শ্রীলঙ্কার সংকট বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্য সতর্কবার্তা
শ্রীলঙ্কা এখন নজিরবিহীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট দেশ ছেড়ে পালানোর পর ক্ষমতা থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর প্রধানের মতে, শ্রীলঙ্কার মতো বিপর্যয় ঘটার ঝুঁকি রয়েছে এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশেও।
'উচ্চ ঋণহার ও সীমিত পলিসি স্পেসের দেশগুলোকে বাড়তি চাপ মোকাবিলা করতে হবে। এসব দেশ শ্রীলঙ্কাকে সতর্কতা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে,' শনিবার (১৬ জুলাই) বলেছেন আইএমএফ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা।
তিনি আরও জানান, বিগত টানা চার মাস ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের পুঁজির বাইরে চলে যাওয়া দেখছে। এভাবে চলতে থাকলে এসব দেশগুলোর উন্নত অর্থনীতিকে ধরার স্বপ্ন আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অভাবে দেশটি এখন এর জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার, জ্বালানি, ঔষধ ইত্যাদি কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে, গত বছরের তুলনায় খাবারের দাম ৮০ শতাংশ বেড়ে গেছে। মার্কিন ডলার ও অন্যান্য বৈশ্বিক মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপি চলমান বছরে অতিমন্দার মুখে পড়েছে।
অনেকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য গোতাবায়া রাজাপাকসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। করোনা মহামারির কারণে সার্বিক অবস্থা আরও করুণ হয়েছে।
গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কার বিশাল অংকের ঋণ জমা হয়েছিল। গত ২০ বছরে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে বৈদেশিক ঋণখেলাপির কারণে গত মাসে দেউলিয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কা।
শ্রীলঙ্কা আইএমএফ'র সঙ্গে তিন বিলিয়ন ডলার বেইলআউট প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আলোচনা বর্তমানে থমকে আছে।
কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি বুদ্ধি ও সুদহারে উত্থান, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চ ঋণহার, সংকুচিত হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ- এ সমস্যাগুলো এশিয়া অঞ্চলের অন্য দেশগুলোকেও আক্রান্ত করছে।
উন্নয়নশীল এ দেশগুলোর অনেকগুলোকেই ঋণ দেওয়ার অগ্রভাগে আছে চীন। তাই এসব দেশের নিয়তি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও কিছুটা চীনের হাতে। তবে বেইজিং কোন শর্তে ঋণ দিয়েছে অথবা এসব ঋণের পুনর্গঠন (রি-স্ট্রাকচার) কীভাবে হবে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা খুব একটা পাওয়া যায়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-এর অ্যালান কিনান বলেন, চীনের দোষ হলো এটি উন্নয়নশীল এ দেশগুলোতে এমন সব ব্যয়বহুল অবকাঠামোগত প্রকল্প হাতে নেওয়ার উৎসাহ ও সমর্থন যুগিয়েছে, যেগুলো থেকে ওই দেশগুলো বড় ধরনের কোনো অর্থনৈতিক উপযোগ ফেরত পায়নি।
বাংলাদেশ
২০২২ সালের মে মাসে গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি দেখে বাংলাদেশ। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি ৭.৪২ শতাংশে বেড়ে দাঁড়ায়।
বৈদেশিক মুদ্রা হ্রাস পেতে শুরু করলে সরকার অ-প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া রেমিট্যান্স পাঠানোর নিয়ম সহজ করা ও সরকারি কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণের হার কমানোর পদক্ষেপও নেয় বাংলাদেশ সরকার।
'বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ও শ্রীলঙ্কার মতো যেসব অর্থনীতি বর্তমানে ঘাটতিতে আছে, সেসব দেশের সরকার ভর্তুকি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসুবিধার মুখে পড়ছে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য আইএমএফ ও অন্যান্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়েছে,' বলেন কিম এং তান নামক একজন স্বাধীন অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
'বাংলাদেশের সরকারকে এর ব্যয়ের খাতগুলোর গুরুত্বে নতুন করে রদবদল আনতে হয়েছে এবং ভোগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়েছে,' বলেন এ বিশ্লেষক।
পাকিস্তান
জ্বালানির ওপর ভর্তুকি বন্ধ করার পর মে মাসের শেষে পাকিস্তানে জ্বালানির দাম ৯০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। পাকিস্তান বর্তমানে আইএমএফ'র সঙ্গে বেইলআউট প্যাকেজ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।
দেশটিতে বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। জুন মাসে দেশটিতে গত ১৩ বছরে মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ ২১.৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
শ্রীলঙ্কা, ও লাওসের মতো পাকিস্তানও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে ভুগছে।
আইএমএফ'র অন্যতম চাহিদা হলো পাকিস্তানের সরকারি রাজস্ব ও ব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য কমানো। এ উদ্দেশ্যে দেশটি বড় ধরনের শিল্পের ওপর এক বছরের জন্য ১০ শতাংশ করারোপ করেছে।
'এসব তহবিল আয়ত্ত করতে পারলে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দাতাদেশও পাকিস্তানকে ঋণ দিতে পারে,' মন্তব্য করেছেন এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস-এর বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু উড।
এসব সমস্যা সমাধানের শপথ করলেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা আমদানিকারক দেশ। গত মাসে দেশটির একজন মন্ত্রী জনগণকে কম চা পানের আহ্বান করেছেন যাতে আমদানির বিল কমানো যায়।
পাকিস্তানের চারভাগের এক ভাগ ঋণ চীনের কাছ থেকে নেওয়া।
লাওস
গত কয়েক মাস ধরে বৈদেশিক ঋণখেলাপির কারণে দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে লাওস।
বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি দেশটির জ্বালানি সরবরাহে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে। এছাড়া বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যের দামও।
স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, দেশটিতে জ্বালানির জন্য মানুষকে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, এবং অনেক বাড়ির মালিক বিদ্যুৎবিল দিতে পারছেন না।
এ বছর দেশটির মুদ্রা কিপ-এর ডলারের বিপরীতে আরও বেশি দরপতন ঘটেছে। লাওস ইতোমধ্যে ঋণের ভারে জর্জরিত একটি দেশ। এসব ঋণ পরিশোধ ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি।
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কিন্তু ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটির সর্বমোট বার্ষিক বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও প্রায় রিজার্ভের সমপরিমাণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন বড় অবকাঠামোর জন্য লাওসকে বিশাল অংকের ঋণ দিয়েছে। দেশটিতে কেবল গত বছরেই ১৫ বিলিয়ন ডলার সমমানের ৮১৩টি প্রকল্পের সূচনা করেছে চীন।
১৯৭৫ সাল থেকে লাওসের ক্ষমতায় রয়েছে লাও পিপল'স রেভলুশনারি পার্টি। তাদের ব্যর্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে আঙুল তুলছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
মালদ্বীপ
মালদ্বীপের সরকারি ঋণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আয়তনে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ঋণের পরিমাণ এখন দেশটির জিডিপি'র ১০০ শতাংশের বেশি।
শ্রীলঙ্কার মতো করোনা মহামারি মালদ্বীপের পর্যটন-ভিত্তিক অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে।
পর্যটন-ভিত্তিক অর্থনীতির ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করা দেশগুলোর সরকারি ঋণের হার সাধারণত বেশি হয়। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের মতে অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যের অভাবে সৃষ্ট উচ্চ জ্বালানি ব্যয়ের কারণে মালদ্বীপ বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপিমর্গান আশঙ্কা করছে, ২০২৩ সালের শেষনাগাদ ঋণখেলাপির কারণে দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে মালদ্বীপ।
খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি মহামারি কাটিয়ে ওঠা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে আবারও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। বছরের পর বছর ঋণ নিয়ে আসা উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন বুঝতে পারছে তাদের দুর্বল ভিত্তি তাদেরকে এই বৈশ্বিক শকওয়েভের সামনে আরও বেশি অসহায় করে তুলেছে।
সূত্র: বিবিসি