‘পেট্রোলের জন্য ১০ দিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি’, শ্রীলঙ্কায় তীব্র জ্বালানি সংকট
চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করতে না পারায় শ্রীলঙ্কায় চলছে জ্বালানির জন্য হাহাকার। প্রতিদিনই জ্বালানির জন্য গাড়ির লম্বা লাইন এখন শ্রীলঙ্কায় অতি পরিচিত একটি দৃশ্য।
রাজধানী কলম্বোর প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র থেকে শুরু হওয়া এমনই একটি দীর্ঘ লাইন সাপের মতো ঘুরে সমুদ্রতীরবর্তী পথের পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে।
এই লাইনের সামনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন ৪৩ বছর বয়সী প্রতিম। পেশায় একজন মিনিবাস চালক। প্রতিম জানালেন, তিনি ১০ দিন যাবত জ্বালানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন!
পেট্রোল স্টেশনের দিকে কচ্ছপের গতিতে এগোতে এগোতে প্রতিম বললেন, "আমি গত বৃহস্পতিবার থেকে আমার গাড়িতেই ঘুমাচ্ছি। আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে তা বলে বোঝানো সম্ভব না... কিন্তু উপায় নেই কোনো, এমনকি আমি পুরো এক ট্যাংক জ্বালানিও পাবো না।"
নিজের মিনিবাসে করে পর্যটকদের বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতেন প্রতিম। কিন্তু এখন আর দূরে কোথাও মিনিবাস নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই তার, তাই এখন শুধু বিমানবন্দরে যাত্রী আনা-নেওয়া করার মতো ছোটখাটো ট্রিপ দেন তিনি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, ১০ দিন লাইনে দাঁড়িয়ে তিনি যেটুকু জ্বালানি সংগ্রহ করেছেন তা দিয়ে মাত্র তিনবার যাত্রী আনা-নেওয়া করতে পারবেন তিনি। এরপর আবারও তাকে দাঁড়াতে হবে সেই লম্বা লাইনে। প্রতিমের ছেলে বা বাবা মাঝেমধ্যে আসেন তাকে কয়েক ঘন্টার জন্য স্বস্তি দিতে। সেই সময়টা প্রতিম বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেন এবং তারা লাইনে দাঁড়ান।
কিন্তু কারো কারো সেই বিশ্রামের সুযোগটুকুও নেই। প্রতিমের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে আরও কিছু প্রাইভেট বাস। বাসের কন্ডাকটর গুনা এবং চালক নিশান্তর বাড়ি অনেক দূরে, তাই পাবলিক ওয়াশরুমই তাদের একমাত্র অবলম্বন। গুনা বলেন, "আমি এখন প্রতি তিন দিন পরপর একবার গোসল করি। মূত্রত্যাগ করতে এখানে ২০ রূপি করে দিতে হয়, আর গোসল করতে ৮০ রূপি লাগে।"
অবর্ণনীয় দুর্ভোগ
শ্রীলঙ্কায় এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে, আর সেই সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে খাদ্যদ্রব্যের দাম। তাই খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রীলঙ্কার জনগণ।
প্রতিম এবং তার মতো আরও হাজারো মানুষ যখন জ্বালানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে, তারই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ঘটে গেছে নাটকীয় রাজনৈতিক উত্থান-পতন! জনগণের রোষ এড়াতে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে।
শ্রীলঙ্কার এই অর্থনৈতিক সংকটের আংশিক কারণ- কোভিড-১৯ মহামারির কারণে দেশের পর্যটন শিল্পে ধস নামা। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের একাধিক অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত, যেমন- কর কমানো এবং তাড়াহুড়ো করে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি কারণেই শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা।
এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক রকম কম। সে কারণেই বিদেশ থেকে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধ আমদানি করার মতো অর্থ তাদের কাছে নেই।
বাস কন্ডাক্টর গুনা জানান, এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সাথে যোগ দিয়ে তিনিও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে পড়েছিলেন। তার নিজের জীবন এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিলাসী জীবনের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখে বিস্মিত গুনার ভাষ্যে, "তার (প্রধানমন্ত্রীর) জীবনযাপনের ধরন দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম!"
জ্বালানির জন্য লাইনের পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল ভাইদের একটি দল। তাদের একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আর বাকিরা ব্যাংকার। তারা সবাই মিলে পালা করে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন বলে জানান। একদল যখন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে, অন্যরা তখন তাদের গাড়িতে শুয়ে বিশ্রাম করেন। গাড়ি চুরি হওয়া থেকে বাঁচাতে এবং লাইনের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে তাদের এই ব্যবস্থা।
এই দলের একজন, ইওয়ান্থা বলেন, "পুরো ব্যাপারটা এত বাজে যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।" লাইনে থেকেই আশেপাশের ক্যাফে বা গাড়িতে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু সেই সাথে নিজেদের বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক আস্থার প্রশংসাও করেন ইওয়ান্থা।
অন্যদিকে, বাকিদের অভিযোগ যে সেখানে প্রায়ই ঝগড়াঝাটি বা মারামারি হয়। কিন্তু তিনি মনে করেন, এই লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের মধ্যে এক ধরনের একাত্মতা রয়েছে। আশেপাশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা তাদেরকে নিজেদের বাথরুম ব্যবহার করতে দেন বলে উদাহরণ দেন তিনি।
আবার অনেক সময় দলবেঁধে অপরাধের ঘটনাও ঘটে! ইওয়ান্থা বলেন, "একদিন আমি গাড়িতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় স্লিপারজোড়া বাইরে রেখে গিয়েছিলাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি সেগুলো নেই। আমার নতুন জুতার বদলে চোর তার পুরনো, ছেঁড়া জুতা রেখে গেছে সেখানে!"
ইওয়ান্থার মতো আরো অনেক শ্রীলঙ্কান নাগরিকই দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের উপর ক্ষুদ্ধ। তার আরেক ভাই ইউনূস বলেন, "সে হচ্ছে আরেকজন রাজাপাকশে।"
সময়ের অপচয়
আগামী সপ্তাহে পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রার্থী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকেই এগিয়ে রাখছেন অনেকে। যদিও বিক্ষোভকারীরা জানিয়েছে, তারা রনিলকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মানবে না এবং দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারাও একই মত পোষণ করেছেন।
তবে যে-ই দেশের নেতৃত্ব নিক না কেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট সমাধান করা সত্যিকার অর্থেই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রথমেই যা করতে হবে তা হচ্ছে, অর্থনৈতিক সাহায্য চেয়ে আইএমএফ এর সাথে একটি বেইলআউট চুক্তি করা এবং দেশে আরো বেশি পরিমাণ জ্বালানি নিয়ে আসা।
এদিকে গাড়ি চালকদের ডিজিটালভাবে রেজিস্টার করা এবং সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে তারা ঠিক কী পরিমাণ জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবে তা হিসাব রাখার জন্য একটি স্কিম তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া শেষ হতে কয়েক বছর লেগে যাবে এবং শ্রীলঙ্কার আগের অবস্থা ফিরে পেতে এখনো অনেক কঠিন অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া বাকি।
পেট্রোলের জন্য লম্বা লাইনের শেষ প্রান্তে থাকা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্মী চন্দ্র আগামী এক সপ্তাহ নিজের গাড়িতেই কাটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার গাড়িতে সামান্য পরিমাণ জ্বালানিও অবশিষ্ট নেই, তাই বাকিটা পথ গাড়ি ঠেলে নিতে হবে তাকে। তার ভাষ্যে, তিনি স্রেফ নিজের সময় নষ্ট করছেন এভাবে!
সূত্র: বিবিসি