৩৪ উপাচার্যের সংহতি জ্ঞাপনের ধরন অনেকটা ট্রেড ইউনিয়নের মতোই
স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো উপাচার্য অপসারণের দাবি উত্থাপিত হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী মানুষ ছিলেন তিনি। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে কতজন উপাচার্য অপসরণের দাবি তুলেছে ছাত্ররা তার গবেষণা হওয়া দরকার। তবে ধারণা করা হয়, সবচেয়ে বেশি উপাচার্য অপসারণের দাবি উত্থাপিত হয়েছে গত ১২ বছরে।
উপাচার্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। '৯১ এর পর দলীয় আনুগত্যের এই ধারা যোগ্যতা নিরূপনের মাপকাঠিতে পরিণত হয়েছে। উন্নত বিশ্বের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন রয়েছে। আমাদের মতো দেশের সাংবিধানিক ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যক্তির প্রয়োজন হয় না এক্ষেত্রে।
তবে ভারতীয় উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এই উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমে কোন বড় ধরনের মিল নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েশন কোর্স চার বছরের। কিন্তু ভারতে গ্রাজুয়েশন কোর্স তিন বছরের; সঙ্গে দুই বছরের মাস্টার্স। ভারতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা তিন শতাধিক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এক্ষেত্রে ১০০ অতিক্রম করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকানা খুঁজতে গেলে দেখা যাবে এরাও রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে তুলেছেন। এদের সবারই রয়েছে দলীয় আনুগত্য।
দুই সপ্তাহ ধরে চলা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাপ্রবাহ আমরা সবাই লক্ষ্য করছি। প্রভোস্ট বিতাড়নের আন্দোলন শেষমেশ ভিসি অপসারণ আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়া। আন্দোলন প্রতিহত করতে প্রথমে রাজনৈতিক শক্তির ব্যবহার এবং পরবর্তীতে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে উগ্র বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর টিয়ার সেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলিবর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। এই একই ধরনের ঘটনা গত ১০ বছরে দেশের নানা প্রান্তের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঘটেছে।
আমরা জানি, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, আমরা দেখেছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের আন্দোলন। এছাড়া, নোয়াখালির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে ছাত্রদের আন্দোলন। একইভাবে গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল ছাত্র আন্দোলনের পিছনে শিক্ষকদের রাজনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
এবারও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একই চিত্র দেখলাম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি গতরাতে ছাত্র ছাত্রীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে চার দফার দিকনির্দেশনা তৈরি করেছেন, তা প্রকারান্তে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অপসারণের দাবি সমর্থন করে। এমন ঘটনা প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের সময় শিক্ষকদের দৌড়ঝাঁপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। নিজেদের 'যোগ্যতার' তালিকা তৈরি করে বিভিন্নজনের কাছে বিতরণ করতেও দেখা যায় তাদেরকে।
ইতোমধ্যে সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সরকার মনে করে, উপাচার্য পদটি অনেক বেশি প্রশাসনিক। সেকারণে একাডেমিক যোগ্যতার পাশাপাশি সাংগঠনিক যোগ্যতাকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক দক্ষতার মাপকাঠি হিসেবে শিক্ষক রাজনীতির দক্ষতা ও আনুগত্য সামনে চলে আসে। উপাচার্য নিয়োগের যোগ্যতার এই মাপকাঠি অনেক ক্ষেত্রে বুমেরাং হয়ে ফেরত আসছে এবং সরকারকেই এর দায়ভার বহন করতে হচ্ছে।
এছাড়া, উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাপযুক্ত নীতিমালার ঘাটতি রয়েছে। কেবলমাত্র দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যগণ জানিয়েছেন, শাহজালালের উপাচার্য পদত্যাগ করলে প্রতিবাদে তারাও পদত্যাগ করবেন। এই ৩৪ জনের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রয়েছেন কি না তা আলাদাভাবে জানা যায়নি।
শাহজালালের উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে যে কূরুচিকর মন্তব্য করেছেন তার পরও জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি সংহতি জানিয়ে পদ্যত্যাগ করতে চান কিনা তা দেখার আগ্রহ রইল। এই ৩৪ উপাচার্যের সংহতি জ্ঞাপনের ধরন অনেকটা ট্রেড ইউনিয়নের মত।
ভিসিদের কোনো সিন্ডিকেট গড়ে উঠেনি তো? এই প্রশ্ন এখন অনেকের।
অন্যদিকে উপাচার্যের পরিবারও অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। উপাচার্যের বাসভবনের বিদ্যুৎ বিছিন্ন করা হয়েছে। এখন আর শান্তিপূর্ণ মীমাংসার সূত্র কোনো নেতা- নেত্রীর হাতে রয়েছে বলে মনে হয় না। কেন সিদ্ধান্ত নিতে এতো বিলম্ব? বিষবৃক্ষ যতদ্রুত উপড়ে ফেলা যায়, সমাজের জন্য তত মঙ্গল।
দলীয় রাজনীতির বলি আমাদের শিক্ষাঙ্গণ। একে রক্ষা করুন। দানবে পরিনত হওয়া প্রশাসক ঝেটিয়ে দুর করুন। মানুষের মনের ভাষা বুঝার চেষ্টা করুন। মানবিক হউন। শিক্ষাঙ্গণগুলোতে হাজারো সম্ভাবনাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন।