রাশিয়ার কাছে কি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আছে?
যুদ্ধ মানেই বিপুল ব্যয়, প্রতিনিয়ত ধবংসের কাজে অগুণতি অর্থ ও সম্পদের লগ্নী। আধুনিক যুদ্ধ যে কোষাগারের টাকা রাতারাতি উড়িয়ে দিতে পারে, তা সবার আগে প্রমাণিত হয়- প্রথম মহাযুদ্ধকালে। শিল্পের বিকাশ অস্ত্রের উন্নতিকে যখন চরম করে, তখন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখে ধ্বংস ও মৃত্যুর তাণ্ডব। আর এই মহারণ চালিয়ে যেতে সম্পদের বিপুল বিনিয়োগ। তারপর যতদিন গেছে, অধুনা সময়ের যুদ্ধগুলি হয়ে উঠেছে ততোটাই ব্যয়বহুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও দেখে আরও চরমতম ধবংসলীলা। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বোমার ব্যবহার ছিল তারই দৃষ্টান্ত।
সাম্প্রতিকতম সময়ে বিশ্ব রাজনীতির 'টক অব দ্য টাউন' বা আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু ইউক্রেন যুদ্ধ। কী এই যুদ্ধের সমীকরণ, কার ক্ষতিতে লাভ কার; প্রতিনিয়ত চলছে এই ছক কষাকষি। এই যুদ্ধ রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের নয়, বরং পরিণত হয়েছে পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে এক ছায়াযুদ্ধ বা প্রক্সি লড়াইয়ে। তাই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি, সম্পদ ও জনবলহানি মানতে হচ্ছে সব পক্ষকেই। এমন বাস্তবতায় রাশিয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য নিয়ে কাতার-ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার মতামত কলামে লিখেছেন রাশিয়ার সাবেক উপ-অর্থমন্ত্রী এবং সেন্ট্রাল ব্যাংক অভ রাশিয়ার ফার্স্ট ডেপুটি চেয়ারম্যান সের্গেই আলেশাশেঙ্কো। নিবন্ধটির নির্বাচিত অংশ টিবিএসের পাঠকের জন্য পরিমার্জিত ভাবানুবাদ করেছেন নূর মাজিদ।
রাশিয়ান আর্মি ইউক্রেনে পূর্ণদ্যমে আগ্রাসন শুরুর পর কেটে গেছে নয় নয়টি মাস। ইউক্রেনীয় সরকারের পতন ঘটিয়ে এই সামরিক অভিযানের সমাপ্তি হওয়ার কথা ছিল রাতারাতি, কিন্তু পরিণত হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে। সংঘাতে হাজার হাজার সামরিক ও বেসামরিক প্রাণহানি হয়েছে।
যুদ্ধ ইউক্রেনের ভূমিতে চলছে, তাই তাদের মানব ও বস্তুগত সম্পদের ক্ষতিই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে, যুদ্ধে সামরিক সরঞ্জামের ক্ষতি আর সামরিক প্রাণহানির ভারবহন করছে রাশিয়াও। মুখোমুখি হচ্ছে আরও নানাবিধ চ্যালেঞ্জের, যা দেশটির অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
মস্কোর ওপর ধারাবাহিকভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা। নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন রুশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। এর আওতায় রয়েছে- দেশটির আমদানি, রপ্তানি, ভারী শিল্প থেকে শুরু করে তেল ও গ্যাস বিক্রির রাজস্ব।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নিষেধাজ্ঞার উল্লেখযোগ্য কালো ছায়া পড়বে রুশ অর্থনীতিতে, আর তার ফলে এক পর্যায়ে আগ্রাসী যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য হবে ক্রেমলিন। কিন্তু, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বাজেট বিষয়ক আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ বলছে, এই ধারণা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে না। অর্থাৎ, স্বল্পমেয়াদে মস্কো এমন কোনো ব্যাপক অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতায় পড়বে না– যার ফলে এ নীতি বদলাতে বাধ্য হবে।
নিষেধাজ্ঞা এবং তার সুবাদে আসা অপ্রত্যাশিত লাভ
একথা সত্য, পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার অর্থনীতিতে এক ধরনের পতন অবশ্যই ঘটেছে, কিন্তু এ পতন যতোটা ব্যাপক হবে বলে অনেকে যতোটা প্রত্যাশা করেছিলেন– ততোটাও হয়নি। রুশ সরকারের তথ্যমতে, চলতি বছর রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২.৯ শতাংশ পতনের শিকার হবে। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে এটি হবে ৩ থেকে ৩.৫ শতাংশ। মার্চে পশ্চিমা অনেক বিশেষজ্ঞ এর দ্বিগুণ ধসের প্রক্ষেপণ করেছিলেন।
এই অনুমানের পেছনে কার্যকারণও ছিল। নিষেধাজ্ঞা বহর আসার পর পর রাশিয়া মূল্যস্ফীতির জোয়ারের মুখে পড়ে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের আট সপ্তাহ পরে ভোক্তা পর্যায়ে মুল্যসূচক বাড়ে ১০ শতাংশ; কিন্তু মে নাগাদ তা সমতায় নেমে আসে বা স্থিতিশীল হয়।
ফেব্রুয়ারি ও মার্চে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলও উল্লেখযোগ্যভাবে বিনিময় মান হারায়। ফেব্রুয়ারিতে যেখানে প্রতিডলার কিনতে ৭৫ রুবল লাগতো, মার্চে সে বিনিময় দর পৌঁছায় ১৩৫ রুবলে। এতে মূল্যস্ফীতি আরও চড়া হওয়ার আশঙ্কায় ভীতি দেখা দেয় সাধারণত জনতার মধ্যে। এই অবস্থায়, ধারাবাহিক মুদ্রা মান অবমূল্যায়নের বিপদ আঁচ করে নানাবিধ কঠোর আর্থিক ও মুদ্রানীতি নেয় কর্তৃপক্ষ। চলতি ও মূলধনী হিসাবের বিদেশমুখী লেনদেনে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
ফলে এক পর্যয়ায়ে ডলারের বিপরীতে ৫০ রুবলে উঠে আসে বিনিময় হার। পরে অবশ্য তা ৬০ রুবলে গিয়ে স্থির হয়।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদায় ধস- রাশিয়ার আমদানি হ্রাস করে। ২০২২ সালের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে যা কমেছে যথাক্রমে ২৩ ও ১৪ শতাংশ হারে। এতে করে, চলতি বছর প্রথম ১০ মাসে বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে যে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তাতে ২০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেয়।
পশ্চিমাদের সাথে ইউক্রেন নিয়ে দ্বন্দ্ব– রাশিয়ার হাইড্রোকার্বন রপ্তানিকেও ব্যাহত করেছে। অথচ এটি রাশিয়ার প্রধানতম আয়ের উৎস। যুদ্ধের আগে ২০২১ সালে দেশটির মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশই ছিল এ খাতের। আর কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্বের ৪৫ শতাংশই আসে এখান থেকে।
যুদ্ধের আগেই ২০২১ সালের শেষদিকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল গ্যাজপ্রম। এতে গ্যাসের দাম চড়তে থাকে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর- চলতি বছরের এপ্রিলে ইউরোপীয় দেশগুলোকে গ্যাসের দাম রুবলে দিতে হবে এমন একটি আদেশে স্বাক্ষর করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই বিধি মানতে অস্বীকার করে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ। ফলে তাদের কাছে গ্যাস বিক্রি বন্ধ রাখা হয়।
সংঘাতের কারণে ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে যাওয়া পাইপলাইন এবং ইয়ামাল পাইপলাইন দিয়েও ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হয়। গত সেপ্টেম্বরের নাশকতায়– নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতেও গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ ইউরোপে গ্যাজপ্রমের রপ্তানি কমে যায় ৪৩ শতাংশ। রাশিয়ার বৃহত্তম এই গ্যাস কোম্পানিকে বাধ্য হয়ে তাদের উৎপাদন কমাতে হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
এতে রাজস্ব কমার কথা থাকলেও, হয়েছে বরং উল্টোটাই। বিশ্ববাজারে গ্যাসের চড়া দামের কারণে গ্যাজপ্রম ও ফেডারেল সরকারের রাজস্ব– উভয়েই দেখেছে লাভের মুখ। আয় বাড়ার এই ধারা যখন সর্বোচ্চ ছিল– সেই আগস্ট মাসে বছরওয়ারি হিসাবে গ্যাসের চাম ৪৬০ শতাংশ বেশি ছিল।
এমনকি গ্যাজপ্রমের মুনাফা এতটাই বাড়ে যে সরকার বাধ্য হয়ে কোম্পানিটির রাজস্বের ওপর সাময়িক (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের জন্য) একটি করারোপ করে। এতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বাড়তি ২০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি রুবল) যোগ হয়।
একই দৃশ্যের অবতারণা হয় জীবাশ্ম তেল খাতে। রাশিয়া থেকে তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি সীমিত করতে ইইউ যে পরিকল্পনা নিয়েছিল– তার ফলে রাশিয়ান কোম্পানিগুলো নতুন ক্রেতাদের সন্ধান করতে থাকে। বাজারদরের চেয়ে ব্যাপক কম দামে তাদেরকে রাশিয়ার তেল ক্রয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কেউ কেউ তো ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড়ও পেয়েছে।
জ্বালানি তেলের বিশ্ববাজার মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল এসময়, গত বসন্তে যা ছিল ১২০ ডলার প্রতিব্যারেল। ফলে মূল্যছাড় দেওয়ার পরও ২০২১ সালের চেয়ে বেশি দামেই বিকিয়েছে রাশিয়ান তেল।
সার্বিকভাবে, ২০২২ সালের প্রথম ১০ মাসে হাইড্রোকার্বন উৎপাদন ও রপ্তানি থেকে রাশিয়ার সরকারি বাজেটে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ৩৪ শতাংশ।
যুদ্ধের ব্যয়
হাইড্রোকার্বন বা জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ থেকে উচ্চ রাজস্ব আহরিত হলেও, এবছরে সামরিক খাতে রাশিয়ার ব্যয়ও তীব্রভাবে বেড়েছে।
মধ্য সেপ্টেম্বরে রুশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ সামরিক ব্যয় ৩১ শতাংশ বেড়ে ৪ লাখ ৬৭ হাজার কোটি রুবল হবে, আগের বছর যা ছিল ৩ লাখ ৫৭ হাজার কোটি রুবল। মার্কিন ডলারের হিসাবে, আগের ৫৭ বিলিয়ন ডলার ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৭৪ বিলিয়নে।
এরমধ্যে রয়েছে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় ও মেরামতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত ৬০০-৭০০ বিলিয়ন রুবল (১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার) ব্যয়।
ফেডারেল বাজেটের অন্য যে খাতটি নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে, সেটি হলো- 'জেনারেল ন্যাশনাল ইস্যুজ'; এটি ৫০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৬২৯ ট্রিলিয়ন রুবলে (৪২ বিলিয়ন ডলার)। সাধারণত সরকারের সকল শাখার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড এই বরাদ্দের আওতায় মেটানো হয়। এতে বাড়তি বরাদ্দ যদি, যুদ্ধাঞ্চলে প্রশাসনিক কাজে ব্যয় হিসাবে ধরা হয়, তাহলে প্রতিরক্ষা ব্যয় আরও ৮৬৯ বিলিয়ন রুবল বা ১৩.৮ বিলিয়ন ডলার বেশি হয়েছে বলাই যায়।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পেছনেও বেড়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয়। ২০২১ সালের তুলনায় যা ১৯ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ২.৭৮৮ ট্রিলিয়ন রুবল (৪৪.৫ বিলিয়ন ডলার) হয়েছে। এই বরাদ্দের একটি বড় অংশ পেয়েছে রাশিয়ান ন্যাশনাল গার্ড। এই বাহিনী ক্রিমিয়া উপদ্বীপের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে এবং স্থানীয় রুশ প্রশাসনকে সহায়তা করে থাকে।
সামরিক বাজেট প্রকাশেরর কিছুদিন পরই ক্রেমলিন আংশিক সেনা সমাবেশের ঘোষণা দেয়। এর আওতায়, সেনাবাহিনীর চাকরিতে ফিরবে প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার জন অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও কর্মকর্তা। এ পদক্ষেপে সামরিক ব্যয় আরও বাড়বে। এসব কর্মকর্তাদের বেতন ও অন্যান্য ভাতা বাবদ চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরও ৩৭২ বিলিয়ন রুবল (৬ বিলিয়ন ডলার) খরচ হবে।
সার্বিকভাবে ২০২২ সালে রাশিয়ার সামরিক ব্যয় মোট জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি হবে, যা সত্যিই নজিরবিহীন এক ঘটনা। তবু তেল ও গ্যাস খাতের উচ্চ আয়ের সুবাদে যুদ্ধজনিত এই বাড়তি ব্যয় নির্বাহ তেমন ওঠাটা কঠিন হবে না। ফলে বছর শেষে রাশিয়ার বাজেট ঘাটতি হবে মোট জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশ বা ১৫ বিলিয়ন ডলার।
রাশিয়ার জন্য বৈদেশিক ঋণ বাজার বন্ধ করে দিয়েছে পশ্চিমারা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও সরকারের ঋণগ্রহণের সুযোগ সীমিত। তাই এই ঘাটতি পোষানো হতে পারে সঞ্চিত রিজার্ভের আয় থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে। এমনটাই জানিয়েছেন রুশ প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন।
অক্টোবরে এই তহবিল ছিল ১০.৭ ট্রিলিয়ন রুবল বা ১৭১ বিলিয়ন ডলারের; এর নগদ অংশ- বা প্রায় সাড়ে ৭ ট্রিলিয়ন রুবল বাজেট ঘাটতির নানান ব্যয় পরিশোধে ব্যবহার করা যাবে।
২০২৩ সালের চ্যালেঞ্জ:
আগামী বছরের বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ সাড়ে ৬ শতাংশ বাড়িয়েছে রুশ সরকার। মূল্যস্ফীতি বাদ দিয়েই এই হারে বাড়ানো হয়েছে বাজেট। এতে প্রাক্কলন করা হয়েছে যে, আগামী বছর যুদ্ধের খরচ সেভাবে বাড়বে না।
এই প্রাক্কলন নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া, ২০২২ সালের বাজেটে অতিরিক্ত সেনা ভর্তির খরচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই এটা ২০২৩ সালের বাজেটেই যোগ হবে। আরও যোগ করতে হবে যুদ্ধে হতাহতদের পরিবারকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণের অঙ্ক। সার্বিকভাবে, প্রতিরক্ষা বরাদ্দ আরও বাড়াতে বাধ্য হবে সরকার।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু আগামী বছরে সামরিক উপকরণ ক্রয় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির কথাও বলেছেন।
যে হারে ব্যয় বাড়ছে, সে তুলনায় ২০২৩ সালে রাজস্ব আহরণ কতোটা শক্তিশালী হবে– তা এখনই সহজে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি খাত থেকে উচ্চ প্রত্যাশাই রাখছে ক্রেমলিন।
অনেক রুশ বিশেষজ্ঞ অবশ্য সরকারের মতো ততোটা ভরসা রাখছেন না হাইড্রোকার্বন খাতের ওপর। তার কারণও বহুবিধ; আগামী বছর বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্য কতোটা চড়া থাকবে– তা এখনও নিশ্চিত নয়। মন্দা পরিস্থিতির কবলে পুরো বিশ্ব। এতে চাহিদা হ্রাস পেলে জ্বালানি খরচও কমবে বিভিন্ন দেশের। তার ওপর গত ৫ ডিসেম্বর থেকে পূর্ব সিদ্ধান্ত মাফিক রাশিয়ান অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধ করেছে ইইউ।
এমনকী রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধ নাগাদ রুশ অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরবে। জি-৭ আর অস্ট্রেলিয়াও নিয়েছে এই পদক্ষেপ। তারা রাশিয়ার তেলের সর্বোচ্চ মূল্যসীমাও ৬০ ডলার আরোপ করেছে।
ফলস্বরূপ; আগামী বছর রাশিয়া যুদ্ধপূর্ব সময়ের মতোন পরিমানে তেল রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারবে বলে মনে হয় না। ২০২১ সালে রাশিয়ার রপ্তানিকৃত তেলের গড় মূল্য ছিল ৬৯ ডলার প্রতিব্যারেল। ২০২১ সালের চেয়ে ডলারের বর্তমান বিনিময় হার ১৫ শতাংশ উচ্চতায় রয়েছে। নতুন বছরেও তা অব্যাহত থাকবে।
এতে করে, ২০২৩ সালে হাইড্রোকার্বন খাতের উৎপাদন ও রাজস্ব যথাক্রমে ১৫-২০ শতাংশ (২০-২৯ বিলিয়ন ডলার) পতনের শিকার হতে পারে ২০২১ সালের তুলনায়।
রাজস্বে এই পতন মোকাবিলায়, সরকার তেল ও গ্যাস কোম্পানিসহ কয়লা উৎপাদকদের ওপরও কর বাড়াতে পারে। এতে রাজস্ব যা কমবে- তার ৭৫ শতাংশ ঘাটতি পূরণ করা যাবে।
সর্বোপরি বলা যায়, ২০২৩ সালে রুশ সরকারের পরিকল্পিত রাজস্ব আহরণ কমার ঝুঁকি রয়েছে, কিন্তু বাজেটে উল্লেখিত পরিমাণের চেয়ে তা সামান্য বা ৫-৬ শতাংশের মতোন হতে পারে বলে আমার প্রক্ষেপণ দেখাচ্ছে।
তবুও থাকবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ
পরিকল্পিত বাজেট নিয়ে অনিশ্চিয়তা উচ্চ হলেও– একে অস্থিতিশীল বলা যায় না। ওপরে বর্ণিত পরিস্থিতির কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও– পরিকল্পিত মাত্রার কিছু কম বা বেশি হবে রাজস্ব আদায়। তবে এই পরিবর্তনের মাত্রা আমার পর্যালোচনা মতে, মোট জিডিপির ১ শতাংশের বেশি হবে না উভয় ক্ষেত্রেই।
এরই পরিণতিতে, রাজস্ব আহরণ কম হলেও– বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৩ শতাংশের (৫২ বিলিয়ন ডলার) মাত্রা ছাড়াবে না। এর পুরোটায় মেটানো যাবে রিজার্ভ থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে, বর্তমানে যার পরিমাণ ১২০ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার চাপ বাড়ানোর কোনো সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই দেখা যাচ্ছে না পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে। ফলে ২০২৩ সালে রাশিয়ার বাজেট নিষেধাজ্ঞা-জনিত কোনো ধাক্কার সম্মুখীন হবে না বলে ধরে নেওয়াই যায়।
এসব কিছুর প্রেক্ষাপটে, ক্রেমলিনের সামনে এমন বড় কোনো আর্থিক সীমাবদ্ধতাও দেখা যায় না– যা তাকে ইউক্রেনে নিজের আগ্রাসী নীতির পরিবর্তনে রীতিমতো বাধ্য করবে।