পুলিশ লাঠিচর্চা বোঝে, মানুষের দীর্ঘশ্বাস বোঝে না!
কোথায় যাবে খেলতে?
দুটি ডানা মেলতে
কোথায় যাবে উড়তে
হাত পা একটু ছুঁড়তে
খোলার মাঠে বাড়ি
খেলার সঙ্গে আড়ি
-কবির সুমন
ঢাকার কলাবাগান মাঠ নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা জানলে জনপ্রিয় জীবনবাদী গায়ক কবির সুমন হয়তো লিখতেন- খেলার মাঠে থানা/কিচ্ছু বলা মানা/ প্রতিবাদটা 'পাপ'/ ছেলের জন্য 'লকআপ'! কলাবাগান মাঠ নিয়ে যা হলো তাতে এরচেয়ে বলার আর কিছু নেই। যিনি বলবেন তাকে সেই মা'র (সৈয়দা রত্না) মতো মুচলেকা দিতে হবে- ভুল হয়েছে, এমন আর হবে না!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন-কোন খেলার মাঠে স্থাপনা গড়া যাবে না! যে দেশে প্রধানমন্ত্রীর কথা রাখে না পুলিশ, সে দেশে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুচলেকা দিতে হয়! যে পুত্র সামনে এসএসসি পরীক্ষা দেবে তার পরীক্ষার পড়া মনে না থাকলেও মনে থাকবে পুলিশ একদিন তাকে টেনেহিঁচড়ে তাদের গাড়িতে তুলেছিল। থানার লকআপ নামের দোযখে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল ১২ ঘন্টার ওপর! কিছু কিছু দুঃস্বপ্ন থাকে যা মানুষকে আজীবন তাড়া করে ফেরে। হিন্দি বা বাংলা ছবির বাস্তবতার মতো এই বাস্তবতা থেকে বের হওয়া কঠিন!
ঢাকার বিখ্যাত স্কয়ার হাসপাতালের ঠিক উল্টো দিকের গলিতে একটা মাঠের মতো আছে যেখানে ঘাস বা মাঠের সৌন্দর্য না থাকলেও সব শ্রেণির শিশু-কিশোররা খেলতো। এলাকার প্রবীণদের এখানে হাঁটতেও দেখা যেত। পাড়ার কেউ মারা গেলে মাইকিং হতো, জানাজাও হতো এই মাঠে। এই মাঠে ঈদের জামাতও হয়েছে অনেকবার। এলাকার মানুষেরা এটাকে তেঁতুলতলা মাঠ বলতো। কেন এই নামকরণ করা হয়েছিল কেউ হয়তো স্পষ্ট জানে না। কলাবাগানে একদা হয়তো হাতি ও মানুষের খাদ্যের জন্য প্রচুর কলাগাছ লাগানো হতো, তেমনি এই মাঠের কোথাও হয়তো তেঁতুল গাছ ছিল কখনো! এখনও এই মাঠে রেইনট্রি ও মেহগনি গাছ আছে, আছে ময়লা ফেলার ভাগাড় বা ডাস্টবিন! জানাজা হতো বিধায় এখানে মৃতদেহ গোসলের ঘরও আছে! এই মাঠটাতে থানার স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য চোখ পড়ে পুলিশের। জেলা প্রশাসন সেভাবে নোটিশ জারি করে। তারা ঘোষণা দেয় এটা সিটি কর্পোরেশন চিহ্নিত কোন খেলার মাঠ বা পার্ক নয়। তাই এখানেই থানা হবে। ২০২০ সাল থেকেই চেষ্টা চলতে থাকে তাদের। এই মাঠ খালি করে দেয়া ও এখানে হাঁটা বা খেলাধুলা করতে মানা করতে থাকে পুলিশ। স্থানীয় একাধিক সূত্রের মতে, তেঁতুলতলা মাঠ যাদের ছিল স্বাধীনতার পর তারা আর ফিরে আসেন নি। পরিত্যক্ত এই জায়গাতে শিশুদের খেলার অভ্যাস, হাঁটার জায়গা বা জানাজা পড়ানোর ট্রেইন্ড তৈরি হয়। গড়ে ওঠে মৃতদেহ গোসলের জায়গা, চলে আসে শহরের ক্ষত ডাস্টবিন। সবশেষে আসে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের নোটিশ।
পুলিশের এই আচরণে প্রতিবাদ জানান অনেকেই। গত ২০২২ এর ৩১ জানুয়ারি এই মাঠে ঘটা একটা ঘটনা ভাইরাল হয়। শিশু-কিশোরেরা সেদিন প্রতিবাদ করে, পুলিশের নির্দেশ সত্ত্বেও খেলা থামায় নি। তাই সন্ধ্যার পর পুলিশ ধরে আনে কয়েকজন শিশু-কিশোরকে, কান ধরে উঠবস করানো হয় তাদের। এই কান ধরে উঠবস করানোর ঘটনা ভাইরাল হলে ঘটনার সাথে জড়িত সাব ইন্সপেক্টর নয়ন ও তিন কনস্টেবলকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এই ঘটনার পর পুলিশ ছিল খানিকটা নীরব। তবে খুব নীরবে তারা এই তেঁতুলতলা মাঠের চারদিকে তারকাঁটার বেষ্টনী দেয় যেন কলাবাগানের ভেতরের কোন ছিটমহল দখল করে নিলো তারা।
পরে প্রায় তিনমাস ধরে এলাকার মানুষেরা এখানে থানা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। কিন্তু গত ২৪ এপ্রিল পুলিশ এই মাঠে ইট, সিমেন্ট, সুড়কি রাখা শুরু করলে পরিবেশকর্মী ও উদীচীর সদস্য সৈয়দা রত্না এই মাঠ থেকে কয়েক সেকেন্ড ব্যাপ্তির একটা লাইভ করলে তাকে ধমক দেয়ার পর মোবাইলটা কেড়ে নেয়া হয়, লাইভ বন্ধের কথাও শোনা যায়। মোবাইল বন্ধ ও কেড়ে নেয়ার পর পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। এরপর তার পনের বছরের ছেলে রাস্তায় নামলে তাকেও তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এই ঘটনার প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সরব হলে মুচলেকার বিনিময়ে সৈয়দা রত্নাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং মুক্তি পাওয়ার পর ছেলের কপালে মা'র চুমু খাওয়ার ছবিটা আবারো ভাইরাল হয়!
সৈয়দা রত্নার যে দেশ, সেই দেশটা এখন আমাদের! তার ছেলের লকআপে থাকার যে জীবন সেই জীবনটা এখন শিশুদের। খেলার মাঠ চেয়ে প্রতিবাদ করলে থানায় আটকানোর যে 'ট্রেইন্ড' সেই ট্রেইন্ড এখন আমাদের নিয়তি। পুলিশের যে আচরণ সেটা একটা প্রতীকী ক্ষমতা দেখানোর বহিঃপ্রকাশ। রাষ্ট্র এখন শিশুবান্ধব নয়, পুলিশবান্ধব। এখানে শৈশব মানে মোবাইলের ভার্চুয়াল ও এডাল্ট গেমে আসক্ত হওয়া, অনলাইন আসক্তি একসময় শিশু-কিশোরদের রুম বন্দী থাকতে প্ররোচনা দেয়, মাদকের প্ররোচনায় প্ররোচিত হতে বাধ্য করে। এখানে উন্নয়ন মানে গাছ বা মাঠ না থাকা, শুধু পরিকল্পনাবিহীন রাস্তা বা ভবন হওয়া। দেশটা এখন এই উন্নয়ন রোগে ভুগছে। এখন খেলা বা মাঠে জড়ো হওয়ার দরকার নেই, দরকার নেই মাঠে জানাজার, সেসব মসজিদে হলেই চলবে। খেলা, মাঠ বা হাঁটাহাটিতে বাণিজ্য নেই, আছে মাঠজুড়ে ভবন বানানোতে। শিশুদের শৈশব বা বয়স্কদের বিনোদন বন্ধ করে বাণিজ্যকরণের যে রাজনীতি সেই রাজনীতির দেশ এখন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের লাঠিয়াল হিসেবে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে পুলিশকে।
পুলিশ তাই শিশুকে আটকে রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই ক্যাপ্টেন (অব) শেখ কামাল ছিলেন আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা। লে. শেখ জামালের নামে এখন ধানমন্ডি ক্লাব। শেখ রাসেলের নামে সারাদেশে আছে কয়েকটি শিশুপার্ক। শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব বা আবাহনী মাঠের খুব কাছে কলাবাগান মাঠটা হয়ে পড়েছে 'এতিম'। একদিন হয়তো পুলিশি ভবনের নীচে চাপা পড়ে থাকবে সব স্মৃতি!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সব হারানোর বেদনা আপনি যেমন বুঝতে পারেন, এই মাঠ হারানোর বেদনাও আপনি বুঝবেন। বুঝবেন জীবননির্ভর পবিত্র অভ্যাস বধ করে দিলে নাগরিকের কত বড় দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে জীবনে। দীর্ঘশ্বাস শুধু সৈয়দা রত্না কিংবা তার ছেলের নয়। এই দীর্ঘশ্বাস বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিময় বাড়ি থেকে খুব কাছের কিছু মানুষের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তেঁতুলতলা মাঠ যেমন ছিল, যেন ঠিক তেমনই থাকে এই প্রার্থনা জানাই।
পুলিশের লাঠির ভয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হয়তো 'ভুল স্বীকার' করানো যায়; দীর্ঘশ্বাস মোছার মতো লাঠি বা ডাস্টার কোনটাই পুলিশের কাছে নেই। তেঁতুলতলা মাঠ থেকে উঠে যাক ডাস্টবিন; ধানমন্ডি লেক ও বত্রিশ নম্বর পেরিয়ে তেঁতুলতলা মাঠও হয়ে উঠুক এক চিলতে সবুজ নিশ্বাসের জায়গা!
- আহসান কবির: রম্য লেখক