বিশ্বের দরিদ্রদের বাঁচাতে রাশিয়ার সাথে সংলাপে বসতে হবে
পশ্চিমা দেশগুলোয় নাগরিকরা ক্ষুদ্ধ। তাদের রাজনৈতিক অভিজাত সম্প্রদায়–যাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে সঠিক পথে নেতৃত্বদানের কথা–তারাই ইউক্রেন নীতিতে জনতাকে নিয়ে যাচ্ছেন ভুল পথে। অথচ, ভবিষ্যৎ নির্ধারণে তাদের আরও প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়ার সুযোগ আছে।
(পররাষ্ট্রনীতি বা অর্থনীতিতেও) নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা আসলে জনকল্যাণের শত্রু এই সরল নীতির ভিত্তিতে নিতে হবে প্রজ্ঞামূলক সিদ্ধান্ত। জি-৭ দেশগুলিকে অনুধাবন করতে হবে, আপাত ত্রুটিপূর্ণ সমাধানই এখন তাদের জনতার মন জয় করতে পারে। আর এর মাধ্যমে, খাদ্য ও জ্বালানির গগণবিদারী মূল্যের ভুক্তভোগী তৃতীয় বিশ্বের শত শত কোটি জনতাকেও সাহায্য করা হবে।
মোদ্দা কথা, নৈতিক গুরুত্ব দিতে হবে বৈশ্বিক জনসংখ্যার যারা সবচেয়ে প্রান্তিক, সেই ১০-২০ শতাংশ দরিদ্রের দুর্ভোগ লাঘবে।
সাম্প্রতিক সময়ের আমেরিকার সেরা রাজনৈতিক দার্শনিক জন রলস-ও কিন্তু বলেছেন, সেই সমাজই সেরা–যেখানে সবচেয়ে দরিদ্র্য মানুষের দুর্দশা দূরীকরণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তিনি তার ন্যায্যতা/ সুবিচারের তত্ত্বে (এ থিওরি অব জাস্টিস) উল্লেখ করেছেন, সুবিচারের মৌলিক নীতিকে সমর্থন করার মতো যদি কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক অসমতাও থাকে, 'তবে তা সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক ও সুবিধা বঞ্চিত সদস্যদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে'।
আজ বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তিনটি প্রধান কারণে দূরবস্থার শিকার। প্রথমত, উন্নত বিশ্ব বিশেষত আমেরিকার বিপুল কোভিড-১৯ রিলিফ প্যাকেজ, যার মাধ্যমে বিশ্বে ছড়ায় মূল্যস্ফীতির আগুন।
সম্প্রতি প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের অর্থনীতিবিদ মার্টিন উলফ সরকারি এ সহায়তা নিয়ে লিখেছেন যে, '(উন্নত বিশ্বের) ২০২০ ও ২০২১ সালে বাস্তবায়িত আর্থিক ও মুদ্রানীতির মেলবন্ধন মূল্যস্ফীতির আগুন লাগায়'।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়–তখন মস্কোর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমারা। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্য ব্যাপকহারে চড়েছে। অথচ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও রাশিয়ার গ্যাস কিনতে আরও বেশি অর্থ পরিশোধ করেছে ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন)।
এ বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর এপর্যন্ত রাশিয়াকে তেল ও গ্যাসের মূল্য বাবদ ৬ হাজার কোটি ডলার পরিশোধ করেছে ইউরোপ। একইসময়, চীন ও ভারত মস্কোর কাছ থেকে খুব বেশি পরিমাণে তেল কিনছে–এমন অভিযোগও তোলে পশ্চিমারা।
পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা নিয়ে ক্ষোভই প্রকাশ করেছিলেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুভ্রামনিয়াম জয়শঙ্কর । তিনি বলেন, আমরা এক মাসে যা কিনছি, ইউরোপ তা এক বেলায় কিনছে'।
বিশ্বের কারখানাখ্যাত চীনের খবরও ভালো নয়। সেখানে কোভিডের বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য সহনশীলতার প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই যেন ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস। সংক্রমণ বন্ধে ব্যাপকহারে শিল্পাঞ্চল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এমনকী বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সাংহাই নগরী এ বছরের মার্চ থেকেই লকডাউনে। চীন থেকে পণ্য ও কাঁচামালের সরবরাহ ব্যাহত হওয়াও মূল্যস্ফীতির বৈশ্বিক আগুনে জ্বালানি দিচ্ছে।
এই অবস্থায় যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া কী? একটি নিখুত সমাধান খোঁজা? নাকি নিখুঁত নয়, তবে আপাতত কার্যসিদ্ধির জন্য যথেষ্ট এমন সব সমাধান গ্রহণ করে- বিশ্বের বিপুল দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা?
পশ্চিমা দুনিয়া নিখুঁত সমাধানের চেষ্টা করছে। কিন্তু, বাকী বিশ্ব চাইছে আপাতত ত্রুটিপূর্ণ সমাধান গ্রহণ করে হলেও, তাদের দুর্দশা লাঘব করা হোক।
ইউক্রেনে যে লক্ষ্যটি তারা অর্জন করতে চাইছে–সেটাই পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে নিখুঁত সমাধান। আর তা হলো- দেশটি থেকে সম্পূর্ণরুপে রুশ সেনা প্রত্যাহার। এনিয়ে কোনো আপস করা হবে না। পশ্চিমারা যদি এই লক্ষ্যপূরণ করতে পারে, তাহলে তাদের তাই করা উচিত। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে–ইউক্রেনে এই নিখুঁত সমাধান অর্জনের সম্ভাবনা আসলে 'শূন্য'।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালক এনগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধ চরম মানবিক দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। এতে খুব স্পর্শকাতর সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। এই অভিঘাত পুরো বিশ্বজুড়েই বোঝা যাবে, বিশেষত স্বল্প আয়ের দেশগুলিতে। এসব দেশে খাদ্য কিনতেই গৃহস্থালি ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশ চলে যায়–এখন বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে দরিদ্র মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে'।
এই বাস্তবতায় ইউক্রেন প্রসঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ সমাধানটি কী?
প্রথম পদক্ষেপ হলো- একটি সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতি কার্যকরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। কারণ, যুদ্ধ চলতে থাকলে প্রতিদিন শত শত মৃত্যু ঘটতে থাকবে। শুধু যুদ্ধ থামলেই হবে না, ইউক্রেনীয় কৃষকদের হাতে চলতি বছরেই পৌঁছে দিতে হবে দরকারি সার ও কীটনাশক। নাহলে ২০২৩ সালেও দেশটি বিশ্বের খাদ্য ঘাটতি পূরণে অবদান রাখতে পারবে না। এভাবে চলতি বছরেই যদি ইউক্রেনে ফসল উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে ফসল সংগ্রহের আগামী মৌসুমে বিশ্ব পাবে বিপুল শস্য চালান। শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউক্রেন থেকে যত বেশি চালান আনা যাবে–ততোটাই দুর্ভোগ কমবে বৈশ্বিক দরিদ্র্যদের।
দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো–রাশিয়ার সাথে আলোচনার উদ্যোগ। সংলাপ চলতে পারে দুই পর্যায়ে। একটি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে। অন্যটিতে অংশ নেবে রাশিয়া ও পশ্চিমারা। এতে একদিকে যেমন হাজার হাজার ইউক্রেনীয়র প্রাণরক্ষা হবে, তেমনি পুরো দুনিয়া ফেলতে পারবে স্বস্তির নিঃশ্বাস।
শেষ পদক্ষেপটাই সবচেয়ে কঠিন। তার কারণ ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা দুনিয়া সম্পূর্ণ দুটি ভিনগ্রহের বাসিন্দা। এই বিরোধের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নেই। তবে সংলাপ শুরু হলে সেদিকে অগ্রগতি আসবে, বিশেষত যদি আরও বেশি সংখ্যক দেশকে এই সংলাপে যুক্ত করা যায়।
আগামী ১৫-১৬ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় সমবেত হবেন জি-২০ সম্মেলনে দেশগুলোর সরকার প্রধানেরা। সম্মেলনে ভ্লাদিমির পুতিনকে আমন্ত্রণ না জানানোর জন্য পশ্চিমাদের ইন্দোনেশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত হবে না। আবার পুতিন যোগ দিলে তারা যদি সম্মেলন বর্জন করে- সেটি হবে আরও বড় ভুল।
'তারা বিশ্বের মাত্র ১২ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করেন'- পশ্চিমা নেতাদের প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে এই পরিসংখ্যান মুখস্থ করা উচিত।
নভেম্বরে পুতিনকে যদি জাকার্তায় আসার সুযোগ দেওয়া হয়–তাহলে তিনি পশ্চিমাদের বক্তব্য যেমন সরাসরি শুনবেন, তেমনি শোনার সুযোগ পাবেন বাকী বিশ্বের মতামতও। তীব্র অনাস্থা থাকায় পুতিন হয়তো পশ্চিমাদের কথায় কান দেবেন না, তবে তিনি অন্যদের কথা অবশ্যই শুনবেন। তাই পুতিনকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানোর দাবি তুলে পশ্চিমারা আসলে নিজেদের পায়েই কুড়াল মারছে।
রাশিয়াকে পরাজিত করার নিখুঁত সমাধান অর্জনের লক্ষ্য থেকেই পুতিনকে বাদ দিতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু, তাদের কাঙ্ক্ষিত সমাধান কোনোদিন পূরণ হবার নয়।
তাই ইন্দোনেশিয়াসহ জি-২০ সদস্য অন্য দেশগুলির যুক্তি মেনে ইউক্রেন ইস্যুতে কোনোপ্রকার আপসরফার চেষ্টা শুরু করা উচিত পশ্চিমাদের। এতে ইউক্রেনবাসীর জীবন যেমন রক্ষা হবে- তেমনি সীমাহীন দুর্ভোগের চক্র থেকে মুক্তি পাবে শত শত কোটি দরিদ্র মানুষ। সহজ কথায়, এক্ষেত্রে কার্যসিদ্ধিমূলক সমাধানই সবচেয়ে নৈতিক সমাধান।
- লেখক: কিশোর মাহবুবানি সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া অধ্যয়ন ইনস্টিটিউটের সম্মানীয় ফেলো। স্ট্রেইটস টাইমসে প্রকাশিত তার দীর্ঘ লেখনীর সারসংক্ষেপ এই নিবন্ধটি এশিয়া টাইমস থেকে অনূদিত হয়েছে
- সূত্র: এশিয়া টাইমস