আসলে ‘ম্যাজিকটি’ কোথায়?
শ্রীলংকা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। অনেকে শ্রীলংকার সাথে আমাদের অর্থনীতির মিল খুঁজে পাচ্ছেন এবং আমাদেরও একই দশা হতে পারে ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন। অন্যদিকে সরকার পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই, আমাদের অর্থনীতির ভিত অনেক মজবুত। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, দুশ্চিন্তা অমূলক। আমাদের প্রবাসী আয়, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, আমাদের জিডিপি এবং তার প্রবৃদ্ধি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়াও মানবিক ও সামাজিক বিভিন্ন সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা প্রমাণ করে- আমরা শ্রীলংকা হবো না। কিন্তু তারপরও আলোচনা থেমে নেই।
কেন শ্রীলংকা প্রসঙ্গ বারবার ফিরে আসে? গতকালও অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বিলাসদ্রব্য আমদানি কমাতে হবে। অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল, উন্নয়ন উপকরণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা গেলেও বিলাসদ্রব্যে নিরুৎসাহিত করেছেন। যদিও বিলাস দ্রব্যের তালিকা এখনো প্রকাশিত হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে সাধারণ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ এলসি মার্জিনের নিয়ম চালু করেছে। এই বিলাসদ্রব্যের ভোক্তাদের জন্য উচ্চ মার্জিন কোন কঠিন সমস্যা নয় তবে বিলাসদ্রব্যের মধ্যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ি পড়ছে কিনা তা নিশ্চিত করা হয়নি। আমাদের অর্থনীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর এটা কী সাধারণ কোন ভাবনা নাকি কোন বাড়তি সতর্কতা? বেসরকারিভাবে বিলাসদ্রব্য আমদানির অর্থ, বাজারে তার চাহিদা রয়েছে এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। এটা বরং অর্থনীতির ভালো প্রবণতা। আমরা অনুমান করতে পারি, অর্থমন্ত্রী সরকারি পর্যায়ে বিলাসদ্রব্য আমদানি প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন কি না?
২০০৬ সালের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর হতে শ্রীলংকার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। করোনা মহামারির শুরুতেও ওদের অর্থনীতির আকার আমাদের চেয়ে বড়। ২০১৯ সালে তাদের মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৮০০ ডলারের উপর। ২০১৯ সালে তারা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও উন্নীত হয়েছিল। এর পরের বছর হতেই অবনমন শুরু হয়। শ্রীলংকার রপ্তানি পণ্য প্রধানত তিনটি: তৈরি পোশাক, চা ও রাবার। অভ্যন্তরীণভাবে কৃষি ও পর্যটন। করোনায় ধস নামে পর্যটন শিল্পে। কিন্তু কৃষির জন্য দায়ী তাদের উচ্চভিলাসী (!) অরগানিক কৃষি প্রবর্তনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কর্তৃত্ববাদী শাসনের পরিণতি কী হতে পারে তার উদাহরণ আজকের শ্রীলংকা।
বিশ্বব্যাংকের 'আন্তর্জাতিক ঋণ প্রবাহ (আইডিএস) বিশেষ প্রতিবেদন ২০২২' অনুযায়ী বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের স্থিতি ৪ হাজার ৯৪৫ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। ৮৫ টাকা দরে গুণীতক এবং ১৬ কোটি মানুষ ভাগ দিলে সহজেই মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বের হয়ে আসে। যা টাকার অঙ্কে ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মানুষের ঘাড়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকার ঋণ।
আমাদের অর্থমন্ত্রণালয়ের ইআরডি বিভাগের 'ফ্লো অব এক্সটার্নাল রির্সোসেস ইনটু বাংলাদেশ' ২০১৯-২০ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৪১০ কোটি মার্কিন ডলার উল্লেখ করা হয়েছে। ঐ একই নিয়মে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ২৩৪২৫ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৮ মাসেই মাথাপিছু ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণ ১৪৬৫ টাকা। গত ১০ বছরে মাথাপিছু ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৬ গুণ। যদিও বিশ্লেষকরা এটাকে খারাপ হিসেবে দেখছেন না।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মানদন্ড অনুযায়ী কোন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির আকারের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণকে নিরাপদ মনে করা হয়। সে তুলনায় বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ শতাংশের হারে অনেক নিচের দিকে। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত 'সেফ জোনে' অবস্থান করছে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড নিয়ে অর্থনীতিবিদদের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। তাদের মতে জিডিপির ৪০ শতাংশ পরিমাণ ঋণ গ্রহণ ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ যখন দেশে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে কোন প্রশ্ন থাকে না। দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ও জনকল্যাণে দেশ পরিচালিত হয়। দুর্নীতির প্রশ্নে সবক্ষেত্রে শূন্য সহনশীল অবস্থান থাকে, তখন বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ নিয়ে সংশয় থাকে না বরং অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়। এই ঘরানার অর্থনীতিবিদরা গণতন্ত্রকে শর্ত হিসেবে যুক্ত করেন নি। তার কারণ, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের কথা চিন্তা করে। এই দেশগুলোতে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র না থাকা সত্ত্বেও অর্থনীতির বিকাশ থেমে নেই।
সংশয় হলো, আমাদের মতো দেশগুলোকে নিয়ে। উপরের শর্তগুলো থেকে আমাদের অবস্থান অনেক দূরে। সুশাসনের ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, স্বজনতোষণ, দলবাজি, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিকতা, দীর্ঘসূত্রিতা, বিচার না হওয়ার চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয় প্রতিনিয়ত। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম করতে হয় তখন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের মানদণ্ড অনুযায়ী ৪০ শতাংশ ঋণ দূরে থাক, ২০ শতাংশ পরিমাণ ঋণও গলার কাঁটা হতে পারে।
তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমাদের সুশাসন পরিস্থিতি সব ধরনের বৈশ্বিক সূচকে পিছিয়ে। ব্যবসা পরিচালন পরিস্থিতির উন্নয়ন উল্লেখ করার মতো নয়। ঘুষ ছাড়া কোন কাজ হয় না। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা। প্রতিকার চেয়েও বিচার না পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের উন্নয়ন সারা বিশ্বে বিস্ময়কর উদাহরণ। উচ্চমাত্রার দুর্নীতি ও কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক- অর্থনীতির এই তত্ত্ব এখানে কাজে আসেনি। বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা বা শাসনব্যবস্থার কোন উন্নয়ন/ সংস্কার ছাড়াও এখানকার প্রবৃদ্ধি গবেষকদের বিস্মিত করেছে। আসলে 'ম্যাজিকটি' কোথায়?
অর্থনীতিবিদরা একটা সমাধান সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। গবেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ভৌগলিক ও সামাজিক অবস্থান অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। খুব ছোট আয়তনের এই দেশের ভূপ্রকৃতি প্রায় একই ধরনের। এখানে জাতিগত, সম্প্রদায়গত, ভাষাগত ও বর্ণভেদ তেমন তীব্র বা সংঘাতমূলক নয়। যে কোন ধরনের চিন্তা বা উদ্ভাবন দ্রুত সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
এছাড়াও দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রভূত উন্নয়ন করেছে। দুর্যোগ সতর্কীকরণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। এবারের করোনা মোকাবেলায় রোগ প্রতিরোধ ও রোগী ব্যবস্থাপনায় সফলতা দেখিয়েছে। এসবই বাংলাদেশের উন্নয়ন 'ধাঁধাঁর' একেকটি মীমাংসাসূত্র। (যদিও টিআইবি তার সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে করোনা টিকা ক্রয় ও প্রয়োগ কর্মসূচীতে বড় ধরনের আর্থিক অব্যবস্থাপনার প্রমাণ পেয়েছে)
তবে অর্থনীতিবিদরা এই বলে সতর্ক করছেন, এই ধরনের উন্নয়ন টেকসই নয়। অর্থনীতির শক্ত ভিত দিতে হলে অবশ্যই দেশের সরকার ব্যবস্থা, সুশাসন পরিস্থিতি, জন অংশগ্রহণ, জবাবদিহিমূলক প্রশাসনব্যবস্থা, স্বচ্ছতা ও বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথেই দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন মিলিয়ে নিতে হবে। তবেই দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের দিকে এগোবে।