংলায়।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন