‘ইউক্রেন যুদ্ধই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ যেখানে ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে’
হোক সে আকাশে উড়ে বেড়ানো স্ব-চালিত আত্মঘাতী বোমা (লয়টারিং মিউনিশন) অথবা বোমাবাহী কোয়াডকপ্টার—ইউক্রেন যুদ্ধ ড্রোনের লড়াইকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এ সংঘাত অঞ্চলের আকাশে এখন নজিরবিহীন ধরনের বহু ড্রোন উড়তে দেখা যাচ্ছে। তাদের উপস্থিতি শত্রুদের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করছে; আবার নিজ পক্ষের সেনাদের বাড়াচ্ছে মনোবল।
চালকহীন আকাশযানই (ইউএভি) হবে যুদ্ধের ভবিষ্যৎ। এ বাণী বেশিদিনের নয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের। ইউক্রেনের আগেই বিশ্বের অন্যান্য সংঘাত অঞ্চলে ইউএভি রেখেছিল তার সক্ষমতার স্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু, কৃষ্ণসাগর তীরের দেশটিতে চলমান যুদ্ধই প্রথম বড় পরিসরের যুদ্ধ—যেখানে উড়ন্ত ড্রোন অনেকাংশ হয়ে উঠেছে রণাঙ্গনের ভাগ্যবিধাতা।
বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমানের মতো আকার থেকে শুরু করে হাতে নিক্ষেপ করা যায় এমন ছোট আকারের ড্রোনের ছড়াছড়ি এ লড়াইয়ে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা পরামর্শক স্যামুয়েল বেন্ডেটের ভাষায়, 'আমরা বর্তমানে একটি ড্রোন লড়াই দেখছি। এটাই সম্ভবত প্রথম বড় পরিসরের যুদ্ধ যেখানে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের সব রকম ড্রোনের বহুল ব্যবহার হচ্ছে'।
আমেরিকার সেন্টার ফর নেভাল এনালাইসিস ও সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান পলিসি উভয় সংস্থার পরামর্শক বেন্ডেট। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ড্রোন অতি-ব্যবহারের কারণও।
যেমন তিনি জানান, ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়পক্ষের কাছে দূর পাল্লার রাডার নির্ভর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। আছে কাঁধ থেকে নিক্ষেপযোগ্য বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। একারণে মূল্যবান যুদ্ধবিমান ও পাইলটের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে মনুষ্য-চালিত আকাশযানের ব্যবহার হচ্ছে তুলনামূলক সীমিত পরিসরে। কিন্তু, আধুনিক যুদ্ধে চাই আকাশ থেকে শত্রুর গতিবিধির ওপর নজরদারি, চাই শত্রুর সাঁজোয়া যান, কম্যান্ড সেন্টার, যোগাযোগ ব্যবস্থায় আঘাত হানার সামর্থ্য। ড্রোন সেই শূন্যস্থানই পূরণ করছে।
সংখ্যায় পর্যাপ্ত, দামে অপেক্ষাকৃত সস্তা ড্রোন এখন পদাধিক সেনারা কাঁধে বহন করছে। আর প্রয়োজনের সময় শত্রুর অবস্থান জানতে সেগুলি আকাশে ওড়াচ্ছে। পরিচালনা সহজ হওয়ায় স্থল সেনাদের চোখ ও কানের মত কাজ করছে ইউএভি। ড্রোনের যোগাড় করা তথ্য দিয়ে শত্রু অবস্থানে গোলাবর্ষণ করাও সহজ হয়ে পড়েছে। সহজে বহনযোগ্য কিছু ড্রোন আবার নিজেই আত্মঘাতী বোমা; যেমন ইউক্রেনকে দেওয়া আমেরিকার সুইচব্লেড সিরিজ।
ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত এমন নানান ধরনের ড্রোন নিয়েই এ আয়োজন। থাকছে যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এমন বড়, ছোট ও বিখ্যাত চারটি ড্রোন নিয়ে আলোচনা। তাদের সক্ষমতা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যথাযসম্ভব ব্যাখ্যা-
ডিজেআই ম্যাভিক সিরিজ
ইউক্রেন যুদ্ধে সামরিক প্রযুক্তির ড্রোন নিয়ে আলোচনা ঘুরেফিরে আসছে সব গণমাধ্যমেই। কিন্তু, এ যুদ্ধে বেসামরিক ড্রোনের সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহারের দিকে আলোকপাত হয়েছে সে তুলনায় কমই। এদিক থেকে রণাঙ্গনে সাড়া ফেলছে চীনের বেসামরিক ড্রোন নির্মাতা ডিজেআই। তাদের তৈরি ম্যাভিক সিরিজের ড্রোন ইউক্রেনীয় বাহিনীর মধ্যে পেয়েছে জনপ্রিয়তা। ৮ ইঞ্চি ডানার প্রস্থের এই কোয়াডকপ্টার বৈদ্যুতিক চার্জে একটানা উড়তে পারে ৩১ মিনিট পর্যন্ত। গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৯ মাইল পর্যন্ত।
যুদ্ধ শুরুর লগ্নে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নাগরিকদের প্রতি তাদের মালিকানাধীন ম্যাভিক ড্রোন অনুদানের আহ্বান জানিয়েছিল। তাতে সাড়া দিয়ে হাজারের অধিক ম্যাভিক ড্রোন জমা পড়ে। এরপর পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকেরা ব্যক্তিগত সহায়তা থেকে পাঠিয়েছে আরও কয়েক হাজার।
ম্যাভিকের সবচেয়ে ছোট সংস্করণ ম্যাভিক মিনি। মাত্র আধা পাউন্ডের কম ওজনের এই ড্রোন সহজেই বাক্সে ভরে বহন করা যায়। আকারে ছোট হলে কী হবে- সক্ষমতায় এটি কোনো অংশেই কম নয়। এর অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক্স দুই মাইল দূর থেকে উচ্চ মানের স্পষ্ট ভিডিওচিত্র পাঠাতে পারে। একারণে শহরাঞ্চলের যুদ্ধে এটি ইউক্রেনীয় বাহিনীর একান্ত সহায়ক হয়ে উঠেছে।
শহরের কোন স্থানে রাশিয়ার সাঁজোয়া বহর ঢুকছে এটি তা শনাক্ত করে জানিয়ে দিচ্ছে ইউক্রেনীয়দের। এরপর ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা রুশ বাহিনীর ওপর চোরাগুপ্তা হামলা চালানোর উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে পারছে। নিরাপদ দূরত্ব বেঁছে নিয়ে রাশিয়ান ট্যাংক ধবংস করতে পারছে জ্যাভলিন বা অন্যান্য ট্যাংক-বিধবংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে।
শত্রুর পদাধিক সেনা, বাঙ্কারের অবস্থানও জানাচ্ছে। এরপর সেদিকে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রতি কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে বলছেন ইউক্রেনীয় কমান্ডাররা।
আরকিউ-৪ গ্লোবাল হক
যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি 'ফিক্সড উইং' এ ইউএভি ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় ড্রোন। এর দুই ডানার দৈর্ঘ্য ১৩১ ফুটের বেশি। উড়তে পারে টানা ৩৪ ঘণ্টা। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩৫০ মাইল। চলে একটি টার্বোফ্যান প্রযুক্তির জেট ইঞ্জিনে।
আমেরিকা অবশ্য তাদের সর্বাধুনিক এ ড্রোনের একটিও ইউক্রেনকে দেয়নি। মার্কিন বিমানবাহিনী এটি ওড়াচ্ছে মূলত প্রতিবেশী পোল্যান্ডে অবস্থিত তাদের ঘাঁটি থেকে। সীমান্ত লাগোয়া উড়েই এই ড্রোন ৪০ হাজার বর্গমাইল এলাকার ছবি নিতে পারে দিনে, রাতে, বৃষ্টিবাদলায় যেকোনো পরিস্থিতিতে। এসব তথ্য আমেরিকানরা জানাচ্ছে ইউক্রেনীয়দের।
ওরিয়ন
রাশিয়ায় তৈরি এ ড্রোনটিও 'ফিক্সড উইং'। এবং যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় ড্রোন। ডানার দৈর্ঘ্য ৪৮ ফুট আর উড়তে পারে টানা ২৪ ঘণ্টা। অন্তর্দাহ ইঞ্জিনে চালিতে ওরিয়নের সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১২০ মাইল।
মাঝারি উচ্চতা ও দীর্ঘ সময় ধরে উড়তে সক্ষম শ্রেণির ড্রোন এটি। একইসাথে, নজরদারি ও শত্রুর ওপর হামলার মিশন চালাতে সমান সক্ষম। দেখতে অনেকটাই আমেরিকার প্রেডিটর ড্রোনের মতো ওরিয়ন। আমেরিকা ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রেডিটর ড্রোন অসংখ্যবার ব্যবহার করেছে।
তবে রাশিয়ার এ ড্রোনটি প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করে অনেক পরে বা ২০১৬ সালে। এটি ৫৫০ কেজি পর্যন্ত নানান রকম সেন্সর ও বোমা/ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। অস্ত্রসজ্জার মধ্যে রয়েছে এক্স-৫০ নামক ট্যাংক বিবংসী মিসাইল। ওরিয়ন আকাশে শত্রুর বিমান বা ড্রোন ধবংস করতে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্রও বহন করতে পারে।
রাশিয়ার হাতে এই ড্রোনের সংখ্যা খুব বেশি নয় বলে ধারণা পশ্চিমাদের । আর ইউক্রেনে এর ব্যবহার আরও সীমিত বলে মনে করছে তারা। এরমধ্যেই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ড্রোনটি থেকে ইউক্রেনীয় সেনাদের ওপর হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। এর আগে গত মার্চে রুশ গণমাধ্যম দাবি করে, ড্রোনটি ইউক্রেনীয়দের ছয়টি সামরিক যান ধবংস করেছে।
বায়রাক্তার টিবি-২
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলে যে ড্রোনের নাম নিতেই হয়- সে হচ্ছে বায়রাক্তার টিবি-২। ইতোমধ্যেই বিশ্বের নানান রণাঙ্গনে কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছে এ ড্রোন।
তুরস্কে তৈরি ড্রোনটি ইউক্রেনের কাছে বিক্রি করা হয় যুদ্ধ শুরুর আগেই। এর ডানার দৈর্ঘ্য ৩৯ ফুট, একটানা উড়তে পারে ২০ ঘণ্টা। গ্যাসোলিন অন্তর্দাহ ইঞ্জিন চালিত টিবি-২'র সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০০ মাইল।
যুদ্ধ শুরুর দিকে টিবি-২'র হাত ধরেই রুশ লক্ষ্যবস্তু ধবংসে অভাবনীয় সাফল্য পায় ইউক্রেনীয়রা। এক পর্যায়ে সেই খ্যাতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে ড্রোনটি নিয়ে একটি গানও রচনা করে তারা। তবে ধীরে ধীরে রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা টিবি-২'র হুমকি মোকাবিলায় আরও সক্ষম হয়ে উঠেছে। এরমধ্যেই অনেক টিবি-২ ধবংসের দাবিও করেছে তারা।
এতে অবশ্য সেলজুক বায়রাক্তারের তৈরি ড্রোনটি একেবারে বাতিল হয়ে পড়েনি। তবে এখন একটু বুঝেশুনেই এর মিশন পরিচালিত হচ্ছে। কারণ এমএএম-এল ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইলে সজ্জিত টিবি-২ সুযোগ পেলেই চরম আঘাত হানতে পারে এবং তা হানছেও। ইউক্রেনে বহু রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও জ্বালানি কনভয়ে চরম আঘাত করেছে এ ইউএভি।
ইউজে-২২ এয়ারবর্ন
ইউক্রেনে তৈরি এ ড্রোনের ডানার দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট। উড়তে পারে একটানা সাত ঘণ্টা। গ্যাসোলিন অন্তর্দাহ ইঞ্জিন চালিত ইউজে'র সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১০০ মাইল।
ইউক্রেজেট নামক প্রতিষ্ঠান এর নির্মাতা। হালকা ধরনের এ বিমানটি গোয়েন্দাতথ্য সংগ্রহ, নজরদারি এবং গোলন্দাজ বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু শনাক্তে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এর সবচেয়ে বড় সুবিধা এটির নানান অংশ খুলে পরিবহন করা যায়। আর উড্ডয়নের জন্য বিমানঘাঁটির রানওয়ের দরকার নেই, সমতল ঘাসজমিই যথেষ্ট- ইউক্রেনে যার অভাব নেই।
এটি ৪৫ পাউন্ড ওজনের বোমা বা লয়টারিং মিউনিশন- যা কিনা এক ধরনের স্বচালিত মিনি ড্রোন—বহন করতে পারে।
- সূত্র: পপুলার মেকানিক্স