শিশুরা খেলার মাঠ চাইবে না কি থানা চাইবে?
রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার অন্যতম আন্দোলনকারী সৈয়দা রত্না ও তার ১৭ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ ঈসা আবদুল্লাহকে গতকাল (২৪ এপ্রিল) আটক করেছিল পুলিশ। মা-ছেলের অপরাধ, তারা এলাকার একমাত্র খেলার মাঠটিকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৭ নং ওয়ার্ডের তেঁতুলতলার এই মাঠটি দীর্ঘদিন ধরেই শিশুদের খেলার মাঠ হিসেবে এবং জানাজার মতো অন্যান্য সামাজিক কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। অথচ এখন এই জায়গার ওপর থেকে শিশুদের অধিকার খর্ব করে থানা কমপ্লেক্স বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে সৈয়দা রত্না ও তার নাবালক ছেলে প্রতিবাদ জানালে তাদের তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কেনো? তারা কি এটা বলতে পারতো না যে, এটি বিকল্প কোনো জায়গায় হতে পারে? সেটি না করে কেনো এই তুলে নিয়ে আসার সংস্কৃতি তারা আবারও চালু রাখলো?
আজ আমি শুধু দেশের একজন নাগরিক হিসেবে নয়, একজন নারী হিসেবে কথা বলছি। এই রোজার মাসে একজন নারী রোজা রেখেছেন, রোজা রাখা অবস্থায়ই তাকে তুলে এনে হাজতে রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে তার ছেলে মোহাম্মদ ঈসা আবদুল্লাহ, যার বয়স এখনও আঠারোই হয়নি তাকেও ধরে নিয়ে হাজতে ঢোকানে হয়েছে। এমন একটি বাচ্চা ছেলে মাঠ চাইবে না তো কি থানা চাইবে? এটা কি কখনও হতে পারে? আমরা কি কখনও একটি অসভ্য সমাজের কথা ভাবি? আমাদের কি কেবল থানা হলেই চলবে? খেলার মাঠের প্রয়োজন নেই?
মাঠটিতে যে শুধু বাচ্চারা খেলাই করে এমনটি নয়। এখানে ঈদের নামাজ হয়, ঈদগাঁহ হিসেবে মাঠটি ব্যবহার করা হয়, ওই এলাকার কেউ মারা গেলে ওই মাঠেই গোসল করানো হয়, জানাজা পড়ানো হয়। আর এটি তো আইনে একেবারে সুস্পষ্টভাবেই বলা আছে, এইরকম প্রথাগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বাধা সৃষ্টি করা যাবে না।
তাহলে কেনো তাদের তুলে নিয়ে এসে এভাবে থানা-হাজতে আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হলো? পুলিশ যদি আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় আমরা কি তাদের সঙ্গে কথা বলবো না? একটা সময় দেখতাম ভূমিদস্যুরা এ ধরনের কাজ করতো। এখন কি আমরা এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে আশা করতে পারি?
রত্না আপা ও তার ছেলেকে ধরে নেওয়ার পর রাতে আমরা থানায় গিয়েছিলাম। আমরা তাদেরকে (পুলিশ) অনুরোধ করেছিলাম যেনো রত্না আপা কোথায় আছেন, তার সঙ্গে আমাদের একটু দেখা করতে দেওয়া হয়। ওনার মানসিক অবস্থাও তো আমরা জানিনা।
আমরা যখন একটি সৎ কাজের জন্য প্রতিবাদ করি তখন আমরা কখনই আশঙ্কা করি না যে, আমাদেরকে তুলে নিয়ে আসা হবে এবং আটকে রাখা হবে। ফলে প্রতিবাদের সময় আমাদের মানসিক শক্তি থাকে অন্যরকম। কিন্তু নাগরিকদের মানসিক শক্তি ভেঙে দিয়ে কি দেশের আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব? এটি কোনোদিন হতে পারে?
যে দেশের নাগরিক যত বেশি শক্তিশালী, সে দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও ততটাই শক্তিশালী হবে। নাগরিকদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়া কিন্তু বুদ্ধিমানের কাজ নয়। রত্না আপা এবং তার ছেলে ঈসা আব্দুল্লাহ কোনো অপরাধ করেনি, তারা প্রতিবাদ করেছেন। গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদ করা প্রত্যেক নাগরিকের সংবিধানিক ও আইনসম্মত অধিকার। তারপরেও ওনারা থানা নিয়ে কথা বলবেন আমাদের সঙ্গে। কিন্তু আমাদের মাঠে যেন ওনাদের থানা না করেন, এটিই আমরা চাই। এটা কোনোদিন হতে পারে না। মাঠের মধ্যে কখনই থানা হতে পারে না।
জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পুলিশ রত্না আপা ও তার ছেলেকে যেভাবে ছেড়ে দিয়েছে, তেমনি ওই মাঠে থানা ভবন নির্মাণ থেকে পুলিশ সরে আসবে বলে আমি আশা করছি। ওই এলাকায় শিশুদের জন্য খেলার মাঠ একটিই। বিকল্প মাঠের সন্ধান না দিলে সেখানে থানা ভবন নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। এজন্য আন্দোলন চলবে।
- সৈয়দা রত্না ও তার ছেলের মুক্তি চেয়ে মানবাধিকার কর্মীদের বিক্ষোভকালীন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ (বেলা) সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সাংবাদিকদের দেওয়া বক্তব্য থেকে সংগৃহীত।