প্লেন না, এটা পাখি! শত্রু ড্রোন ঘায়েলে ঈগল ও বাজ পাখিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে!
প্রশিক্ষকের দস্তানায় বসে নির্দেশের অপেক্ষা করছিল কৃষ্ণ ঈগলটি। নির্দেশ পাওয়ামাত্রই ক্ষীপ্র বেগে উড়াল দিল আকাশপানে। উড়তে উড়তে উঠে যাচ্ছিল আরও উঁচুতে। তারপর লক্ষ্য শনাক্ত করামাত্রই তার দিকে ডাইভ করে নেমে আসে। ঈগলের আক্রমণে এভাবে মুহূর্তেই ভবলীলা সাঙ্গ হলো লক্ষ্যের– একটি দুর্ভাগা কোয়াডকপ্টার ড্রোনের। ধারালো নখরে পাকরাও করে ড্রোনটি নিয়ে নেমে আসে ঈগল। তারপর উড়াল দেয় আরও একবার, তার মিশনের বাকি অর্ধেক– 'নজরদারি' সম্পন্ন করতে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ যুদ্ধ প্রশিক্ষণ- 'ইয়ুধ আভয়াস' বা 'যুদ্ধাভ্যাস' শীর্ষক মহড়ায় এ দৃশ্যের দেখা মেলে। এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের আউলিতে।
প্রশিক্ষণকালে এমন একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির রচনা করা হয়, যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে শত্রুবাহিনীর ড্রোন হামলা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে, মিত্র বাহিনীর প্রয়োজন শনাক্ত হওয়া ছাড়াই শত্রুর গতিবিধির ওপর ব্যাপক নজরদারি। আর সেজন্যই ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত শিকারি পাখির দলকে।
শিকারী বাজ ও ঈগলদের কোয়াডকপ্টার জাতীয় ড্রোন বিনাশী কৌশল ও নজরদারিতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ভারতের মিরাটে অবস্থিত রিমাউন্ট ভেটেরিনারি কোর সেন্টার। দেশটির সেনাবাহিনী জানায়, যুদ্ধক্ষেত্রে কোয়াডকপ্টার জাতীয় ছোট মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন সচরাচর ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এটি বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীর কাছে জনপ্রিয় হয়েও উঠেছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্ট দেশটির সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র উদ্ধৃত করে জানায়, "প্রশিক্ষণকালে ঈগলগুলো কয়েকশ কোয়াডকপ্টার ড্রোন নামিয়ে আনতে সফল হয়, অধিকাংশক্ষেত্রেই এগুলো সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় তাদের আক্রমণে। আর এগুলো কোয়াডকপ্টার হওয়ায়– এখন পর্যন্ত কোনো ঈগল আহত হয়নি।"
সূত্রটি আরও জানায়, এসব পাখির বেশিরভাগই উদ্ধারকৃত। তাদের ফ্যালকন রেসকিউ অ্যান্ড রিহাবিটেশন সেন্টার থেকে আনা হয়। ২০২০ সাল থেকেই পাখিগুলোকে বিশেষ মিশনের জন্য প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
নজরদারির জন্য পাখিগুলোর মাথায় বসানো রয়েছে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। রয়েছে ভিডিও রেকর্ডের ব্যবস্থাও। কারণ দিনে দিনে বড় আকারের কোয়াডকপ্টারের ব্যবহার বাড়ছে। আকাশে অনেক উঁচুতে উড়ে এসব হুমকি শনাক্ত করবে পাখিগুলো। রেকর্ড করা ভিডিও সম্প্রচারের ছোট এন্টেনাও বসানো হবে তাদের মাথায়। ফলে সেনারা সে ভিডিও দেখে শত্রুর বড় কোয়াডকপ্টার ভূপাতিত করার অন্য ব্যবস্থা নিতে পারবে।
তবে আপাতত ভিডিও সম্প্রচারের ব্যবস্থা নেই, ধীরে ধীরে সেটি চালু করার লক্ষ্য হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর।
নজরদারিতে শিকারি পাখি ব্যবহার প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর অপর একটি সূত্র দ্য প্রিন্টকে জানায়, "শিকারি বাজ বা ঈগলের থাকে নিজস্ব এলাকা। আমরা যখন তাদের কোনো অঞ্চলে মুক্ত করি, তখন তারা নিজেরাই নিজেদের এলাকা বেছে নেয় এবং তার ওপর চক্কর দিতে থাকে। এভাবে তারা বড় একটি এলাকার নজরদারিতে সাহায্য করে (ক্যামেরার মাধ্যমে)।"
প্রতিটি পাখির জন্য আছে একজন করে হ্যান্ডলার। তাদের কাজ পাখিগুলোর প্রাকৃতিক আচরণকে উৎসাহ দিয়ে সামরিক কাজে লাগানো। তবে এখনও পাখিগুলোর প্রশিক্ষণ চলমান এবং তাদের সামরিক কাজে মোতায়েন করা হয়নি বলে সূত্রটি উল্লেখ করে।
"পারদর্শিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা পাখিগুলোকে অপারেশনে মোতায়েন করব।"
রিমাউন্ট ভেটেরিনারি কোর সেন্টার দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সারমেয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ আশা করছেন, ঈগল ও বাজ পাখিরাও প্রত্যাশিত সাফল্য পাবে।
গত দুই দশক ধরে, বিশ্বব্যাপী প্রসারিত হয়েছে ড্রোন প্রযুক্তি। আক্রমণ ও প্রতিরক্ষা- উভয় ধরনের মিশনেই অপরিহার্য এখন ইউএভি। ২০১৬ সালে প্রথম ড্রোন ধরাশায়ী করতে ঈগল ব্যবহার করে নেদারল্যান্ডস। দেশটি জানায়, উচ্চ প্রযুক্তির হুমকি শনাক্তে এটি নিম্ন প্রযুক্তির কার্যকরী সমাধান।
বিশ্বের অন্যান্য সেনাবাহিনীও শিকারি পাখিদের ড্রোন ভূপাতিত করতে ব্যবহার করছে। ভারতে সেনাবাহিনীর আগে এই উদ্যোগ নেয় তেলেঙ্গানার রাজ্য সরকার। ভিআইপি অনুষ্ঠানে অবৈধ ড্রোনের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ঈগল প্রশিক্ষণ শুরু করে।
ড্রোন প্রতিরোধী এই স্কোয়াডের নাম দেওয়া হয় গারুদা স্কোয়াড। তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয় তেলেঙ্গানার মৈনাবাদে অবস্থিত ইন্টেগ্রেটেড ইন্টেলিজেন্স ট্রেইনিং একাডেমিতে।
পাখির চোখে দেখার চেষ্টা
প্রথম মহাযুদ্ধকাল থেকেই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়- পিজন সার্ভিস বা কবুতর বাহিনী। এই বাহিনীর প্রশিক্ষিত পাখি মহাযুদ্ধের সময়ে জরুরি বার্তা বয়ে নিয়ে যেত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে পিজন সার্ভিসের একজন মেজর সেনাবাহিনীর কাছে পাখি থাকাকে বেসামরিক নাগরিকের হাতে বন্দুক থাকার সমতুল্য বলে কটাক্ষ করেন। কারণ, ততোদিনে উন্নত রেডিও প্রযুক্তির কল্যাণে ফুরিয়ে এসেছিল কবুতরের ডাক বহনের প্রয়োজন। ওই অফিসার বলেন, "হয়তো এটা আপনার কখনোই প্রয়োজন হবে না। কিন্তু, যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে বুঝতে হবে এছাড়া অন্য উপায়ও নেই।"
শুধু ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নয়, প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধের সংবাদ ও কূটনৈতিক বার্তা আদানপ্রদাণে বাহক পাখিরা ছিল অপরিহার্য। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলেই ছিল যার ব্যবহার।
প্রথম মহাযুদ্ধকালে কবুতরের দিক নির্ণয়ের ক্ষমতা ও একটানা উড়তে পারার গুণের কারণে ব্যাপক ব্যবহার হয়। ব্রিটিশরা এদিক থেকে অগ্রণী হলেও পিছিয়ে ছিল না জার্মানরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে চতুর জার্মানরা আরেক কাঠি সরেস পরিকল্পনা করে। মিত্র বাহিনী যে ধরনের কবুতর বেশি ব্যবহার করতো– ঠিক সেই জাতের কবুতর ফ্রান্সে প্যারাশুটের সাহায্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যাতে করে মিত্রবাহিনী নিজেদের কবুতর মনে করে, এগুলোর পায়ে যুদ্ধের গোপন বার্তা বেঁধে দিলে কবুতরগুলো সেসব নিয়ে জার্মানিতে ফিরে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গুপ্তচর সংস্থা- সিআইএ'র পূর্বসূরি সংস্থা ছিল- আমেরিকান অফিস অব স্ট্র্যাটেজিক সার্ভিসেস (ওএসএস)। এই বাহিনীর চরদের প্রায়ই জাপানের দখলকৃত বার্মায় গোপন মিশনে পাঠানো হতো। তাদের কাছে থাকতো খাঁচাবন্দী কবুতর। মিশন পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে কিনা- তা জানাতে এই চরেরা গুপ্ত সাংকেতিক বার্তাবাহী কবুতরটি উড়িয়ে দিত।
এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এসেও ফুরায়নি যুদ্ধে পাখিদের আবেদন। ছোট ড্রোন-বিরোধী ভূমিকায় তাদের প্রশিক্ষিত করা তারই ইঙ্গিত।
১৯৪১ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এপ্রসঙ্গে যথার্থই বলেছিলেন এক আমেরিকান মেজর, তার মতে 'কবুতরও যুদ্ধ জয় ছিনিয়ে আনতে পারে'।