কুমুদিনী হাজংদের উত্তরসূরী মহুয়া হাজং কি শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেন?
বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত সদস্য মনোরঞ্জন হাজং। তার জীবনের স্বপ্ন ছিল মেয়েকে পড়াশোনা শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এমনভাবে মেয়েকে গড়ে তুলবেন, যেন মেয়ে তার সমাজ, এলাকার প্রান্তিক মানুষ এবং সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে। এরকম একটি মনোবাসনা থেকেই তিনি সকল প্রতিবন্ধকতাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে কন্যা মহুয়ার জন্য সবকিছু করেছেন। আর তাই মহুয়া হাজং আজ পুলিশের সার্জেন্ট হতে পেরেছেন। কিন্তু অকস্মাৎ মনোরঞ্জন হাজংয়ের সেই স্বপ্ন ভেঙে যেতে বসেছে।
পঙ্গু হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থেকে তিনি অনুভব করছেন, পুলিশের সার্জেন্ট হওয়াটাই একজন প্রান্তিক মানুষের শক্তিধর হওয়া নয়। এর চেয়েও বড় শক্তিধর পেশা আছে। পুলিশের সার্জেন্ট হয়েও একজন মেয়ে যখন বাবার এক্সিডেন্টের জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন না, তখনই মনোরঞ্জন হাজং বুঝতে পেরেছেন এই কঠিন সত্যটা। কারণ সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি নাকি একজন বিচারপতির ছেলে --- যার নাম, পরিচয় বিস্তারিত প্রকাশিত হয়নি কোথাও।
অথচ এই দুর্ঘটনার পর তিনি তার এক পা হারিয়েছেন। এখন বারডেম হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। সবচাইতে দুঃখজনক ও অপ্রিয় সত্য হলো মনোরঞ্জন হাজংয়ের মেয়ে মহুয়া হাজং পুলিশের সার্জেন্ট হলেও পুলিশ মামলা নিয়েছে ১২ দিন পরে। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে তাকে। হাসপাতালের মধ্যেই বসানো হয়েছে পুলিশি পাহারা। আর পত্রিকায় দেখলাম, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে এই পরিবারকে। অবস্থা এতটাই কঠিন যে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এখন আর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে, পা হারানো বাবার দুর্ঘটনার বিচার চেয়ে গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে নিজ বাহিনীতেই চাপের মুখে পড়েছেন নারী সার্জেন্ট মহুয়া হাজং। গণমাধ্যমে বক্তব্য না দিয়ে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে তাকে। অথচ ঘটনাটা হওয়া উচিৎ ছিল ঠিক এর বিপরীত। পুলিশ প্রশাসন যদি মহুয়া হাজংয়ের পাশে দাঁড়াতেন, তাহলে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তির ছেলেই বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে পার পেয়ে যেতে পারতো না।
আমরা যারা সমাজের মূল স্রোতধারার মানুষ, যারা শহরে বাস করি, যারা প্রভাবশালী, তারা কোনদিনও বুঝতে পারবো না তৃণমূল থেকে একজন প্রান্তিক মানুষকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়। আর সেই মানুষ যদি নারী হয়, তাহলে তো তাকে নিঃসন্দেহে আরো একশো গুণ বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয়। তবে এই যুদ্ধ করে পড়াশোনা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারলেই কি সেই প্রান্তিক মানুষ সব অধিকার পেয়ে যান? না, পান না। এর প্রমাণ পুলিশের সার্জেন্ট মহুয়া হাজং। যিনি নিজে একজন ক্ষমতাধর পদে চাকরি করার পরেও কতটা অসহায়!
আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ খুব প্রান্তিক অবস্থানের মানুষ। এই প্রান্তিক মানুষগুলো খুব কষ্ট করে বেঁচে আছেন। পড়াশোনা শেখার সুযোগ একেবারেই কম। পড়াশোনা শিখে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংখ্যা এতই কম যে হাতে খুঁজে বের করতে হয়। আবার পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের চেয়ে সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের অবস্থা বেশি করুণ।
যারা এদের নিয়ে কাজ করছেন, তারা জানেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর উন্নয়ন, খাদ্য, জীবন-জীবিকা সকল ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের অবস্থা দুর্বল। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, "সমতল আদিবাসীদের শতকরা ৭০ ভাগ এবং পাহাড়ের আদিবাসীদের শতকরা ৮০ ভাগ করোনার পরে আরো দরিদ্র হয়ে পড়েছেন।"
মহুয়া হাজংয়ের মতো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একজন নারীকে বহুমুখী বৈষম্যের শিকার হতে হয় তার পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এই বৈষম্যগুলো হয় --- প্রথমত নারী হিসেবে, দ্বিতীয়ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে এবং তৃতীয়ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী হিসেবে। এছাড়া বিভিন্ন বৈষম্যমূলক নীতি এবং সমাজের বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখা হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও আদিবাসী নারীরা খুব কমই সুযোগ পেয়ে থাকে।
এরপরেও যখন যুদ্ধ করে মহুয়া হাজং এর মতো একজন নারী বেরিয়ে আসেন এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হন, তখনও একসময় তিনি বুঝতে পারেন, এখনো সর্বহারাই রয়ে গেছেন। রাষ্ট্র তার পাশে নেই। শুধু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বলে নয়, আমাদের দেশে সব সাধারণ মানুষই প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন। প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে সব অর্জনই শূন্য।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের অধিকার ও বঞ্চনার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, নওঁগার একটি 'আদিবাসী পল্লী'র কথা। সেখানে কেউ মারা গেলে মরদেহ পোড়ানোর মতো কোন শ্মশান ছিল না। সাঁওতাল বলে মূল শ্মশানে মরদেহ পোড়ানোর অধিকার তাদের ছিল না। জাত-পাতের কঠিন বিচারে মরণের পরেও এই দরিদ্র মানুষগুলো একঘরে হয়ে ছিল।
এরপর স্থানীয় সাঁওতালরা বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের 'একমুষ্ঠি চাল' প্রকল্পের অধীনে কিছু টাকা জমিয়ে, সেই টাকা দিয়ে নিজেদের পোড়ানোর জন্য একটুকরো জায়গার ব্যবস্থা করলো। শুধু কি শ্মশান, সাওঁতালদের সেই গ্রামে যাওয়ার জন্য কোন রাস্তাও নেই। জমির আইলের উপর দিয়ে হেঁটে ঐ এলাকায় পৌঁছানোর পর দেখা যায় এবড়ো-থেবড়ো একটি গ্রাম। চারিদিকে ময়লা খানাখন্দ। বর্ষাকালে পানি জমে থাকে সেখানে।
এরপর আসি গাইবান্ধা জেলার সাপমারা ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের সাঁওতাল নারী অলিভিয়া হেমব্রমের কথায়, যিনি যুদ্ধ করে আসছেন সমাজপতি ও সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে কোর্টের আদেশ ছাড়াই স্থানীয় প্রশাসন ও সন্ত্রাসী বাহিনী সাঁওতালদের বসতবাড়ী উচ্ছেদের নামে তাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, প্রাইমারী স্কুল তছনছসহ গুলিবর্ষণ করেছিল। এরপর থেকে নানানভাবে যুদ্ধ করে অলিভিয়ারা বেঁচে আছেন। এমনো দিন গেছে, খোলা প্রান্তরে, সহায়-সম্বলহীনভাবে তাদের দিন কেটেছে। সন্তানদের লেখাপড়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেছিলো।
কিন্তু সমস্যা তাদের পেছন ছাড়েনি। এখন বড় সমস্যা হচ্ছে, আবাদি জমি নষ্ট করে, বাড়িঘর উচ্ছেদ করে এখানে ইপিজেড গড়তে চায় সরকার। কিন্তু তারা এতে রাজি নন। কারণ বংশপরম্পরায় পাওয়া এই জমি একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে, একদম পথে বসে যাবেন তারা। তাই তাদের আন্দোলন চলছে। কিন্তু কষ্ট সেই একটাই, প্রভাবশালী কেউ তাদের পাশে এসে সহসা দাঁড়ান না।
যাক আবার ফিরে আসি মহুয়া হাজংয়ের আলোচনায়। এই ঘটনাটি থেকে মনে প্রশ্ন জাগে, পুলিশ যদি তাদের সহকর্মীর ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে না দাঁড়ায়, তাহলে সাধারণ মানুষের পক্ষে কিভাবে দাঁড়াবে? "সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত", "প্রাথমিক তদন্ত", "তদন্ত শেষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে" টাইপ কথাবার্তা খুব ক্লিশে বলে মনে হয় আজকাল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহুয়ার এক আত্মীয় গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, 'এত তথ্য প্রমাণ থাকার পরও অজ্ঞাত নামে মামলা হলো। এতেই বোঝা যাচ্ছে, এ বিচার আমরা কখনো পাব না। শুধু গণমাধ্যমের চাপের কারণে মামলা হয়েছে। দুর্ঘটনার তদন্ত বা বিচার করার জন্য নয়।'
আমরা যারা এদেশের সাধারণ মানুষ তারা মহুয়া হাজংকে জয়ী দেখতে চাই। কারণ আমরা জানি হাজংরা প্রধানত ধান চাষী হলেও ঐতিহাসিক হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, ব্রিটিশ বিরোধী ও জমিদার বিরোধী আন্দোলনে এদের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।
মহুয়া হাজং আর কেউ নন, তিনি যোদ্ধা কুমুদিনী হাজং, যাদুমনি হাজং, প্রথম শহীদ রাসিমণি হাজং, অশ্বমনি হাজং এবং ভদ্রমনি হাজং এর উত্তরসূরী। ১৯৩৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর নেত্রকোনা অঞ্চলে টঙ্ক আন্দোলন বা হাজং বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। মহুয়া হাজংয়ের জয় মানে এদেশে বিচার না পাওয়া অসংখ্য মানুষের জয়। প্রার্থনা করি মহুয়া হাজং শেষ পর্যন্ত যেন জয়ী হতে পারেন, তার পূর্বসূরীদের মতোই।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন