সব কৃতিত্ব জনগণ ও নেতৃত্বের
ব্যাপারটাকে প্যারাডক্সই মনে হয়।
স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা ও সামগ্রিক শাসন—এই তিন ক্ষেত্রেই উন্নত দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় উঠেছে এসেছে, এগুলোই কোভিড কৌশল ও সে কৌশলের সাফল্যের মূল তিনটি নির্ধারক।
তারপরও মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই তিন নির্ধারকে এগিয়ে থাকা কিছু উন্নত অর্থনীতি, যেমন: যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির চেয়ে ভালো করেছে বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশের হাতে আরেকটি জাদুর কাঠি আছে—জনগণের অদম্য মনোভাব। এই গুণ এদেশের মানুষকে যেকোনো প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলায় শক্তি জোগায়। এই প্রাণশক্তির জোরেই তারা টিকে আছে।
একের পর এক দেশ যখন অর্থনীতি ও সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছিল, উন্নত দেশগুলোর জনগণ তখন মহামারির কঠিন দিনগুলোতে টিকে থাকার জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রচুর নগদ অর্থ পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সেই বিলাসিতা করার ভাগ্য হয়নি।
হাতে যথেষ্ট নগদ অর্থ থাকায় অনেক পশ্চিমা দেশের মানুষ কোভিডকালে কাজে যেতে রাজি হয়নি। ফলে ওই দেশগুলো শ্রমিক সংকটে পড়েছে। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশের সব খাতের মানুষ রাতদিন কাজ করে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।
আরও একটা আশীর্বাদে পুষ্ট বাংলাদেশ—জনমিতিক লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড)। এদেশের জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশটাই তরুণ। মহামারিকালে তারা ইউরোপের প্রবীণ নাগরিকদের মতো ভঙ্গুর ছিল না।
উন্নত অর্থনীতিগুলো যখন বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিয়েও বয়স্ক নাগরিকদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছিল, সে সময় এদেশের ডাক্তার ও নার্সরা দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো নিয়ে নিজেদের সেরাটা দিয়ে লড়াই করছিলেন। আর তা সম্ভব হয়েছে দেশের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর কারণে।
কম মৃত্যুহারই মহামারির বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্যের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
১৭ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণে মারা গেছে ২৮ হাজারের কিছু বেশি মানুষ। অথচ যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি প্রতিটি দেশের জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম হলেও, প্রতিটি দেশ এক লাখের বেশি মৃত্যু দেখেছে। ২০২০ সালের প্রথম দিকে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে কোভিডে ২০ লাখ মানুষ মারা যাবে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক হিসাবে এদেশে মৃত্যুর সংখ্যা তারচেয়ে অনেক কম।
আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতিও ওই উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বেশি। আর হার-না-মানা মানসিকতার কারণে এদেশের মানুষ জীবিকার জন্য কখনোই ঝুঁকি নিতে পিছপা হয় না। এই মনোভাবই দু-দুটি শাটডাউনের পরও দেশের বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে সাহায্য করেছে।
ভাইরাস বা লকডাউনের ভয় আমাদের কৃষকদের উদ্যমকে দমাতে পারেনি। ১৭ কোটি মানুষের জন্য যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদন করে তারা খাদ্য ঘাটতির শঙ্কা দূর করেছেন।
অফিসে চাকরিজীবীরা শাটডাউনের সময় যখন ঘরে বসে কাজ করার সুবিধা ভোগ করেছে, কৃষকরা তখন তাদের ফসল ও জমির যত্ন নিয়েছেন। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে কাজে যোগ দিয়েছেন পোশাক শ্রমিকরা।
গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে রেকর্ড রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখেছে বাংলাদেশ। এটি সম্ভব করেছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে মাথা না নোয়ানো কয়েক লাখ আরএমজি শ্রমিক।
এই মানুষগুলো টিকার অপেক্ষায় বসে থাকেনি। মাস্ক না পরা কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ভুলে যাওয়ার জন্য এই মানুষগুলো প্রায়ই সমালোচনার শিকার হয়েছে।
এছাড়াও ছিল সেই মানুষগুলো, যারা স্বাস্থ্যঝুঁকির পরোয়া না করে মহামারিকালে আমাদের ঘরে পণ্য পৌঁছে দিয়েছে; সচল রেখেছেন সরবরাহ চেইন।
এই গায়ে খাটা কর্মীদের নিরলস সেবাই নতুন বছরে বাংলাদেশের পুনরুদ্ধারের আশা বাড়িয়েছে।
কয়েক হাজার মাইল দূরে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি তাদের কষ্টার্জিত আয় পাঠাচ্ছেন দেশে। এই প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফুলেফেঁপে উঠেছে, এই আয় বাহ্যিক ভারসাম্যকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু মহামারির মধ্যে বিদেশের কর্মক্ষেত্র থেকে দেশে ফেরা প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। বিদেশ থেকে ভাইরাস বয়ে আনার সন্দেহে প্রায়ই তাদের দেশে আসতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
তাদের কষ্টার্জিত অর্থের সুবাদেই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো কোনো দেশকে বৈদেশিক মুদ্রা ঋণ দিতে পেরেছে। শ্রীলঙ্কাকে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের 'কারেন্সি সোয়াপ' ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়াও মালদ্বীপ যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছিল, তাতেও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
বাংলাদেশিদের এই অদম্য মনোভাবের শিকড় প্রোথিত রয়েছে অর্ধশতাব্দী আগের মুক্তিসংগ্রামে বাংলাদেশের বিজয়ে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের ভাষ্যে, বাংলাদেশে এত এত উদ্যোক্তা গড়ে ওঠার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে এদেশের রক্তস্নাত জন্ম-ইতিহাস।
আরেক অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের ভাষায়, দেশের স্বাধীনতা 'একদল ভাগ্যবাদী মানসিকতার মানুষকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে।'
এসব অনুপ্রেরণার গল্পের পেছনে আছে বড় এক চালিকাশক্তি—নেতৃত্ব। প্রতিটি খাতে নেতৃত্বের এই দুর্বার চেতনা আমাদের করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়ার এবং এই ঘাতক ভাইরাসকে পরাভূত করার পথ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চে। এরপর তিন সপ্তাহ পেরোনোর আগেই প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। তারপর আরও কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সিংহভাগ ব্যবসা খাতই প্রণোদনার আওতায় এসেছে।
টিকার সংস্থান করা সহজ হয়নি। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো যখন শত শত কোটি ডোজ টিকার আগাম বুকিং দিচ্ছিল, তখন সময়মতো টিকা পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় বাড়ছিল বাংলাদেশে।
তবে সরকারের নীতিনির্ধারকরা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যেকোনো মূল্যে টিকা জোগাড়ের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তারা। জনসংখ্যার নির্দিষ্ট অংশকে টিকার আওতায় আনার জন্য তৈরি করেছেন সুচিন্তিত ভ্যাকসিন মাস্টারপ্ল্যান। টিকাপ্রদানে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একটি অ্যাপ বানিয়েছেন। সেই অ্যাপ টিকার জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়াকে সহজ ও নিশ্চিত করেছে।
শীর্ষ নেতৃত্বের সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে সফল টিকা-চুক্তিতে পৌঁছানোর ব্যাপারে সমকক্ষ অনেক দেশের চেয়েই এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে ভারত থেকে কোভিড টিকার সরবরাহও পেতে শুরু করেছিল। ভারত হঠাৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ঝটপট চীনের মতো বিকল্প উৎসগুলোর সন্ধানে নেমে পড়ে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়া থেকে নিয়মিত এসেছে উপহারের অথবা চুক্তির টিকা। এর ফলে সরকারের গণটিকাদান কর্মসূচিও চালিয়ে নেওয়া গেছে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
সরকার এখন চলতি বছরের এপ্রিলের মধ্যে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনার আশা করছে। সে লক্ষ্য পূরণে গত বছরের শুরু থেকে দক্ষতার সঙ্গে এই টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক।
বাংলাদেশ এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২১ কোটি ডোজ টিকা কিনেছে। এছাড়াও কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় ১১ কোটি ডোজ টিকা পাবে বলে আশা করছে। এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজের ৬ দশমিক ৮২ কোটির বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে—আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়া হয়েছে ৪ দশমিক ৫৬ কোটি।
এদিকে ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট মোকাবিলার জন্য বুস্টার ডোজ দেওয়ার কার্যক্রম ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। প্রথম ধাপে সম্মুখসারির কর্মী ও অন্তত ছয় মাস আগে টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া প্রবীণ নাগরিকদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
২০২০ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বাংলাদেশের পুনরুদ্ধারের গতি অনেকটাই নির্ভর করবে কত দ্রুত গণটিকাদান সম্পন্ন করা যায়, তার ওপর। এ পর্যন্ত টিকাদানে যে অগ্রগতি হয়েছে তার সুবাদে ব্লুমবার্গের 'কোভিড রেজিলিয়েন্স' র্যাঙ্কিংয়ে নভেম্বর মাসে ৫৩টি দেশের মধ্যে ১৮তম স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ। র্যাঙ্কিংয়ের এই অবস্থান কোভিডের অভিঘাত মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতারই প্রতিফলন।
এর আগে প্রকাশিত সর্বশেষ 'নিকেই কোভিড-১৯ রিকভারি' সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সবগুলো দেশকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। কোভিড থেকে পুনরুদ্ধারে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম।
এদিকে বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। সদ্য বিদায় নেওয়া বছরের শেষদিকের দুই দিন তো কোভিডে কোনো মৃত্যুও দেখেনি বাংলাদেশ। অবশ্য করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বেশ কয়েকটি কেস শনাক্ত হয়েছে দেশে। এই ধরনের কারণে ইউরোপের কিছু অঞ্চলে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। তবে নতুন এই ধরন এখনও এদেশে বড় হুমকি হয়ে দেখা দেয়নি।
ওমিক্রনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে টিকাদান অভিযান কীভাবে চালানো হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়। নতুন কোনো লকডাউনের ভার বাংলাদেশ আর বইতে পারবে না।
টিকা-হতাশা নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২১ সাল। নতুন বছর শুরু হলো পূর্ণডোজ টিকাদানের আশা নিয়ে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গতি আনতে সাহায্য করার জন্য বেশ কিছু অর্থ ও মুদ্রানীতি নেওয়া হয়েছে। সেসবের মধ্যে আছে এক ট্রিলিয়নেরও বেশি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ, ঋণ স্থগিতকরণ, করছাড়। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ যারা হারিয়েছে, তাদের নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে—যদিও টাকার পরিমাণ যথেষ্ট ছিল না।
এসব সহায়তা-পদক্ষেপ কাজে দিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে—সে প্রতিফলন দেখা গেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পূর্বাভাসে।
বড় দুই ফসল বোরো ও আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। যা স্থানীয় সরবরাহ থেকে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আমদানি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে আমদানি বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এ সময় প্রায় দুই বছরে প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এসবই আগামী মাসগুলোতে উৎপাদন কার্যক্রম বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
এসব কারণেই নতুন বছর নিয়ে আশাবাদী হওয়া যায়। ২০২৬ সালের মধ্যে মসৃণভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ এবং তারপর ধীরে ধীরে উচ্চ-মধ্যম আয়ের ও উন্নত দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার আশা এদেশের মানুষ কখনোই ছাড়বে না। এই কাজে সফলতা আসবেই, কারণ স্বপ্নপূরণের এই দুর্নিবার আশাই আমাদের বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি।
- লেখাটি ইংরেজিতে পড়ুন- In praise of people and leadership