ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন পাঠানোর পরিকল্পনা করছে ইরান!
রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিশ্রুতি আরও দৃঢ় করছে ইরান। ইউক্রেন যুদ্ধে এরমধ্যেই ইরানি ড্রোন ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছে রাশিয়া। এবার শুধু ড্রোন নয়, স্থানীয়ভাবে তৈরি ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম (সারফেস টু সারফেস) মিসাইল সরবরাহ করতেও গোপনে রাজি হয়েছে ইরান। এ ধরনের মিসাইল দিয়ে ইউক্রেনীয় শহর ও সেনা অবস্থানকে সহজেই নিশানা করা যাবে। খবর ওয়াশিংটন পোস্টের
প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যমটি আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) এবং তার মিত্র দেশগুলির নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে এসব কথা জানিয়েছে।
বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর বিপুল সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস হয়েছে রুশ বাহিনীর। এই বাস্তবতায়, তেহরান থেকে অস্ত্রের প্রবাহ সেই ঘাটতি পূরণে সহায়ক হবে। এছাড়া, গত সপ্তাহে ইউক্রেনীয় শহরগুলোয় ঝাঁকে ঝাঁকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে রুশ বাহিনী, ফলে লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম বা প্রিসিসান গাইডেড মিউনিশেনর মজুতও পড়তির দিকে।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সাথে সাথে আত্মঘাতী ইরানি ড্রোনও ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুদিন আগেই কয়েকটি স্বাধীন গণমাধ্যম ইউক্রেনীয় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা ইরানি ড্রোনের ছবি প্রকাশ করে। এতে করে, মস্কোকে ড্রোন সরবরাহ করা হয়নি বলে তেহরান যে দাবি করেছিল– সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আকাশপথের রুশ হামলায় ইরানি ড্রোন ব্যবহারের বিষয়ে এরপর পেন্টাগনের কর্মকর্তারাও আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। এছাড়া, কিছু ড্রোন ভূপাতিত করতে সফলও হয় ইউক্রেন।
ড্রোন বিক্রির পর এবার মস্কোর সামরিক সরবরাহকারীর ভূমিকা সম্প্রসারণ করতে চায় তেহরান। তারই অংশ হিসেবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়ায় যান ইরানের প্রতিরক্ষা খাতের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা। তারা গিয়েছিলেন, অতিরিক্ত আরও দুটি অস্ত্র চালান পাঠানোর চুক্তি চূড়ান্ত করতে। এই চালানগুলোয় রয়েছে দুই ধরনের ইরানে তৈরি ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মার্কিন মিত্র একটি দেশের কর্মকর্তা এ বৈঠকের কথা জানান। ওই দেশটি ইরানের সমরাস্ত্র বিষয়ক সকল গতিবিধির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখে।
উক্ত দেশটি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের গোয়েন্দা তথ্যের একটি বিশ্লেষণী প্রতিবেদন শেয়ার করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ফাতেহ-১১০ এবং জুলফিকার ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম চালানটি পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরানের সমরাস্ত্র শিল্প। স্বল্প-পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল দুটি যথাক্রমে ৩০০ ও ৭০০ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে পারে। ইরান এ চালান পাঠালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রথম এ ধরনের মিসাইলের চালান পাবে রাশিয়া।
এই ব্রিফিং পাওয়া দুই কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। তবে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে চরম গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়, এজন্য তারা নিজেদের নাম ও জাতীয়তা প্রকাশ না করার শর্ত দেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে।
এর আগে এই কর্মকর্তারাই ইরানের তৈরি মোহাজের-৬ এবং শাহিদ সিরিজের ড্রোন ছবি দেখে শনাক্ত করেন। দুই ধরনের ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে পরীক্ষা করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। এতে দেখা গেছে, ইরান থেকে আমদানির পর ড্রোনগুলির গায়ে নতুন রঙ করাসহ সেগুলিকে রাশিয়ান নাম দেওয়া হয়েছে।
ক্ষেপণাস্ত্র চালান সম্পর্কে বিশেষ গোয়েন্দা ব্রিফিং পাওয়া ওই কর্মকর্তারা আরও জানান, ড্রোন বিমানের নতুন চালান পাঠানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান। এরমধ্য থাকবে কয়েক ডজন মোহাজের-৬ এবং বড় সংখ্যায় শাহিদ-১৩৬।
শাহিদ-১৩৬ এরমধ্যেই ইউক্রেনীয় বাহিনীর কাছে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। আত্মঘাতী এ ড্রোনটি প্রায় ১,৫০০ মাইল উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে একটি মিসাইলের মতো করেই আঘাত হানে ও তারপর বিস্ফোরিত হয়।
মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, ইউক্রেনের রুশ অধিকৃত এলাকায় গিয়ে ড্রোন পরিচালনার প্রশিক্ষণও দিয়েছেন ইরানের কারিগরি পরামর্শদাতারা।
এদিকে রাশিয়ায় ইরানি অস্ত্রের আসন্ন এসব চালান সম্পর্কে ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলি। মিসাইল চালান সম্পর্কে জানতে চাইলে, একই প্রতিক্রিয়া মেলে রাশিয়া ও ইরানের কর্মকর্তাদের থেকেও।
তবে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, 'ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইউক্রেন যুদ্ধে কোনো অস্ত্র সরবরাহ করেনি এবং করবেও না'। শনিবার তার পর্তুগিজ সমকক্ষের সাথে এক বৈঠকের সময় তিনি একথা বলেন। এসময় তিনি আরও বলেন, 'আমরা মনে করি, দুই পক্ষকে অস্ত্র সজ্জিত করার ঘটনা এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করবে'।
ইরান বরাবরই রাশিয়ার কাছে ড্রোন বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারই সাথে সঙ্গতি রেখে গত ৩ অক্টোবর ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানিও রাশিয়াকে কোনো ধরনের ড্রোন দেওয়ার ক্ষেত্রে ইরানের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, 'রাশিয়াকে ড্রোন সরবরাহের বিষয়ে এ ধরনের সব প্রতিবেদন ভিত্তিহীন'। ইরানের নিরপেক্ষতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করে কানানি বলেন, 'সংঘাত পরিহার করে, উভয় পক্ষ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের সমস্যার সমাধান করুক এটাই আমাদের কাম্য'।
গোয়েন্দা তথ্যের নেপথ্যের প্রমাণ সম্পর্কে ইউক্রেন সরকারকেও জানানো হয়েছে বলে দেশটির একজন কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে জানান। তিনি বলেন, আমাদের বিশ্লেষণেও উঠে এসেছে যে দক্ষিণ ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর ব্যবহৃত অধিকাংশ ড্রোনই ইরানের তৈরি।
ড্রোন সরবরাহ করায় সম্প্রতি তেহরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি করেছে কিয়েভ। এই হুমকি মোকাবিলায় কিছুদিন আগে ন্যাটো দেশগুলির কাছে জরুরি ভিত্তিতে আরও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহের আহব্বান জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি।
বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণে জেলেনস্কি বলেন, 'রাশিয়ার সন্ত্রাসী হামলা থেকে আমাদের আকাশসীমা মুক্ত করতে হবে'।
এদিকে ইরানের মতো রাশিয়াও ইরানি অস্ত্রের চালান সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদগুলিকে নাচক করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ এগুলি 'গালগল্প' বলে দাবি করেন।
তবে স্বীকার না করলেও, ইউক্রেনের রণাঙ্গনে কার্যকারিতার স্বাক্ষর রাখছে ইরানি ড্রোন। এরমধ্যেই এগুলির সাহায্যে ইউক্রেনীয় বাহিনীর অনেক ট্যাংক ধ্বংস করা হয়েছে। হামলা চালানো হয়েছে বেসামরিক স্থাপনাতেও।
এই অবস্থায়, ক্ষেপণাস্ত্রের চালান পেয়ে রাশিয়া আরও শক্তিশালী হবে। ক্ষেপনাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিয়েভের বাহিনী যখন সামনে অগ্রসর হচ্ছে তখন এসব শক্তিশালী অস্ত্র গুরুতর হুমকি হয়ে উঠবে।
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট