ইসি গঠনের খসড়া তালিকার ভুল কি ইচ্ছাকৃত?
২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর পর দুই জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে বিতর্ক চলছে, সেই বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একাধিক পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে সরকার। যেমন ৫০ বছর যাবৎ নির্বাচন কমিশন আইন ছিল না, সেই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে দ্রুততম সময়ে।
যদিও নির্বাচন কমিশনের সময়কাল শেষে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসলে সরকার শুরুতে আইন প্রণয়ন নিয়ে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবেচনায় আগামী নির্বাচনকে একটি সংবেদনশীল নির্বাচন হিসেবেই দেখছে বর্তমান সরকার। নির্বাচন নিয়ে যেন আবার কোনো নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি না হয় সেজন্যই শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে সংসদে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন পাস করা হয়েছে।
ভবিষ্যতে যেন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সম্ভবত সে কারণে এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খানিকটা স্বতন্ত্রতা দেখা গেছে। বেশকিছু ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন বিতর্ক ছাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনের সাথে তুলনা করলে সরকার অন্তত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের দিকে মনোযোগী ছিল। দলীয় প্রার্থীদের বিপক্ষে দলের সমর্থকদের অনেকে বিরোধী হিসেবে নির্বাচন করেছে।
প্রথমে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, দলের পক্ষ থেকে দলের বিপক্ষে যারা ভোটে দাঁড়াবেন, তাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। কিন্তু আপাতত তা দেখা যাচ্ছে না। যারা বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেয়ে নির্বাচন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আপাতত বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
সবকিছু মিলিয়ে সরকার যখন একটি জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন আগামী দিনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে সরকারের আমলাতন্ত্র যোগ্যতার(!) এক অসাধারণ প্রমাণ দিয়েছে।
আইন প্রণয়নের পর থেকেই নানা সমালোচনা ছিল। সার্চ কমিটির অনেকের অংশগ্রহণও প্রশ্নবিদ্ধ। তারা আসলে সার্চ কমিটির অংশ হতে পারেন কি না, এমন আইনি প্রশ্ন কেউ কেউ তুলে ধরেছেন। তারপরেও যে মারাত্মক ভুল এই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ করেছে, তা হলো অন্তত ৭ জন ব্যক্তির নাম দুইবার উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম সুপরিচিত নাম অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমেদ মানিক। অতীতে তার অনেক বিচারের আদেশ বিচার বিভাগকে আমলাতন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ফেসবুক পেইজেও ভুলবশত প্রশ্নপত্র প্রকাশ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এমনি সব আমলাতন্ত্র দিয়ে দেশ চলছে। এই মারাত্মক ভুলের আমলাতন্ত্র দ্বারাই দেশের উন্নয়ন পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিনই পত্রিকায় দেশের নানান প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা আমলাতন্ত্রের নানান দুর্নীতির ইতিহাস প্রকাশিত হচ্ছে। এই আমলাতন্ত্র দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসন পরিচালনা করছে। তাদেরই সর্বোচ্চ পর্যায়ের অফিস থেকে এই ধরনের মারাত্মক ভুলের ব্যাখ্যা কি হতে পারে? তবে সন্দেহ জাগে, তারা আসলেই ইচ্ছাকৃতভাবে এই ঘটনা সংঘটিত করেছে কি না?
কোনো কোনো নাম যেমন একাধিকবার প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি সার্চ কমিটির পক্ষ থেকে যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে তাদের এ বিষয়ে সম্মতি আছে কি না তাও জানা জরুরি। নাম প্রকাশের পর অনেকে সরাসরি বলছেন যে, আমাদের সাথে কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি, আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানি না। তারপরও আমাদের নাম কিভাবে প্রকাশ করা হল? অদ্ভুত ব্যবস্থা, এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
আমলাতন্ত্র যদিও সরকারের সমর্থক হিসেবে নিজেদের নানানভাবে তুলে ধরছেন, তারপরও আমলাতন্ত্রের এই কার্যক্রমকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুততম সময়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই এই মারাত্মক ভুল দেশের কাছে এক উদাহরণ হয়ে রয়ে গেল।
দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের নানান বিষয়ে বিতর্কে অংশ নেওয়া মানুষজনদের নাম এই তালিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ব্যাপক পরিচিত মুখের মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজ্ঞ শাহদীন মালিকের নামও আছে। তিনি ছাড়া তালিকায় নাম থাকা আরও বেশ কয়েকজন সুপরিচিত ব্যক্তি সরাসরি বলেছেন, কেউ তাদের মতামতের ভিত্তিতে এই নাম প্রস্তাব করেনি। কিংবা তাদেরকে কেউ প্রস্তাবিত নামের বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।
সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রথমদিকে আইন প্রণয়নের কথা বললেও পরবর্তীতে এই আইন প্রণয়নের বিযয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এই ঘটনাটির তাদের জন্য বিরোধিতা করার সুযোগ এনে দিয়েছে। দেশের আমলাতন্ত্র যে মারাত্মক একটি ঘটনা ঘটিয়েছে তা বাংলাদেশের সামগ্রিক সক্ষমতার জায়গা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। জাতীয় আয়ের হিসাব বছর বছর প্রকাশিত হয়, আমলাতন্ত্রের হাত ধরে। জাতীয় আয়ের বিতর্ক এই বিতর্ককে আরও শক্তিশালী করল। আমলাতন্ত্রের হাত ধরেই মেগা প্রজেক্টের ব্যয়ের পরিমাণ দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে চলছে। এ সবকিছুর দায়ভার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ওপর বর্তায়। এগুলো কি ভুল, না কি ইচ্ছাকৃত ভাবে করা?
সার্চ কমিটি যাদের দ্বারা গঠিত হয়েছে, তাদের অনেকের নামই দেশের কাছে নানান ভাবে পরিচিত। এই ভুলের পরিণাম সেই নামসমূহের সুনামকে সংকুচিত করেছে। এমনিতেই বিগত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জাতির সামগ্রিক আস্থা শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেছে প্রায়।
আমলাতন্ত্র দেশের সর্বস্তরে বিরাজমান। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে যারা নির্বাচিত প্রতিনিধি তাদের ওপর কর্তৃত্ব আমলাতন্ত্রের। সারাদেশে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত পরিষদের ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, এখানকার কর্তৃত্ব আমলাতন্ত্র থেকে মনোনয়ন পাওয়া ইউএনও, জেলা প্রশাসক অথবা জেলা পরিষদের নিবার্হী কর্মকর্তার হাতে। এরকম প্রচুর অভিযোগ প্রতিনিয়ত পত্রিকায় উঠে আসে। সেখানে যদিও অনেক উপজেলা বা জেলা চেয়ারম্যানের যোগ্যতা, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন সামনে আসে তথাপি সংবিধান স্বীকৃত এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের ক্ষমতা কখনোই সঠিকভাবে পালন করতে পারে না।
আবার বর্তমানে অনেকগুলো জেলা পরিষদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেখানেও এই আমলাতন্ত্রকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এই আমলাতন্ত্রের দ্বারা এসব ত্রুটি ইচ্ছাকৃত কি না অর্থাৎ সার্চ কমিটিকে একটি হাস্যকর কমিটিতে রূপান্তরিত করার কোনো উদ্দেশ্যপ্রণীত ঘটনা ঘটেছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।