ফিলিস্তিনের কণ্ঠস্বর শিরিন আবু আকলেহ
শিরিন আবু আকলেহ সাংবাদিকতার জগতে সবসময়ই সামনের সারির ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত ছিলেন। বিশেষত আরব বিশ্বে। ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলের মানুষের ওপর ইসরায়েলের হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়ন সরেজমিনে টেলিভিশনের পর্দায় তুলে ধরার সাহসের জন্য যেমন, তেমনি যে সত্য ইসরায়েল অস্বীকার করে আর পাশ্চাত্য গণমাধ্যম হাজির হতে দেয় না তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি সাংবাদিকতা করেছেন। সাংবাদিকতার যে মানদণ্ড শিরিন হাজির করেছেন তা আগামী দিনে আদর্শ হয়ে টিকে থাকবে।
শিরিন আবু আকলেহ ইসরায়েলের সৈন্যদের গুলিতে খুন হয়েছেন গত ১১ মে, ২০২২। সে সময় তিনি আল-জাজিরার জন্যে পশ্চিম তীরের জেনিনের একটি রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরায়েলি সৈন্যদের অভিযান নিয়ে খবর সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তার মাথায় 'PRESS' লেখা হেলমেট ছিল, কাজেই তাকে না চিনে এমনিতেই গুলি এসে লাগেনি। তার দিকে তাঁক করেই গুলি করেছে ইসরায়েলী সৈন্যরা।
তাকে হত্যা করতেই চেয়েছিল তারা। সেটাই হয়েছে। মুহূর্তে তার নিথর শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। হেলমেট পরা অবস্থায় তার মাথায় গুলি করলেও সেই গুলি থেকে নিরাপদ থাকার কথা, কিন্তু তাকে গুলি করা হয়েছে মাথায় মুখের দিকে, অতঃপর তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটেছে। তার সাথে আরও একজন সাংবাদিক আলি সামুদি গুলিতে আহত হয়েছেন।
শিরিন আবু আকলেহ'র বয়স ছিল মাত্র ৫১ বছর। আরব বিশ্বে একজন নারী দীর্ঘদিন যুদ্ধ ময়দানে সরাসরি উপস্থিত থেকে খবর সংগ্রহ করেছেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
একদিকে সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব দেখিয়েছেন, অন্যদিকে নিজ জন্মভূমিতে ইজরাইলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন সঙ্গত কারণেই। তিনি এই মাটিরই সন্তান। ফিলিস্তিনের ঘরে ঘরে তার নাম জানতো, তার খবরের অপেক্ষায় তারা থাকতো।
প্রায় ২৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি দখলদারত্ব ও তাদের প্রতি বর্বর আচরণের চিত্র তুলে ধরছিলেন তার প্রতিবেদনগুলোতে। শিরিন সম্পর্কে যেসব লেখা আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায় বেরিয়েছে তাতে পরিষ্কার যে শিরিন ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে 'কলম' নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। শত্রুপক্ষের ট্যাংক, গোলা বারুদ, অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে শিরিনের হাতে ছিল টেলিভিশনের ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন।
তিনি ফিলিস্তিনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছেন কিংবা সংবাদ সংগ্রহ করতে শরণার্থী শিবিরের সরু গলিতে গিয়েছেন। এবং শেষ দিনেও জেনিনের রিফিউজি ক্যাম্পে ইসরায়েলের অভিযান নিয়ে কাজ করতে গিয়েই তিনি নিহত হয়েছেন। তার সারা সাংবাদিক জীবনে ইসরায়েলী দখলদারদের নিষ্ঠুরতার চিত্র উন্মোচন করে গেছেন। এমন একজন সাংবাদিক ইজরাইলের 'টার্গেট' হবেন এতে অবাক হবার কিছু নেই।
শিরিনের এই হত্যাকাণ্ডে সারা বিশ্বে বেশ প্রতিবাদ হচ্ছে। বলা বাহুল্য ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নেমেছে, এবং আল-জাজিরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার বিভাগ, আর্টিকেল ১৯, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কিছু মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং তদন্তের দাবী জানিয়েছে। আরব বিশ্বে মিশর, কুয়েত, ইরান, এবং কাতার ছাড়া অন্যদের নাম দেখা যায়নি।
বলা যায় তারা নীরব ভূমিকাই পালন করছেন। এদিকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, চীনসহ কয়েকটি দেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শিরিনের এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়েছে। সাংবাদিক মহলে ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ডিক্যাব) প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিকদের এতো রকম ফোরাম আছে তারা খুব সোচ্চার হয়নি।
নারী সাংবাদিকদের মধ্যে দু'একজন ছাড়া বাকি সবাই নীরব। কেউ কেউ ফেসবুকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শিরিন নারী সাংবাদিকদের 'আইকন' ছিলেন, কিন্তু ইসরায়েলীরা তাকে হত্যা করেছে জেনেও প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে না কেন এই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শিরিনের হত্যার প্রতিবাদ হতে থাকবে। ইসরায়েল শিরিনের সাংবাদিকতার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে পারলেও তাদের জন্যে এই হত্যাকাণ্ড বিপদ বয়ে আনতে পারে। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তারা দ্যা হেগ এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিচার চাইবেন।
ইসরায়েলের সৈন্যরা বড় বড় ট্যাংকের সামনে কিশোর বয়সী ছেলেদের গুলতি দিয়ে পাথর ছুড়লেও তাদের হত্যা করতে দ্বিধা করে না। সাংবাদিকরা তাদের কাছে আরো ভয়ানক। অধিকৃত ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের কথা যারা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন এমন ৪৬ সাংবাদিককে ২০০০ সালের পর থেকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অথচ হত্যাকারীদের কোন সাজা হয় নি। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স এর একটি প্রতিবেদনে জানা যায় ২০১৮ সাল থেকে ১৪৪ জন ফিলিস্তিনী সাংবাদিক গুলিতে আহত হয়েছেন।
জেনিন শহরে 'প্রেস' লেখা হেলমেট পরে সংবাদ সংগ্রহে কর্তব্যরত অবস্থায় শিরিনের হত্যাকাণ্ডের পর ইসরায়েল চেষ্টা করেছে ফিলিস্তিনীদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে। এবং এই সম্ভাবনা থাকতে পারে এমন সুরে অনেক পশ্চিমা দেশ উদ্বেগও প্রকাশ করে ফেলেছে। কিন্তু শিরিন তো কোন গোলাগুলির মাঝে গিয়ে পড়েননি, তাকে লক্ষ্য করেই নির্ভুলভাবে গুলি করা হয়েছে।
শিরিন তার প্রতিবেদনের কারণে যেমন ফিলিস্তিনের ঘরে ঘরে পরিচিত ছিলেন, উল্টো দিকে ইসরায়েলের সৈন্যরাও তাকে নিয়ে বিপাকে ছিলেন। তাই তারা আল-জাজিরার অফিসের ওপর হামলা করেছে, শিরিনকে খুন করা তারই অংশ ছাড়া আর কি হতে পারে? শিরিন ক্রমাগতভাবে দখলদার ইজরাইলের অন্যায়, অবিচার এবং হত্যাকাণ্ড সহ বিভিন্ন অপরাধ তুলে ধরেছেন। যদিও একাজ করা হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে কিন্তু ইসরায়েলের কাছে এগুলোই ছিল সন্ত্রাসী কাজ।
শিরিন আবু আকলেহ দখলীকৃত ভূমিতে গুটিকয় ফিলিস্তিনী্দের মধ্যে একজন যাদের আমেরিকার নাগরিকত্ব আছে। তিনি প্রটেস্টেন্ট ক্রিশ্চান ছিলেন। একে তো তিনি আল-জাজিরার মতো সংবাদ মাধ্যমের বিখ্যাত সাংবাদিক, অন্যদিকে মার্কিন নাগরিক হওয়ায় ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজ থেকে গতানুগতিক দুঃখ প্রকাশ ও যথাযথ তদন্তের কথা বলেছেন। এটুকু করেই তাদের দায়িত্ব শেষ! তাদের কাছে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। পশ্চিমা দেশগুলো মিনমিনিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে থাকবে আর অন্যদিকে ইসরায়েলকেও সমর্থন যোগাবে, এভাবেই ইসরায়েল প্রশ্রয় পেয়ে আসছে।
শি্রিনকে হত্যা করেও তারা শান্তি পায়নি। তার লাশবহনকারী মিছিলে হামলা হয়েছে, পরিবার যখন তার বাড়িতে শোক পালন করছিল তখন সেখানে হামলা চালানো হয়, ফিলিস্তিনের পতাকা নামিয়ে ফেলতে বলা হয়।
দ্বিতীয় ফিলিস্তিনী ইন্তিফাদা যা ২০০০ সালের শুরুতে ঘটেছিল, তখন থেকে অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনীরা কেমন আছে তা তুলে ধরেছিলেন শিরিন এবং আরো কিছু সাংবাদিক। ফিলিস্তিনিরা শত কষ্টের মধ্যেও এটা দেখে শান্তি পেয়েছিল যে তাদের কথা সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
অন্যদিকে শিরিনকে দেখে বহু তরুণ বয়সের নারী উদ্বুদ্ধ হয়েছিল সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্যে, বিশেষ করে শিরিনের মতো এতো কঠিন অবস্থার কথা তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বলা হয় যে শিরিনের সংবাদ উপস্থাপনের ভঙ্গি তার আত্মবিশ্বাস তরুণদের এতো আকর্ষণ করতো যে ফিলিস্তিনের মেয়েরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ব্রাশকে মাইক্রোফোন বানিয়ে সংবাদ পরিবেশনের ভান করতো।
সংবাদ পরিবেশন শেষে "Shireen Abu Akleh, Al Jazeera, occupied Jerusalem" এই বাক্য আর শুনবে না, এই কথা এখনো ফিলিস্তিনিরা বিশ্বাস করতে পারছে না। শিরিনের মৃত্যুর পর অনেক নারী সাংবাদিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব কথা লিখে তাদের শোক জানাচ্ছেন।
ফিলিস্তিনের সংবাদ পরিবেশনের শিরিনের আন্তরিকতা দেখে আরব বিশ্বেও তার জনপ্রিয়তা যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। তাকে 'ফিলিস্তিনের কন্যা' বলেও ডাকা হতো। তিনি আরব বিশ্বের প্রথম কয়েকজন মাঠ পর্যায়ের নারী সাংবাদিকদের একজন ছিলেন; ১৯৯৭ সালে আল-জাজিরায় কাজ করতে শুরু করেন, এবং জেরুজালেম থেকে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই কাজেই ছিলেন। শিরিনের এই অকাল মৃত্যু নিঃসন্দেহে এক অপূরণীয় ক্ষতি ।
এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবী করছি।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী