২৪ ঘন্টার মধ্যে ইমরান খানের ওপর হামলার এজাহার দাখিলের নির্দেশ পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আদালতের
আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইমরান খানের ওপর হামলার এজাহার নথিবদ্ধ করতে, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ফয়সাল শাহকারকে নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ আদালত। আজ সোমবার (৭ নভেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন।
গত ৩ নভেম্বর পাঞ্জাব প্রদেশের ওয়াজিরাবাদ এলাকায় লংমার্চ অনুষ্ঠানকালে বন্দুকধারীরা ইমরানের সমাবেশে হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন– তেহরিক-ই-পাকিস্তান (পিটিআই) দলের সমর্থক মুয়াজ্জাম নওয়াজ। আহত হন পিটিআই প্রধান ইমরানসহ আরও ১৪ জন।
লংমার্চকে ইমরানের দল বলছে– 'আজাদি মার্চ' বা মুক্তির পদযাত্রা। গত ২৫ মে আজাদি মার্চের কিছু সীমা নির্ধারণ করে দেন আদালত। কিন্তু, আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই অভিযোগের শুনানিকালে এজাহার ৯০ ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও নথিভুক্ত না হওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
শুনানিতে অংশ নেন প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বে বিচারক ইজাজুল আহসান, মুনিব আখতার, ইয়াহিয়া আফ্রিদি ও মাজহার নাকভির বিশেষ বেঞ্চ।
শুনানি চলাকালে প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল হুঁশিয়ার করে বলেন, আদালতের নির্দেশিত সময়ের মধ্যে এজাহার দাখিল না হলে সুয়ো মোটো নোটিশ জারি করা হবে।
শুনানিতে লাহোর থেকে ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে যুক্ত ছিলেন পাঞ্জাবের আইজি। কেন এজাহার এখনও নথিভুক্ত হয়নি– বান্দিয়াল তাকে এই প্রশ্নও করেন।
বিচারপতি বলেন, 'আদালতকে বলুন, কবে রেজিস্টার করবেন এফআইআর'। এভাবে এজাহার না লেখানোর পেছনে অবশ্যই জোরালো যুক্তি থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, হামলার পর ৯০ ঘণ্টা হয়েছে, কিন্তু এখনও এজাহার লেখানো হয়নি। 'এটি ছাড়া তদন্ত কীভাবে শুরু হবে? তাহলে তো সাক্ষী-সাবুদ সবই বদলে ফেলা সম্ভব'।
পাঞ্জাবে বর্তমানে ক্ষমতায় আছে ইমরান খানের দলীয় সরকার। মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ এলাহীর নেতৃত্বের এই সরকারের সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক নেই আইজি শাহকারের। তিনি আদালতকে জবাবে বলেন, 'এজাহার দাখিলের বিষয়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেছি, এতে তার কিছুটা আপত্তি রয়েছে'।
আইজি আরও বলেন, হামলায় যে ব্যক্তি মারা গেছেন, তার আত্মীয়স্বজন বা নিকটজনদের কাছ থেকেও একটি এজাহার লেখানো উচিত ছিল।
তিনি উল্লেখ করেন যে, গত চার বছরে পাঞ্চাবের আটজন আইজি বদল হয়েছে।
এই ব্যাখ্যার জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, 'পুলিশের কাছে বিকল্প নেই আমাদের তা বলতে আসবেন না। আপনার দায়িত্বে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়ার কথা–অপরাধীর বিচার এবং বিচার ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখা।
'আইন অনুযায়ী চলবেন, আদালত আপনার পাশে থাকবে' আইজিকে বলেন প্রধান বিচারপতি।
এজাহার দাখিলে কোনো পক্ষের আপত্তি থাকলে– সেটিও তদন্তের আওতায় আনার নির্দেশ দেন আদালত। প্রধান বিচারপতি আইজিকে আশ্বস্ত করে বলেন, তিনি আইজি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কেউ তার কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
'আইজি সাহেব নিজের কাজ করেন। কেউ যদি আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করে, তাহলে আদালতও তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করবে'- বলেন বিচারপতি বান্দিয়াল।
এরপর তাকে সতর্ক করে বলেন, এজাহার যদি দাখিল না করা হয়– 'তাহলে আইজি সাহেব, সুয়ো মোটো নোটিশের জবাব আপনাকে দিতে হবে'।
'জাতীয় এক নেতাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টার গুরুত্ব আশা করি উপলদ্ধি করবেন। তদন্ত করে প্রমাণ যোগাড় করুন, অবশ্যই ফরেনসিক অনুসন্ধানও করবেন'।
এজাহার নিয়ে অচলাবস্থা কেন?
এমন নয় এজাহার দাখিল করতে চান না ইমরান। বরং উল্টোটাই সত্য। কিন্তু, তাতে জ্যেষ্ঠ এক সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করতে চেয়েছেন হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনাকারী হিসেবে। এই নামটি বাদ দিতে তাকে অনুরোধ করে পুলিশ। কিন্তু, তা মানতে নারাজ ইমরান। একারণেই পুলিশ তা লিপিবদ্ধ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। তার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নামও রয়েছে। তাতে পুলিশ আপত্তি করেনি।
শুধু পুলিশ নয়, উভয় সংকটে রয়েছেন খোদ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীও। পাঞ্জাবের শাসক দলের জোটের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা ইমরানের হাতে। এজাহারে ইমরান সেনা কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করতে অনড় থাকায় মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ ইলাহীর 'ত্রিশঙ্কু দশা'। এটাও স্থানীয় সরকারের গড়িমসির জায়গা হয়ে উঠেছে।
গতকাল রোববার-ই এজাহার লেখাতে কেন বিলম্ব হচ্ছে- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইমরান খান। তিনি বলেন, 'আমাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনাকারী হিসেবে' প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলাটি নথিবদ্ধ করতে হবে।
এসময় তিনি আরও বলেন, 'এজাহার নিতে পাঞ্জাব পুলিশের গড়িমসির কারণে মামলা করা যায়নি'। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম উল্লেখ মেনে নিলেও–সামরিক কর্মকর্তার নাম উল্লেখ না করার বিষয়ে পুলিশের একরোখা আচরণ তাকে বিস্মিত করেছে বলে জানান ইমরান।
'(এজাহার লেখাতে চাইলে) সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, এই কাজ করামাত্র তাদের বদলি করা হবে। তখন অন্য কোনো কর্মকর্তাকে আমার উল্লেখিত ব্যক্তিদের নামে এজাহার রেজিস্টারের ভার নিতে হবে।' অর্থাই, যেই একাজ করুক তাকে বদলি করা হবে।
এসময় দেশের ব্যবস্থার গ্রহণযোগতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইমরান খান। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীও মামলা দায়ের করতে পারছেন না। 'কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। এতে পুরো দেশের বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে'।