রাশিয়ার কামিকাজে ড্রোন কী? কীভাবে এই ড্রোন যুদ্ধের গতি পালটে দিচ্ছে?
সম্প্রতি ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার ড্রোন হামলায় ২৫ জনেরও বেশি নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। কিয়েভ কর্তৃপক্ষ বলছে, সংঘাত শুরুর পর থেকে এই প্রথম এত বড় হামলা চালালো রাশিয়া। আল জাজিরা অবলম্বনে।
সাম্প্রতিক এই ড্রোন আক্রমণ শুরু হয় চলতি অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে। ইউক্রেনের অন্তত ১০টি অঞ্চলকে লক্ষ্য করে এ আক্রমণ চালানো হয়েছে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি ইরানের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে হামলায়।
তবে তেহরানের কর্মকর্তারা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন।
সোমবার (১৭ অক্টোবর) বিস্ফোরক বোঝাই, মনুষ্যবিহীন ঝাঁক ঝাঁক 'কামিকাজে ড্রোন' নেমে আসে রাজধানী কিয়েভের ওপরে। শহরের এনার্জি ফ্যাসিলিটিস বা শক্তি কেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করে চালানো এই হামলায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে চারজন।
ইউক্রেনের বিমান বাহিনী জানিয়েছে, তারা একদিনে কমপক্ষে ৩৭টি ড্রোন ধ্বংস করেছে।
কেনো এগুলোকে 'কামিকাজে' ড্রোন বলা হচ্ছে? এর অর্থ কী?
জাপানিজ শব্দ 'কামিকাজে'র অর্থ হলো 'আত্মঘাতী। ড্রোনগুলোকে কামিকাজে বা আত্মঘাতী অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ অন্যান্য ড্রোনের মতো এই ড্রোনগুলো মিশন শেষে ঘাঁটিতে ফিরে আসে না, বরং হামলার স্থানেই ধ্বংস হয়ে যায়। অনেকটা 'সুইসাইড বোম্বিং' বা আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অ্যালেক্স গ্যাটোপোলোসের মতে, এই ড্রোনগুলো লক্ষ্য শনাক্ত করার আগে একটি অঞ্চলের ওপরে ঘোরাফেরা করে। এরপর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হেনে নিজেও সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায়।
ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতোই এই ড্রোনগুলো শত শত কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। তবে, এগুলো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অত ব্যয়বহুল নয়। গ্যাটোপোলোস বলেন, 'কামিকাজে' ড্রোন সস্তা অস্ত্র হলেও এটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দাবি, প্রায় ২ হাজার ৪০০ 'কামিকাজে' ড্রোন কিনেছে রাশিয়া।
ড্রোনগুলো আসছে কোথা থেকে?
ইউক্রেন বলছে, ইরান থেকে ড্রোনগুলো আমদানি করেছে রাশিয়া। ইরানে এই অস্ত্র 'শাহেদ-১৩৬' নামে পরিচিত, যার অর্থ 'বিশ্বাসের সাক্ষী' বা 'শহিদ'।
এদিকে, অস্ত্র সরবরাহের ঘটনায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক তেহরানকে 'ইউক্রেনীয়দের হত্যার' দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ক্রেমলিন।
এর আগে, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর উপস্থিতিকেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের মূল কারণ হিসেবে যুক্তি দিয়েছিল ইরান। তবে এমন কথা বললেও দেশটি এখন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি অস্বীকার করছে।
অন্যদিকে আল জাজিরার গ্যাটোপোলোসও বলেছেন, ড্রোনগুলো রাশিয়ার তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কারণ লো-এন্ড ট্যাকটিকাল, বিশেষ করে সশস্ত্র ড্রোন তৈরিতে মস্কো এখনও অনেকটাই পিছিয়ে।
কিংস কলেজ লন্ডনের আরেকজন বিশ্লেষক সামির পুরির মতে, মস্কো এবং তেহরানের মধ্যে যে কোনো ধরনের অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
তিনি বলেন, "আমি মনে করি, ড্রোনগুলো ইরান থেকেই কেনা হয়েছে এবং সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষাকে বিভ্রান্ত করতে এগুলোর সঙ্গে আলাদা কিছুর মিশ্রণ ঘটিয়ে থাকতে পারে রাশিয়া।"
ড্রোনগুলোর ব্যবহার কি যুদ্ধের গতিতে পরিবর্তন আনতে পারে?
'কামিকাজে' ড্রোন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় সস্তা হলেও এগুলোর দাম একেবারে কম নয়।
সামির পুরি জানান, প্রতিটি ড্রোনের দাম প্রায় ২০ হাজার ডলার। সুতরাং, এটিকে একক অস্ত্র বানিয়ে হামলা চালালে তা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হবে।
তবে ঝাঁকে ঝাঁকে এই ড্রোনের ব্যবহার ইউক্রেনের বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য বিশাল এক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে এমনটিই বলেছেন ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর একজন মুখপাত্র।
কামিকাজে ড্রোনগুলোকে গুলি করে ধ্বংস করতে পারে এমন একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইউক্রেনকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তবে সেই ব্যবস্থা এখনও ইউক্রেনে এসে পৌঁছায়নি এবং এটি আসতে আরও কয়েকমাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
যদিও মনুষ্যবিহীন এই বিমান অস্ত্র ইউক্রেনীয়দের জন্য নতুন আতঙ্কের কারণ, তবু এটি হয়তো 'গেম চেঞ্জার' বা সংঘাতের গতিপথ পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো কাজ কারবে না বলেই মন্তব্য করেছেন সামির পুরি। কারণ এর বিপরীতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা পাঠাবে পশ্চিম।
"এবং এ ধরনের একটি অস্ত্র ব্যবস্থা যুদ্ধের ফলাফল পরিবর্তন করতে পারে না," বলেন তিনি।