আরও ভয়ঙ্কর আরশ-২ ড্রোন রাশিয়াকে দিচ্ছে ইরান!
বিমান-বিধ্বংসী গোলাগুলিতে অনেকগুলি হারালেও ইউক্রেনে শাহিদ-১৩৬ ড্রোন সফলভাবেই ব্যবহার করছে রাশিয়া। আত্মঘাতী ড্রোনটির আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ইউক্রেনের বেসামরিক স্থাপনা; সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধবংসেও দেখাচ্ছে চমক। খবর ইউরেশিয়ান টাইমস ও জেরুজালেম পোস্টের
যদিও এই অস্ত্র বিক্রিকে অস্বীকার করে আসছে ইরান। তবে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের কাছে নাম না প্রকাশের শর্তে কয়েকজন ইরানি কর্মকর্তা রাশিয়াকে ফাতেহ-১১০ ও জুলফাগার– ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তবে ওই কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়ার কাছে আরশ-২ ড্রোন বিক্রি করা হবে না। কারণ, এটির প্রযুক্তি তাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার জানিয়েছে, ইরান থেকে সম্প্রতি অজ্ঞাত সংখ্যক আরশ-২ ড্রোন কিনেছে রাশিয়া।
শাহিদের মতো এটিও একটি 'লয়টারিং মিউনিশন' বা লক্ষ্যবস্তুর এলাকার আকাশে বিমানের মতোই চক্কর দিতে পারে– এমন এক উড়ন্ত আত্মঘাতী বোমা। ওয়াশিংটন ডিসি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্কটি জানিয়েছে, শাহিদ-১৩৬ এর চেয়ে অনেকগুণ দ্রুত উড়তে পারে আরশ-২, ধ্বংসক্ষমতাও অনেক বেশি।
এটি আবার ইরানি ড্রোন বহরে নতুনতম সংযোজন। গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এক সামরিক মহড়াকালে আরশ-২ ব্যবহার করে দেশটির সেনাবাহিনী। এসময় জানানো হয়, ড্রোনটি ইরানের চিরশত্রু ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফার মতো সুরক্ষিত নগরীতে আঘাত হানার লক্ষ্যেই এটি তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই ড্রোনটি অনায়সে পাড়ি দিতে পারবে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব।
শাহিদ-১৩৬ এর চেয়েও অত্যাধুনিক?
রাশিয়ান সামাজিক মাধ্যমে দেশটির প্রতিরক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ, আরশ-২ ড্রোনকে আক্ষরিক অর্থে এক ধরনের ক্রুজ মিসাইল বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ক্রুজ মিসাইলের চেয়ে এটির গতি বেশ কম। তাতে জ্বালানি খরচও কম হয়; ফলে লক্ষ্যবস্তুর উপরের আকাশে আরও বেশি সময় চক্কর দিতে পারে।
আরশ-২ ড্রোন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানায়নি ইরান। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি অনায়সে ২ হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরে গিয়ে আঘাত হানতে পারবে। আর ওয়ারহেড বা বিস্ফোরন্মুখের আকার শাহিদ-১৩৬ এর চেয়ে অনেকটা বড়।
টেলিগ্রামে রাশিয়ার সামরিক বিষয়াদি নিয়ে লেখালেখি করা একজন রুশ ধারাভাষ্যকার ইউরেশিয়ান টাইমসকে জানান, 'সত্যিই যদি অর্ডার দেওয়া হয়, তাহলে খুব সম্ভবত ইরান আরশের প্রথম সংস্করণ– আরশ-১ মস্কোর কাছে বিক্রি করবে'।
এর সক্ষমতা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ইসরায়েলের আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হামাসের তৈরি আইগাইডেড রকেট ধবংসে সক্ষম। সেদিক থেকে এর কার্যকারিতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু, ইরানের আরশ-২ একটি স্মার্ট অস্ত্র। আরশ-২ লক্ষ্যবস্তুর দিকে উড়ে আসার সময় দিক বদল করতে পারে, বাঁক নিতে পারে এবং এমনকী প্রয়োজনে খুবই নিচু দিয়ে উড়ে যাবে'।
'এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে আমি নিশ্চিত রাশিয়াও ইরানকে এই মিসাইল তথা ড্রোনের প্রযুক্তি উন্নত করতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তার বিনিময়ে, সস্তায় ও বিপুল পরিমাণে উৎপাদনযোগ্য এসব ড্রোন রাশিয়াকে সরবরাহ করবে ইরান। এগুলির ব্যবহার আমাদের নিজস্ব মধ্য-পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইলের মজুতের ওপর চাপ কমাবে'- যোগ করেন তিনি।
কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য আরশ-২ ড্রোনের উড্ডয়নকালীন গতিপথ পাল্টানোর সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। তাদের একজন ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাবেক পাইলট ভিজয়ান্দর কে ঠাকুর। তিনি বলেন, 'আরশ-২ ম্যানুভার করতে পারে বা গতিপথ বদলে নিচু দিয়ে উড়ে যেতে পারে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি জেট ইঞ্জিন চালিত। তাই সবচেয়ে বেশি দূর পাড়ি দেওয়ার জন্য এটিকে মধ্যম উচ্চতাতেই উড়তে হবে। তবে এমন হতে পারে, লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এসে চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে এটি রাডারকে ফাঁকি দিতে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় নেমে আসবে'।
তার মতে, 'একেবেঁকে চলা বা গতিপথ পাল্টাতে দরকার হবে খুবই উন্নতমানের ন্যাভিগেশন বা দিকনির্দেশক সরঞ্জাম। আর এমন সরঞ্জামের ব্যবহার ড্রোন তৈরির খরচ বহুগুণে বাড়াবে। এমনটি করা হলে, এটি হবে রাশিয়ার ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইলের সমান দামের। তবে জেট ইঞ্জিন চালিত হওয়ায় এটি উচ্চ গতির, একারণে ভূমি থেকে বিমান-বিধ্বংসী গোলাগুলির আঘাতে ভূপাতিত হওয়ার ঝুঁকি কমেছে'।
ভয় পাচ্ছে আমেরিকা ও ইউক্রেন
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস গত ১৯ অক্টোবর বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স একযোগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানি ড্রোন বিক্রয় বন্ধের উদ্যোগ নেবে।
প্রাইস জানান, রাশিয়ার এসব ড্রোন ক্রয় নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নং রেজ্যুলেশনের পরিপন্থী।
তার এই বক্তব্য ইরানি ড্রোনের কার্যকারিতার দিকটিও প্রকাশ করে। বিশেষ করে, গেরান-২ নামে ইরানের যে লয়টারিং মিউনিশন (শাহিদ-১৩৬) রাশিয়া ব্যবহার করছে তার সক্ষমতা নিয়ে পশ্চিমাদের উদ্বেগও তুলে ধরছে।
মার্কিন সেন্ট্রাল কম্যান্ডের সাবেক প্রধান জেনারেল কেনেথ ম্যাককেঞ্জি তার নিজ দেশের একটি নিউজ চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ড্রোনটির কার্যকারিতার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
তিনি বলেন, 'একসাথে পর্যাপ্ত সংখ্যায় নিক্ষেপ করলে, তাত্ত্বিকভাবে আপনি যেকোনো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারবেন। কারণ, এটি উড়ে যায় অনেক নিচু দিয়ে। চলতি পথে দুই-চারটি ড্রোন ধ্বংস হলেও ক্ষতি নেই, কারণ শেষপর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস হবেই। আর এগুলি তৈরির খরচও বেশ সস্তা'। ইরান এ ধরনের হাজার হাজার ড্রোন প্রস্তুত করেছে বলেও উল্লেখ করেন এই জেনারেল।
তুলনামূলক উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় রাশিয়ার একটি ক্রুজ মিসাইল উৎপাদনের খরচ। যেমন একটি ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল তৈরিতে রাশিয়াকে প্রায় ১০ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। সে তুলনায়, শাহিদ-১৩৬ ও আরশ-২ ড্রোনের উৎপাদন খরচ ১০ থেকে ৫০ হাজার ডলারের মধ্যে।
ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার জানিয়েছে, ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটিয়ে ড্রোনগুলি কেনা অব্যাহত রাখবে। তবে শাহিদ-১৩৬ এর চেয়ে রাশিয়ান সেনারা আরশ-২ আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে কিনা– তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে।