‘এখন একটা রুটি কেনারও পয়সা নেই’
ধোঁয়াওঠা ভাত, মসুর ডাল এবং পালং শাকের গন্ধ নাকে এসে লাগলো।
সারিবেধে বেশকিছু মানুষ অপেক্ষা করছেন এই খাবারের জন্য। এরমধ্যে কোলে শিশু নিয়েও এসেছেন অনেকে। সবার হাতেই দেখা যাচ্ছে প্লেট। সারাদিনে মাত্র এই একবারই খেতে পান তারা।
চিত্রটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে ভোগা শ্রীলঙ্কার একটি কমিউনিটি কিচেনের।
খাদ্যের তীব্র সংকটে থাকা লোকেরা দিনে একবেলা খাবারের জন্য এখানে ভিড় জমান।
খাবার নিতে আসা চার সন্তানের মা চন্দ্রিকা মানেল বলেন, "আমরা এখানে এসেছি কারণ আমরা ক্ষুধার্ত।"
সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য একটি প্লেটে ভাত, ডাল ও শাক মেশাচ্ছেন তিনি। বললেন, এখন একটি রুটি কেনার মতো অবস্থাও নেই।
"অনেকসময়ই আমি আমার সন্তানদেরকে দুধভাত খাওয়াই। সবজি খাওয়ার মতো পয়সা নেই আমাদের। এগুলোর দাম অনেক," বলছিলেন তিনি।
বৈদেশিক রিজার্ভ কমে আসায় এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতিতে কয়েক মাস ধরে ধ্বংসের মুখে রয়েছে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাকসেকে এই সংকটের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এরমধ্যে পর্যটনে আঘাত হানা মহামারি ও তেলের দাম বাড়তে দায়ী ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকেই নিয়ে গেছে।
জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এর ভাষ্যমতে, সব ছাপিয়ে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা রয়েছে মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে।
সংস্থার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭০ শতাংশ পরিবারে বছরের শুরু থেকে খাদ্য ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া, জ্বালানী এবং প্রয়োজনীয় ওষুধের মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
'আমার সন্তানদের অবস্থা করুণ'
প্রথমবার কমিউনিটি কিচেনে আসা চন্দ্রিকা মানেল বলেন, "এখন জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। ঋণ নিয়ে বেঁচে থাকছি আমরা।"
একমাস ধরে এই কমিউনিটি কিচেন পরিচালনা করে আসছেন যাজক মোজেস আকাশ। কলম্বোর একটি গির্জা হলে অবস্থিত এটি।
টানা তিনদিন কাঁঠাল খেয়ে বেঁচে থাকা এক মায়ের কষ্ট দেখে এই উদ্যোগ নেন তিনি।
যাজক মোজেস বলেন, "আমাদের এখানে এমন লোকও আসে যারা গত চার মাসে দু প্লেট ভাতও খেতে পাননি।"
তার অনুমান অনুসারে, খাবারের জন্য সারিতে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা দৈনিক ৫০ থেকে বেড়ে ২৫০ এ পৌঁছেছে।
কেবল জুন মাসেই শ্রীলঙ্কায় খাবারের দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ।
"এখানে আসা বেশিরভাগ শিশুই অপুষ্টিতে ভুগছে," বলেন তিনি।
সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন গর্ভবতী সাহনা। ৩৪ বছর বয়সী এই নারী এসেছেন তার তিন সন্তান নিয়ে। আগামী সেপ্টেম্বরে জন্ম নিতে যাওয়া সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তিনি।
"আমি আমার বাচ্চাদেরকে এক প্যাকেট বিস্কুট বা দুধও খাওয়াতে পারছি না," বলেন তিনি।
সাহনার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার স্বামী পেশায় একজন শ্রমিক। পুরো পরিবারের ভরণপোষণের জন্য সপ্তাহে মাত্র ১০ ডলার উপার্জন করেন তিনি।
"আমাদের নেতারা ভালোভাবে জীবনযাপন করছে। তাদের সন্তানরা যদি সুখে থাকে, তাহলে আমার সন্তানরা কেন পারবে না?" প্রশ্ন রাখেন এই নারী।
দেখা দিয়েছে তীব্র মানবিক সংকট
সাহনার সন্তানের জন্মের সময়, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কলম্বোর মেয়র সম্প্রতি বলেছেন, রাজধানীতে শুধুমাত্র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে।
জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের ঘাটতি এবং প্রতিদিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে পরিবারগুলো তাজা খাবার কিনতে বা নিজেরা বাসায় খাবার রান্নাও করতে পারছে না।
ইউনিসেফের শ্রীলঙ্কান প্রতিনিধি ক্রিশ্চিয়ান স্কুগ বলেন, "একটি পরিবার আগে যেভাবে খরচ করতে পারতো এখন তা পারছে না। খাদ্যগ্রহণ কমিয়ে দিচ্ছে তারা। পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণও কমিয়ে দিচ্ছে তারা। আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছি যেখানে অপুষ্টি একটি বেশ বড় উদ্বেগের বিষয়।"
শ্রীলঙ্কায় তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা হাজারো শিশুর চিকিৎসার জন্য আরও এক মিলিয়ন মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য জরুরি আর্থিক সহায়তার আবেদন করেছে ইউনিসেফ।
শ্রীলঙ্কার মেডিকেল নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ড. রেনুকা জয়তিসা বলেন, তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের হার বর্তমানে ১৩ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। গুরুতরভাবে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা বর্তমানে ৩৫ হাজার।
তার সন্তানকে খাওয়াতে খাওয়াতে চন্দ্রিকা বলেন, "আমার জীবনের সেরা দিনগুলো শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের সন্তানদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই এখনো বাকি।"
"আমি জানি না ভবিষ্যতে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে।"
- সূত্র: বিবিসি