ঈদের আনন্দ কথা আজো বয়ে চলি...
এখন ঈদ এলেই শুধু ফেলে আসা ঈদের দিনের আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর কিছু স্মৃতিকথা ভিড় করে আসে। কারণ আজকাল যে ঈদ আমরা উদযাপন করি এরমধ্যে সামাজিকতা ও আন্তরিকতার চাইতে একক চাওয়া-পাওয়াই বেশি। এই আধুনিক শহুরে সমাজে পরিবারের চেয়ে ব্যক্তির আনন্দই বড়। যৌথ পরিবারের সেই টান ও আনন্দটা কোথায় যেন অনুপস্থিত, যাক সে আলোচনা পরে হবে।
আমাদের ঈদকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর পরিবারের ঘটে যাওয়া কিছু মজার কাহিনি দিয়েই শুরু হোক ঈদ আয়োজন। ঈদ বিষয়ক গল্পের নায়ক আমার মেজোখালার বড় ছেলে বাবলু। বাবলু ভাই ব্যবসা করতেন বলে খুব ঘটা করে কাজে এবং অকাজে রংপুর-ঢাকা-চট্টগ্রাম ছুটোছুটি করতেন। সত্তর দশকের শেষ থেকে তার ব্যবসা শুরু এবং সেই থেকেই এই যাতায়াত।
আনন্দ বেকারিময় ঈদ
বাবলু ভাই ১৯৭৭/৭৮ সালে ঈদের আগে ঢাকা এলেন এবং টার্গেট ঠিক করলেন পুরানো ঢাকার বিখ্যাত আনন্দ কনফেকশনারীর বিভিন্ন উপাদেয় মিষ্টান্ন সামগ্রী ঢাকা থেকে রংপুরে নিয়ে যাবেন ঈদে। এমনকী আনন্দ বেকারির বিস্কুট, চানাচুর ও সেমাইও কেনা হলো।
মিষ্টিগুলো কিনে রাখা হলো ফ্রিজে। দেরিতে ঘুম ভাঙার ফলে, সকাল সাড়ে সাতটার বাস ধরতে বাবলু ভাই তাড়াহুড়ো করে আসাদগেট বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলেন। বাসার কেউ তাকে একজন দরজা খুলে এগিয়ে দিয়েছিল।
ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলাম ফ্রিজ ভরা থরে থরে সাজানো রাংতা দিয়ে মোড়ানো আনন্দ বেকারির নানান রঙের নেশেস্তার হালুয়া, কেক, মিষ্টি পাউরুটি, মালাই চপ, মিষ্টি টানা পরোটা ইত্যাদি। বাসার মুরুব্বিরা উহ আহ করলেও, আমরা নির্মল আনন্দ লাভ করেছিলাম সেই যাত্রায়। এমনকী ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই ও বিস্কুটও রেখে গিয়েছিল বাবলু ভাই। সেবার জম্পেশ এক আনন্দ বেকারিময় ঈদ হলো আমাদের।
ডাকাত দল নেমে যাওয়ার পর...
আরেক ঈদের ঠিক আগে ঢাকায় কেনাকাটা করতে এসেছিলেন আমাদের বাবলু ভাই। উনি রংপুর থেকে নাইট কোচে ঢাকায় রওনা দিলেন। বাসা থেকে ভরপেট খাওয়া দাওয়া সেরে বাস চলতে শুরু করার আগেই বাবলু ভাই ঘুমিয়ে পড়লেন।
তিনি একবার ঘুমোতে শুরু করলে মোটামুটি ১০/১২ ঘন্টা পার না হলে উঠতেন না। বোধকরি মাথায় বজ্রপাত হলেও বাবলু ভাইয়ের ঘুম ভাঙতো না। কারণ উনি মনে করেন, খাওয়া আর কাজের বাইরে কারো উচিৎ নয় এক মিনিট সময়ও নষ্ট করা। তাই হাতের ব্রিফকেসটা মাথার উপর লাগেজ বক্সে রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আর তার এই ঘুম মানে প্রচন্ড জোরে নাসিকা গর্জন এবং বোধশূন্য হয়ে ঘুম। বগুড়া পার হওয়ার পর পর বাসে ডাকাত পড়ল। ৫/৬ জনের একটি ডাকাত দল চোখ-মুখ ঢেকে বাসে উঠে বাসযাত্রীদের পকেট, বাক্সপ্যাটরা খালি করে দিয়ে ১০/১৫ মিনিট পর নেমে গেল।
বাসে ডাকাত পড়ার পর যাত্রীদের চেচামেচি, কান্নাকাটি, হৈ চৈ-এ চারিদিকে ধুন্ধুমার অবস্থা। বাবলু ভাইয়ের সহযাত্রী পরে জানিয়েছিল যে, বাসে যখন ডাকাতি চলছিল, আমাদের ভাই নাকি তখনও ঘুমাচ্ছিলেন। ডাকাতরা নেমে যাওয়ার পর ক্রমশ বাসে মৃত্যুপুরীর নীরবতা নেমে এসেছিল। যাত্রীরা হৈ চৈ ও কান্নাকাটি করে ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেল।
ঠিক এইসময় সহযাত্রী মহাশয় আর সহ্য করতে না পেরে বাবলু ভাইকে গুঁতা দিয়ে টেনে তুলে বললেন, "ভাইরে এইবার উঠেন, বাসোত ডাকাত পইচ্ছে, আর আপনি নাগাড় নিন্দাছেন (ঘুমাচ্ছেন)। আর কত নিন্দাইবেন বাহে ? আপনি কেমন মাইনষি (মানুষ)?"
এইবার ডাকাডাকিতে কাজ দিল। 'ডাকাত' শব্দটা কানে যেতেই বাবলু ভাই ধরফর করে উঠে দাঁড়ালেন। হঠাৎ করে বাজখাই গলায় চিৎকার দিয়ে বলতে শুরু করলেন "ডাকাত ডাকাত, কই কই, ধর ধর।" বাসের যাত্রীরা বাবলু ভাইয়ের এই আচানক চিৎকার ও লাফিয়ে ওঠা দেখে পুনরায় চমকে উঠলো।
সবাই ভাবলো হঠাৎ এই লোকটা জেগে উঠলো কেন? ব্যাপার কি? যারা কান্নাকাটি করে ঝিমিয়ে পড়েছিল, তারাও চোখ খুলল। বাবলু ভাই তার দশাসই ভুঁড়িখানা নিয়ে ডাকাত ডাকাত বলে বাসে তান্ডব শুরু করলেন।
বাসের সুপারভাইজার লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে এসে জানতে চাইল, "ভাই কই ডাকাত ? আপনি মনে হয় ভয়ে এমনটা ভাবছেন। ওরাতো সব মালামাল নিয়ে নেমে গেছে বহু আগেই।" বাবলু ভাই বললেন, "এ্যা নেমে গেছে ? আমার ব্রিফকেস, আমার ব্রিফকেস কই গেল?" পাশের যাত্রী বলল, "ভাই ঐটাও (ওরা) নিয়া গেইছে। আপনি কেনবা বোদে (টেরই) না পান। বাসোত এত হুলুস্থুল, কান্দন। আর আপনি নাগাড় ঘুমাছেন।"
এইবার সুপারভাইজার বুঝতে পারলো বাবলু ভাই ভয় থেকে নয়, এখনই ঘুম থেকে উঠে জানতে পেরেছেন যে বাসে ডাকাত পড়েছিল। সুপারভাইজার বিস্ময়ে হা হয়ে শুধু বলেছিল, "ভাই আপনি কি মানুষ ?" শুধু তাই নয় বাসের অন্য যাত্রীরাও ঘুম বাদ দিয়ে হা করে বাবলু ভাইকে দেখতে শুরু করে। তাতে নাকি বাবলু ভাইয়ের বেশ অস্বস্তিই হয়েছিল।
পরের পথটুকু বাবলু ভাই আর ঘুমাতে পারেন নাই বলে দাবি করেছিলেন আমাদের কাছে। কারণ ব্রিফকেসে ঈদের কেনাকাটার টাকা, তার কাপড়চোপড় ছাড়াও ব্যবসার কাগজপত্র ছিল, ছিল ব্যাংকের চেক বই। এরপর আর ঈদ হবে কেমনে?
এই গল্প আমরা বাবলু ভাইয়ের কাছ থেকে যতটা শুনেছি, এর চেয়েও বেশি জানতে পেরেছি তার ঐ পাশের যাত্রীর কাছ থেকে। কারণ ঐ যাত্রী, যার নাম ছিল হান্নান, পরবর্তীতে বাবলু ভাইয়ের বেশ বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন। এই হান্নান সাহেব নিজে মুখে স্বীকার করেছেন, বাবলু ভাইয়ের মত এমন অদ্ভুত মানুষ উনি কমই দেখেছেন। টাকাপয়সাসহ সব জরুরি জিনিস ব্রিফকেসে রেখে কীভাবে একজন মানুষ এত নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন?
অগত্যা আমাদের চলে আসতে হল....
আমাদের সবার ইফতারি ও রাতের খাবারের দাওয়াত ছিল বাবলু ভাইয়ের শ্যালিকা আফু আপার বাসায়। আফু আপা ও তার স্বামী খুবই চমৎকার মানুষ। তাদের বড় দুলাভাই অর্থাৎ বাবলু ভাইয়ের উপলক্ষেই দাওয়াতটা ছিল। উনি গতকাল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন এবং পরদিন সকালে আবার রংপুর চলে যাবেন। কারণ একদিন বাদেই ঈদ।
যাই হোক আমরা বাড়ির সবাই দাওয়াত খেতে গেলাম। ইফতারিতে অনেক ধরনের খাবারের আয়োজন ছিল। সবাই একটু কম কম করেই ইফতারি করলাম কারণ রাতের খাবারও তো খেতে হবে। কিন্তু বাবলু ভাই খেয়েই চললেন। পরদিন সকাল ১০/১১টার দিকে তার বাস এবং তাকে লং জার্নি করতে হবে, বারবার একথাই মনে করিয়ে দিচ্ছিল সবাই।
রাতের খাবার দেওয়া হল একটু দেরি করেই। বাবলু ভাই দারুণ দারুণ বলতে বলতে এতটাই খেলেন যে তার প্যান্টের বেল্ট আলগা করতে হলো। আমরা খাওয়াদাওয়া শেষে উঠলাম, হাত ধুলাম। বাবলু ভাইও একটু পরে উঠলেন এবং আরামের কথা বলে এবার প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে নিলেন।
এরপর ডাইনিং রুমের এক কোনায় রাখা ডিভানে শুয়েই পড়লেন এবং নাক ডাকা শুরু করে দিলেন আমরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখলাম, রাত বাড়ছে কিন্তু বাবলু ভাই ঘুম থেকে উঠতেই পারছেন না। যাক অনেকপরে চোখ মেলে তাকালেন।
তাকে একটু ফ্রি করার জন্য আদা পানি ও হালকা গরম পানিতে লেবুর রস দেয়া হলো। একটু পর আবার শুনলাম তার নাসিকা গর্জন। মানে ভাইকে এই ঘুম থেকে আর উঠানো যাবে না। অগত্যা সে যাত্রায় তাকে শ্যালিকা গৃহে রেখেই আমাদের ফিরতে হল। আম্মা পুরোটা পথ তার ভাগিনার কান্ডকারখানা দেখে বকেই গেলেন।
পরদিন রংপুর যাওয়ার বাস ধরতে হবে বাবলু ভাইকে। কাজেই সকাল সকাল ফোন করলাম। ঐ বাসা থেকে পরে জানানো হলো, প্রবল ডাকাডাকি করেও তারা বেলা ১২টার আগে বাবলু ভাইকে জাগাতে পারেনি। কাজেই সে যাত্রায় বাবলু ভাইকে ঢাকায় ঈদটা কাটিয়ে যেতে হয়েছিল।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন