বিপ্লবের আগে-পরে: ইরানে নারী স্বাধীনতা
হিজাব 'সঠিকভাবে' না পরে রাস্তায় বেরোনোর শাস্তি হিসাবে ইরানের রাজধানী তেহরানে মাহসা আমিনি নামে এক তরুণীকে আটক করে পুলিশ। পুলিশ হেফাজতেই মৃত্যু হয় তার। মাহসার মৃত্যুর পর রাস্তায় নেমে হিজাব পুড়ানো থেকে শুরু করে মাথার চুল কেটে ফেলা— বিভিন্ন পন্থায় প্রতিবাদে নেমেছে সে দেশের জনগণ।
কিন্তু আজ থেকে তিন দশক আগেও হিজাব পরিধান করা নিয়ে তটস্থ থাকতে হত না ইরানের নারীদের। সেই সময়ের তোলা ছবি থেকেই এ বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা যায়।
ইসলামিক বিপ্লবের আগে হিজাব পরার পাশাপাশি জিন্স, মিনি স্কার্ট এবং শর্ট-হাতা টপ পরেও ইরানের রাস্তায় স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াতে পারতেন সেই দেশের নারীরা। সমুদ্রসৈকতে বিকিনি পরেও ঘুরতে দেখা যেত তাদেরকে।
ইরানের রাজপরিবারের পতনের আগে তেহরানের বুকে দেখা যেত নারীদের সেলুনও। খোলা চুলে দিব্যি সেলুনে যাতায়াত করতে পারতেন তারা। ইসলামিক বিপ্লবের পর সেলুন থাকলেও, সে সব সেলুনে নারীদের আনাগোনা অনেক কমেছে।
১৯৭৭ সালের আগে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন সে দেশের বহু নারী। ১৯৭৯ সালে বিপ্লব শুরুর সময় সে দেশের বহু নারী উচ্চশিক্ষিত ছিলেন।
ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ভর্তির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাছাড়া গ্রামে বসবাসকারী রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা যাতে বাড়ি থেকে দূরে পড়াশোনা করার সুযোগ পান, তা নিয়েও কর্তৃপক্ষ অনেক উদ্যোগ নেয়।
এ পরিস্থিতি বদলানো শুরু হয় ১৯৭৯ সালে রাজতন্ত্র-বিরোধী বিপ্লবের সময় থেকে। পহলভি রাজবংশের শাসক শাহ মহম্মদ রেজা পহলভিকে সরিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে সে বছর ক্ষমতায় আসে ইসলামিক রিপাবলিক সরকার। রাজপরিবারের উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায় ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি এবং রীতিনীতি।
ইরান থেকে রাজপরিবারকে উৎখাত করার এই বিপ্লবকে সমর্থন জুগিয়েছিল বিভিন্ন বামপন্থী ও ইসলামপন্থী সংগঠনও। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা ইরানি বিপ্লব বা ইসলামিক বিপ্লব নামে পরিচিত।
ক্ষমতায় আসার পরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি আদেশ দেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের সব নারীকে হিজাব পরে থাকতে হবে। এর বিরুদ্ধে সেই সময়েও পথে নামেন ইরানি নারীরা।
১৯৭৯ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ইরানের সর্বস্তরের নারী খোমেইনির এই নতুন নির্দেশের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন।
খোমেইনির সরকার থেকে আরো নির্দেশ আসে, ইরানের নারীরা বাড়ির ভিতরে যা খুশি পরিধান করতে পারেন, কিন্তু বাইরে বেরোলে তাদের 'সংযত' ভাবে বেরোতে হবে।
এমনকি নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও নতুন নিয়ম জারি করা হয়। নির্দেশ দেওয়া হয়, নারী এবং পুরুষদের একই ঘরে নামাজ পড়া যাবে না।
এরই ধারাবাহিকতায় সমু্দ্রসৈকতে নারীদের সাঁতারের পোশাক পরাও নিষিদ্ধ করা হয়। ইরানে নারী এবং পুরুষদের একসঙ্গে ফুটবল ম্যাচ দেখার উপর আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি না করা হলেও বর্তমানে সে দেশের নারীদের প্রায়ই স্টেডিয়ামের প্রবেশপথে আটকানো হয়।
আয়াতুল্লাহ খোমেইনির অধীনে নারীদের পোশাকের ওপর চাপানো এই নিয়মনীতি ক্রমেই আরো কঠোর হতে থাকে। দেশটির শীর্ষস্থানীয় ধর্মগুরু এবং মন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত বেশ কয়েকটি প্রজ্ঞাপনের পর হিজাব ছাড়া নারীদের আর পাবলিক বিল্ডিংয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
এরপর ১৯৮৩ সালে প্রণীত একটি নতুন আইনে হিজাব না পরার শাস্তি হিসেবে ৭৪ বেত্রাঘাতের নীতি ধার্য করা হয়।
যদিও সংস্কারপন্থী রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ খাতামির অধীনে জনসমক্ষে পোশাক এবং আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার রাষ্ট্রীয় কঠোরতা হ্রাস পায়, ২০০৫ সালে তার মেয়াদ শেষে দেশটির সুপ্রিম কাউন্সিল 'সতীত্বের সংস্কৃতি বিকাশের কৌশল' নামে একটি রেজুলেশন গ্রহণ করে।
মোরাল পুলিশের যাত্রা শুরু মূলত এখান থেকেই। খাতামির উত্তরসূরি, অতি-রক্ষণশীল মাহমুদ আহমাদিনেজাদের অধীনে নৈতিকতা রক্ষাকারী পুলিশ বা গাশত-ই-এরশাদ গঠিত হয়।
পরবর্তীকালে ২০০৯ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোরাল পুলিশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্ক হয়। সেসময় সংস্কারপন্থী প্রার্থীরা এই বাহিনী ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বারবার তাদের কঠোর আচরণের ভিডিও বা প্রমাণ সামনে আসলেও মোরাল পুলিশ সরানোর বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
- সূত্র: বিবিসি ও রয়টার্স