নিরপেক্ষ নির্বাচন কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ধন্যবাদ আপনাকে। গণমাধ্যমে বলেছেন আমাদের সময়ে দিনের ভোট দিনেই হবে। এ কথার একটি অর্থ দাঁড়ায় অতীতে তাহলে রাতে কখনো ভোট হয়েছিল? গত তিন বছর যাবত দেশ-বিদেশের নানা অঙ্গনে গত দুইটি নির্বাচন নিয়ে যে কানাঘুষা, অভিযোগ চলছিল তা আপনি মাথায় রেখেই বলছেন 'দিনের ভোট দিনেই হবে'।
বিশেষ করে ২০১৮ সালের ভোট নিয়ে যে বিতর্ক সূচনা হয়েছিল তা দেশের অভ্যন্তরের বিতর্ক, কিন্তু এটা পৃথিবীর নানান প্রান্তের গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছিল। সেই বিষয়টি আপনি ধর্তব্যের মধ্যে নিয়েই তাহলে বলছেন যে দিনের ভোট দিনেই হবে। এই বক্তব্যের ভিত্তিতে ধরে নেওয়া যায় যে আপনি একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে চাইছেন।
একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভর করে না। তা এদেশের অতীতের নির্বাচন থেকেই আমাদের অভিজ্ঞতা আছে । আমাদের মনে আছে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন বিচারপতি আব্দুর রউফ, যে নির্বাচনের বিরুদ্ধে তদানীন্তন ক্ষমতাচ্যুত এরশাদের দল প্রশ্ন করেছিল। একথা সত্য জাতীয়পার্টির প্রার্থীরা সঠিক মাত্রায় নির্বাচনী কার্যক্রম চালাতে পারেনি। তাদের বহুজন পলাতক ছিল কিংবা স্থানীয় কারণে এলাকায় নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি।
এরশাদ সেই সময় কারাগারে অবস্থান করছিল। তারপরেও এরশাদবিরোধী বিরোধীদলগুলো ১৯৯১ সালের সেই নির্বাচনকে নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। বিষয়টা তাহলে কী ঘটেছিল? কেন ওই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করল অন্যদের কাছে?
সে সময়ের রাজপথের আন্দোলনের প্রধান জোট ও দল ফলাফল মেনে নিয়েছিল। এরপরে একই নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ১৯৯৪ সালের মাগুরা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যে মাগুরার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এদেশে ১৯৯৫ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবি উত্থাপিত হয়েছিল। তাহলে আমরা দেখতে পাই যে নির্বাচন কমিশন এককভাবে কোনো নিরপেক্ষতার গ্যারান্টি নয়। কারণ আমাদের দেশের আইন কানুনে যা আছে তা নির্বাচনকালীন সময়ে পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীল।
নির্বাচন কমিশনকে মূলত নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের উপরই নির্ভর করতে হয়। যেমন, কমিশন যদি দেখতে পান সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত, নির্বাচনের কাজে অংশগ্রহণকারী কোন ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে তাকে নির্বাচনের মাঠ থেকে সরাসরি প্রত্যাহার করার ক্ষমতা আমাদের নির্বাচন কমিশনের নাই। আমাদের নির্বাচন কমিশন কেবলমাত্র প্রত্যাহার করার জন্য নির্বাহী বিভাগের কাছে আবেদন করতে পারেন। নির্বাহী বিভাগ চাইলে তা বাস্তবায়িত হবে অথবা হবে না, কারণ অতীতে উদাহরণ আছে যে নির্বাচন কমিশন প্রত্যাহার করার জন্য চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও তা প্রত্যাহার করা হয়নি।
তবে সারা দেশে নির্বাচন সংক্রান্ত যে ধারণা আমাদের জনজীবনে আছে তা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন কেবলমাত্র নিরপেক্ষ থাকলেই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব।
ভারতে নির্বাচন কমিশন মনোনয়ন দেওয়ার জন্য ভারতের কোন আইন নাই। তারপরেও সেখানে টি এন সেসনের মতন নির্বাচন কমিশনার পেয়েছিলেন। তিনি ভারতের নির্বাচনকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ প্রদর্শন করার রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন । যে রাস্তা ধরেই ভারতের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে । ভারতে এখন পর্যন্ত নির্বাচিত সরকার ছাড়া ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কেউ আসেনি, যদিও মাঝখানে ইন্দিরা গান্ধীর দুই বছরের জরুরি অবস্থায় অনির্বাচিত সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনার একটি উদাহরণ আছে।
কী সেই আইনসমূহ যে আইন সমূহের ফলে ভারতের নির্বাচন কমিশনের হাত এত শক্তিশালী? যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা হচ্ছে মাত্র তিনজন। বাংলাদেশের সংখ্যা ৫ জন। কেন ভারতের মতন একটি রাষ্ট্রে নির্বাচন কমিশনারের সংখ্যা ৩, আর বাংলাদেশে ৫ জন তাও এখনো আমাদের বোধগম্য হয়নি।
নির্বাহী বিভাগ মনে করেছেন পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার রাখতে হবে। সেই কারণে পাঁচজন নির্বাচন কমিশনারের পদ সৃষ্টি করেছেন। নিরপক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য প্রথমত হচ্ছে সামাজিক ঐক্যবদ্ধতা এবং সামাজিক সমঝোতা দরকার। বাংলাদেশের ১৯৭০ সাল থেকে সর্বজনীন ভোটাধিকার অর্জন করার সময় কাল থেকে আজ অবধি এই সামাজিক ঐক্যবদ্ধতার নির্বাচনের ক্ষেত্রে গড়ে ওঠেনি, ফলে প্রতিটি নির্বাচনেই নানান ধরনের অভিযোগ সৃষ্টি হয়েছে যা আসলে নির্বাচন কমিশনারের হাতে হয়নি।
মাঠে আমাদের নির্বাচন পরিচালনা করে প্রকৃতভাবে সরকারের নির্বাহী বিভাগের থেকে মনোনীত ব্যক্তিবর্গ। তাদের পক্ষে আইনি বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা না গেলে তারা নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে না। রাতের ভোটের যে অভিযোগ, এ ক্ষেত্রে তেমনি ঘটনা ঘটেছে। সকল ধরনের বিধি-বিধান থাকার পরেও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। রাতের অন্ধকারে ভোট হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। সকালে যখন ভোট গ্রহণ শুরু হয়েছিল তখন যদি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কিংবা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের বাক্স উম্মুক্ত করে সবার সামনে দেখাতো তাহলে ওই রাতের ভোটের বিষয়টি তখনই সকলের নজরে আসত।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল, কীভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। যাকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল প্রশিক্ষণ বলে। সে সময়কার গণমাধ্যমে আমরা দুই-তিনবার এই ধরনের সংবাদ দেখেছি। তাহলে কী শিক্ষা তখন দেয়া হয়েছিল যে তারা সেই রাতের অন্ধকারের ভোট সম্পর্কে কোন কথা বলতে পারেননি।
রাতের অন্ধকারের যে ভোটের অভিযোগ করা হয়, তার ফলেই একটি অকার্যকর পার্লামেন্ট সৃষ্টি হয়েছে। যা বোঝা যায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি কার্যকর শক্তিশালী বিরোধী দলের কথা বলছেন। কার্যকর বিরোধীদল ২০১৮ নির্বাচনের পর এ দেশে থাকল না কেন? সেটি নির্বাচন কমিশন নয় শুধু, দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ভাবতে হবে। আরো ভাবতে হবে কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশনের উপরের সকল দায় বদ্ধতা চাপিয়ে দিলেই একটি সফল নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না । তার জন্য প্রয়োজন আইন।