৩৪ উপাচার্যের একযোগে পদত্যাগের হুমকি, এর সমকক্ষ ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে নেই!
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মরণপণ আন্দোলনের বিরোধিতা করে দেশের ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হুমকি দিয়েছেন যে, শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ যদি পদত্যাগ করেন তবে তারাও পদত্যাগে 'ইচ্ছুক'। এই ইচ্ছে প্রকাশিত এবং আলোচিত হয়েছে যেই ফোরামে তার নাম আমাদের অজ্ঞাত, কিন্ত সেই ফোরামের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আমাদের অবোধ্য নয়। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসেই কেবল নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে তো অবশ্যই এমনকি গোটা বিশ্বের ইতিহাসের কোথাও এর সমকক্ষ কোনও ঘটনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা গিনি'স বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে খবরাদি পাঠান তারা এই খবরটি পৌঁছে দিতে পারেন। এই উপাচার্যদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও আছেন কিনা জানি না। কিন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করেছেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তার প্রতি এই অকুণ্ঠ সমর্থন ঐ বক্তব্যেরও সমর্থন। শুধু তার ক্ষেত্রেই নয়, বাকি ৩৩ জন উপাচার্যের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশের জনগণের অর্থে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা মনে করেন যে, নারী শিক্ষার্থীদের এই অবমাননা গ্রহণযোগ্য, সমর্থনযোগ্য এবং সেই জন্যে তারা তাদের পদকে বাজি রাখতে পারেন। এই অবমাননা কোনও ব্যক্তিকে করা হয়নি, নারী সমাজের জন্যে এরচেয়ে বড় ধরনের অবমাননা আর কী হতে পারে?
কিন্ত এটি হচ্ছে বর্তমান অবস্থার একটি মাত্র দিক। উপাচার্যদের এই সম্মিলিত অবস্থানের আরও দুটি দিক আছে। প্রথমত এ থেকে বোঝা যাচ্ছে তারা আর কোনও ধরনের স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করেন না। একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কী করবেন, তার শিক্ষার্থীরা কী করবেন সেটা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বলতে পারেন না বলেই আমার ধারণা। এই ধরনের অবস্থান নিয়ে তারা জানান দিলেন যে, তাদের একটি 'ফোরাম' আছে এবং সেখানের অনুমোদন নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য আছেন, তিনি চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারেন। কিন্ত উপাচার্যদের এই 'হুমকি'র মাধ্যমে প্রকারান্তরে কি তার পথ বন্ধ করা হল? যদি এখন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ উপাচার্য পদত্যাগ করতে চান তার পদত্যাগপত্র কী আচার্য গ্রহণ করতে পারবেন? তাকে কি বাকিদের জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, এই পদত্যাগপত্র গৃহীত হলে তারাও পদ ত্যাগ করবে কিনা। ভবিষ্যতে কী অন্য উপাচার্যদের এই ফোরামে এসে বলতে হবে আগে? দ্বিতীয় দিকটি হচ্ছে এই উপাচার্যরা জানিয়ে দিলেন যে, তারা জবাবদিহিতে বিশ্বাস করেন না। যে বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের অর্থে তার সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্বে যিনি আছেন, যাকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি, তার আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের জবাবদিহি করা যাবে না? এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে কি জবাবদিহির পাঠদান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? নাকি আগামীতে বন্ধ করে দেবার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।
এইসব আলোচনা একার্থে অর্থহীন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলীয়করণের পরিণতি এই হবার কথা। আগে শিক্ষকরা এককভাবে এবং শিক্ষক সমিতিগুলো সংগঠন হিসেবে দলের হয়ে কাজ করত। উপচার্যরা আলাদাভাবে দল করতেন। কতটা করতেন তার একটা উদাহরণ হচ্ছে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যুবলীগের প্রধান হবার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন। উপাচার্যের চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনের প্রধান হওয়া 'মর্যাদার' বিষয় বিবেচনা করা ব্যক্তিরাই তো উপাচার্য হন। এইবার সকল উপাচার্য মিলেই দল করলেন কিংবা দলের হয়ে কাজ করলেন। এই ঘটনাকে ইতিহাস বলেই বিবেচনা করতে হবে।
এই সংকটকালে, শিক্ষার্থীরা যখন আমরণ অনশনে সেই সময়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বড় অংশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্ত ভয়াবহ ব্যাপার মনে হয়েছে একটি বিবৃতি পাঠ করে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গত শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে (প্রথম আলো, জানুয়ারি ২২, ২০২২)। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের সংগঠন কার্যত শিক্ষার্থীদের হুমকি দিচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করবে বলে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন কোথায়? কিন্তু এই বিবৃতি কেবল যে শিক্ষকদের মন–মানসিকতা বোঝায় তা নয়, বোঝায় রাষ্ট্রের চরিত্রও। সেটা যেন আমাদের নজর এড়িয়ে না যায়।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট
[লেখাটি আলী রীয়াজের ফেসবুক থেকে নেওয়া]