ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে ক্রমশ বাড়ছে ইরানের উপস্থিতি
ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে বর্তমানে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে রাশিয়া। ফলে দেশটি এখন ইরানের ওপর নিজেদের নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের আঞ্চলিক বৈরীশক্তিগুলোর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন-এর।
মার্কিন গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর সঙ্গে পরিচিত এমন সূত্রের বরাত দিয়ে সিএনএন জানিয়েছে, ইরান সম্প্রতি ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান বাহিনীকে ইরানের তৈরি ড্রোন ব্যবহারে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিতে সামরিক প্রশিক্ষক পাঠিয়েছে।
ইরানের তৈরি শহীদ ১৩৬ ড্রোন ব্যবহার করে কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
যদি সত্যিই ইরানি সামরিক ব্যক্তিরা ক্রিমিয়ায় প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তার ফলে এ যুদ্ধে রাশিয়ার মিত্র হয়ে ইরানের জড়িয়ে পড়া ভিন্ন মোড় নেবে। দুই দেশের মধ্যে আগে থেকেই যে সামরিক সহযোগিতা ছিল, তাও নতুন মাত্রা পাবে।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাশিয়া জানিয়েছিল, ইরান তাদেরকে ভূমি থেকে ভূমিতে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল সরবরাহ করতে পারে। তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি রাশিয়ার এ দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, 'ইরান সবসময় ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার বিরোধিতা করেছে।'
দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও ইরান ও রাশিয়া এখন আগের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। 'কারণ উভয় দেশের কাছেই তাদের জাতীয়শত্রুর ধারণা একই রকমের,' বলেন ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স ডেমোক্রেসিজ-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো বেহনাম বেন টালেব্লু। 'তাদের কাছে শত্রুর ধারণাটি হলো, একটি অ-আঞ্চলিক শক্তি তাদের বিরুদ্ধে একটি আঞ্চলিক শক্তিকে জড়ো করেছে,' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে টালেব্লু বলেন।
ইরান যদি রাশিয়ার কাছে মিসাইল সরবরাহ করে, তার অর্থ দাঁড়াবে দেশটি 'এর সবচেয়ে নিখুঁত অস্ত্রগুলোর কিছু অংশ ইউরোপের দিকে পাঠাচ্ছে,' তিনি বলেন। ইরানের রাশিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়াকে পশ্চিমের সঙ্গে বৃহত্তর যুদ্ধে জড়ানোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এ বিশ্লেষক।
রাশিয়ার ইউক্রেনে আক্রমণের পর ইরান ও রাশিয়া দুই দেশই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খাতে একে অপরকে সহায়তা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা এ দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্কে এবার সামরিক সহায়তা সর্বশেষ মাত্রা হিসেবে যোগ হলো।
গত মঙ্গলবার ইরানের সুপ্রিম লিডারের একজন শীর্ষ সামরিক এইড ইয়াহিয়া সাফাভি বলেছিলেন, বিশ্বের ২২টি দেশ বর্তমানে ইরানের ড্রোন কিনতে চাইছে।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ইরান এর বেশিরভাগ অস্ত্র আমদানি করত। বর্তমানে দেশটি এর সামরিক সরঞ্জামের ৮০ শতাংশের বেশি নিজেরাই তৈরি করে বলে সাফাভির বরাত দিয়ে জানিয়েছে দেশটির আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা ফার্স।
ইরান ও রাশিয়া দুই দেশই তেহরানের ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কথা একাধিকবার অস্বীকার করেছে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরানের ড্রোন নিয়ে এতসব খবরকে খারাপ প্রচারণা হিসেবে দেখছে না তেহরান।
অবশ্য রাশিয়ার ইরানি ড্রোন ব্যবহারে ইরানের সামরিক সক্ষমতার চেয়ে রাশিয়ার এ যুদ্ধে মরিয়া অবস্থার কথাই বেশি প্রকাশ করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণমাধ্যমে ইরানি ড্রোন বিষয়ক প্রতিবেদনগুলো ইরানের বিশ্বসংঘাতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতার ভাবমূর্তিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ইরান অবশ্য অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে কখনোই পরিচিত ছিল না। এর আগে কেবল ইরাক, ইয়েমেন ও লেবাননের আদর্শিক মিত্রদের কাছে অস্ত্র পাঠিয়েছিল বর্তমানে আন্দোলন ও বিক্ষোভে ফেটে পড়া দেশটি। সেসবের বৃহৎ উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক রিপাবলিক দেশটির নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা। কবে ইউক্রেন যুদ্ধ তা বদলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট-এর ইরান প্রোগ্রামের অনাবাসিক বিশেষজ্ঞ এরিক লব বলেন, ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর সেই ১৯৮০-এর দশক থেকেই নিজেদের ড্রোন বানানোর চেষ্টা করে আসছে ইরান। এর ফলে ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানোর জন্য যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে দেশটি।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)-এর জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো আনিসেহ বাসিরি তাবরিজি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধে ইরান তাদের ড্রোনগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছে। এর ফলে এসব ড্রোনের সীমাবদ্ধতাগুলো কীভাবে দূর করা যায়, তাও জানতে পারবে দেশটি।
'এটা সম্ভব যে ইউক্রেনে যা হচ্ছে তার ফলে ইরান আরও বেশি ক্রেতা পাবে… বৈশ্বিক অস্ত্র ও ড্রোন শিল্পে বড় খেলোয়াড় হতে চায় দেশটি,' বলেন তাবরজি।
কিন্তু একইসঙ্গে ইরানের শত্রুরাও এর ড্রোনের সক্ষমতার ওপর কড়া নজর রাখবে। ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি গ্রুপগুলো উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে এর আগে যেসব ড্রোন হামলা চালিয়েছিল, সেগুলো সরবরাহের জন্য ইরানাকে দায়ী করেছে ওই দেশগুলো।
ইরানের চিরশত্রু ইসরায়েলও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ইরানের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে বলে জানান ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) একজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেনারেল আমির আবিবি।
'এটা একইসঙ্গে একটি হুমকি ও সুযোগ,' তিনি বলেন। 'যুদ্ধক্ষেত্রে ইরানের সক্ষমতা কতদূর তা জানার এটি একটি বড় সুযোগ। তবে অন্যদিকে আমাদের উদ্বেগের একটি বিষয় হলো এ অস্ত্র হিজবুল্লাহ বা হামাসের মতো দলগুলোর কাছে চলে যেতে পারে।'
'ইউক্রেনে কী হচ্ছে তা আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি,' বলেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা।
তবে তেহরান ও মস্কোর উদীয়মান সামরিক সম্পর্ক পশ্চিমাদের জন্য 'দুঃসংবাদ' বলে উল্লেখ করেন আমির আবিবি। 'কারণ রাশিয়া ও ইরানের মধ্য আমরা অতীতে কখনো এরকম শক্ত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিনি,' বলেন তিনি।