অর্থনৈতিক সংকটের সময় ঐক্য সৃষ্টি করা সবচেয়ে জরুরি, বিভাজন নয়
গত কয়েক দিন পত্রিকার পাতায় প্রধান সংবাদ হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গণের রণাঙ্গনের খবর। যে খবর মনে করিয়ে দেয় ৯০ দশকের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়কার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র। সেই সময় প্রায়শই দেখা যেত এরশাদের ছাত্র সংগঠন নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ছে সরকার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উপর। যে ছাত্র আন্দোলন অব্যাহতভাবে এরশাদের জাতীয় পার্টি, তাদের দলীয় অনুসারী ছাত্রদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ভে গড়ে ওঠা সেই এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছিল। সারাদেশের ছাত্রসমাজ একত্রিত হয়ে রাস্তায় নেমেছিল। ছাত্রসংগঠনের তরুণ-যুবকদেরকে এভাবে ব্যবহার করার ইতিহাস এই বাংলার মাটিতে বহুবার আমরা দেখেছি। পাকিস্তান আমলে যখন ছাত্রলীগ ও অন্য ছাত্র সংগঠন যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে তখনও মোনেম খাানের ছাত্রসংগঠন এন এস এফ এভাবেই সেই সময়কার ছাত্র আন্দোলন দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চূড়ান্ত পরিণতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইতিহাসের এই শিক্ষা আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা কতটুকু গ্রহণ করেছে তা আজকে প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০০৬ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবিতে আন্দোলন চলছিল তখনকার কথাও আমাদের মনে আছে। সে সময়ের সেই আন্দোলনেও তদানীন্তন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল রাস্তায় বাধা দিয়েছে। বাধা দিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনকে চূড়ান্তভাবে দমন করা যায় না তা এদেশের ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে। তারপরও দেশ সেই দিকেই ধাবিত হয়।
দুর্বল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। ইহাই গণতন্ত্রের দুর্ভাগ্য যে এর পাশাপাশি গত কয়েক দিন যাবত আরো একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নব মনোনীত নির্বাচন কমিশনের অতি উৎসাহ, ব্যাখ্যা, কথাবার্তা- নতুন কতগুলো অবাঞ্চিত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। একজন নির্বাচন কমিশন ইভিএম মেশিনের ক্ষমতা প্রমাণ করার জন্য হঠাৎ করে ১০ মিলিয়ন ডলারের ঘোষণা দিলেন। এ এক আজব কাহিনী। আমাদের মতন দেশেই এটি সম্ভব। একজন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরপেক্ষ ব্যক্তি মনোনীত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এমনই একটি পাবলিক স্টেটমেন্ট কি করে দিতে পারেন তা আমাদের বোধগম্য হয়না। ১০ মিলিয়ন ডলার কোথা থেকে দিবেন? সরকারের পকেট থেকে না ওনার ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ বিক্রি করে? তাও আবার ডলারে! তাকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে, উনি আবার নতুন করে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে মেঘ ভিড় করছে আমরা এই মেঘকে চাইনা, আমরা নির্মল বাতাসে ভাসতে চাই। আমরা নির্মল পরিস্থিতিতে একটি নির্বাচন চাই। যে নির্বাচন আমাদের দেশের ভাবমূর্তিকে তথা আমাদের রাষ্ট্র গঠনে, সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করবে।
আমাদের মতন একটি ছোট্ট দেশের পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার কি প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছিল তা জনগণ জানে না। তবে নির্বাচন কমিশনাররা নিজেদেরকে অনেক ক্ষমতাবান মনে করেন। তার একটি উদাহরণ হল এই ১০ মিলিয়ন ডলারের ঘোষণা কিংবা তার পরবর্তীকালের প্রেস কনফারেন্স। এমন একজন ক্ষমতাবানকে আমরা দেখেছি অতীতে সরকারের নানান বিড়ম্বনার সম্মুখীন করতে। বিচার বিভাগের সেই প্রাক্তন বিচারপতির নানান ভূমিকা, সরকারের বিভিন্ন সময়ের প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। একইভাবে সরকারকে বিব্রত করেছে তার সেই সময়কার কার্যক্রম, তার অনেক মন্তব্য বিব্রত করেছে সরকারকে।
বিশ্বরাজনীতির সংকটের ফলে দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে নতুন সংকটের রাস্তায় ফেলে দেওয়ার কি অর্থ তা আমরা জানিনা। তবে আমরা উদ্বিগ্ন। সরকারের সকল পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন যেন সামাজিক বিভাজনটা আর ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি না পায়। অর্থনৈতিক সংকট যখন তীব্রতা লাভ করে তখন সামাজিক ঐক্য সৃষ্টি করা সবচেয়ে জরুরি। সরকারের কিছু অতি উৎসাহী মানুষ নানান ধরনের হালকা মন্তব্যের ভেতর থেকে নতুন বিভাজনের রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে যা উদ্বেগজনক।