কাতারের রাজকীয় ও ধনীদের গৃহকর্মীর সাত দিনের কর্মজীবন
প্রায় এক যুগ আগে ২০১০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২-এর আয়োজক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল কাতারের নাম। এরপর থেকেই দেশটিতে 'দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'-এর মহা ধুম ধাম লেগে যায়। ক্রীড়া-দুনিয়ার এই মহাযজ্ঞকে ঘিরে কাতার স্টেডিয়াম ছাড়াও নির্মাণ করতে শুরু করে অনেক বিলাসবহুল হোটেল।
ভেন্যু হিসেবে কাতারকে নির্বাচন করার পর থেকে দেশটির মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সমালোচনা চলে আসছিল। কেবল ঘোষণার পরে নয়, আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম বিবেচনায় আসার সাথে সাথেই চলে এসেছিল অনেক অভিযোগ। অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশটিতে কর্মরত শ্রমজীবি শ্রেণি ভালো নেই উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড রয়েছে।
আয়োজনের প্রস্তুতির জন্য নির্মাণকাজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল অভিবাসী শ্রমিক। তাদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু উপেক্ষিত থেকে গেছে কাতারের শাসকশ্রেণি ও ধনীদের বাড়িতে নারী গৃহকর্মীদের জীবন। তাদের অবস্থা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি।
সম্প্রতি নিয়ম-নীতিতে মানবাধিকার রক্ষায় পরিবর্তন আসলেও, অনেক ক্ষেত্রে সেগুলো মানা হয় না। অভিজাত পরিবারগুলোতে কাজ করা নারীরা কেমন আছেন তা নিয়ে বিবিসি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সপ্তাহে সাতদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয় বেশিরভাগ গৃহকর্মীর। অনেকের খেতে হয় সবার খাওয়া শেষে বেঁচে যাওয়া খাবার। কেউ কেউ তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও শারীরিক নির্যাতন ও সহিংস আচরণের শিকার অনেকে। এমন তথ্য উঠে এসেছে বিবিসির এই প্রতিবেদনটিতে। এর অংশ হিসেবে কয়েকজন গৃহকর্মীর সাথে কথা বলেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই গণমাধ্যম।
তাদের মধ্যে একজন গ্ল্যাডিস (ছদ্মনাম)। সংক্ষিপ্ত এক অনলাইন কথোপোকথনে ফিলিপাইন থেকে আসা এই নারী জানান, প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। বাড়ি পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে খাবার তৈরি সহ বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করতে হয় তাকে।
গৃহকর্ত্রী সম্পর্কে অভিযোগ করে ৪০-এর কাছাকাছি বয়সী গ্ল্যাডিস বলেন, 'ম্যাডাম খুব উন্মত্ত ধরনের। তিনি আমার সঙ্গে প্রতিদিন চিৎকার-চেঁচামেচি করেন।'
তাছাড়া সবার খাওয়া শেষে বেঁচে যাওয়া খাবার খেতে হয় তাকে। এক বছর ছয় মাস আগে শুরু করা এই কাজে একদিনও ছুটি পাননি তিনি।
আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণার আগে শ্রমিকদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। নিয়োগদাতার অনুমতি ছাড়া দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি শ্রমিকরা চাকরি পরিবর্তন করতে পারতেন না। এমনকি কাতার ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও এই অনুমতির প্রয়োজন হতো। পারস্য উপসাগরীয় দেশে এখনো এমন অবস্থা বিরাজমান।
পরে আয়োজক হিসেবে নাম ঘোষণা করা হলে, মানবাধিকার নিয়ে সমালোচনার মুখে আইন সংস্কার করতে শুরু করে কাতার। কিন্তু এতে তেমন কোনো লাভ হয়নি বলে মনে করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির মতে, গৃহকর্মীদের প্রতি নানা ধরনের সহিংসতা রোধে এ নিয়মগুলো ব্যর্থ।
এর জলজ্যান্ত উদাহরণ গ্ল্যাডিস নিজে। চাইলেও যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারেন নিয়োগকর্তা তার পাসপোর্ট নিয়ে আটকে রেখেছেন, যা আইনের পরিপন্থী।
তবে নিজেকে যথেষ্ট ভাগ্যবান বলে মনে করেন গ্ল্যাডিস! কারণ অন্যান্য গৃহকর্মীদের মুঠোফোন ব্যবহার করা সুযোগটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়। তাছাড়া তার প্রতি শারীরিক নির্যাতন করা হয় না, যেখানে কি না বিদেশি গৃহকর্মীদের সঙ্গে প্রায়শই সহিংস আচরণের ঘটনা দেখা যায় বলে দাবি করেন তিনি।
তাই কাজের চাপ এবং গৃহকর্ত্রীর এমন আচরণ সত্ত্বেও কাজটি ছাড়ছেন না গ্ল্যাডিস। এছাড়াও আরেকটি কারণ রয়েছে। এই বয়সে এসে এর চেয়ে ভালো চাকরি আর পাবেন না বলে মনে করেন তিনি। প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ কাতারি রিয়াল বেতন পান তিনি (প্রায় ৪৪ হাজার টাকা), যার পুরোটাই তাঁকে পাঠিয়ে দিতে হয় ফিলিপাইনে রেখে আসা পরিবারের কাছে।
কাতারের শ্রমিকদের আইনগত অধিকার
কাতারের পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে আনুমানিক ১ লাখ ৬০ হাজার বিদেশি গৃহকর্মী রয়েছেন। তাদের জন্য ২০১৭ সালে একটি আইন করে দেশটির সরকার।
এই আইন অনুযায়ী, একজন কর্মীর কর্মঘণ্টা সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা হতে পারবে। এর পাশাপাশি, গৃহকর্মীরা কাজের ফাঁকে বিরতি, এক দিন সাপ্তাহিক ছুটি পাবেন ও সরকারি ছুটি বৈতনিক থাকবে।
২০২০ সালে এই আইনটির কিছুটা সংস্কার করা হয়। এতে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ সহ কর্মীদের নিয়োগদাতার অনুমতি ব্যতীত চাকরি পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সুবিধা প্রদান করা হয়।
কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, কাতারে এ আইন পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না। গৃহকর্মীদের এখনো অতিরিক্ত কাজ, বিশ্রামের অভাব এবং সহিংস ও অপমানজনক আচরণের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ফিলিপাইনের প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা মাইগ্রেন্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর কর্মকর্তা জোয়ানা কনসেপসিয়ন বলেন, পরিবারের জন্য আয় করাটা তাদের কাছে অনেক জরুরী বলে অনেক গৃহকর্মী এসব বিষয় নিয়ে মুখ খোলেন না।
তবে সুযোগ পেলেই এসব অঞ্চলের গৃহকর্মীরা নিজেদের কষ্টের কথাগুলো তুলে ধরেন বলে জানান তিনি। জোয়ানা বলেন, তারা প্রায় গুরুতর নির্যাতনের অভিযোগ করেন। যেমন, এক নারী বলছিলেন, রেগে থাকলে তার নিয়োগকর্তা শৌচাগারের বেসিনের পানিতে তার মাথা চেপে ধরতেন; এমনকি খাবারও দিতেন না।
তবে এর চেয়ে ভালো অবস্থানে আছেন কাতারের শাসক থানি রাজপরিবারে গৃহকর্মীরা। এমন একজন হলেন আলথিয়া (ছদ্মনাম)। তিনিও ফিলিপাইন থেকে কাতারে গেছেন। বিবিসির সাথে এক ভিডিও কলে জানান তিনি কেমন আছেন। আলথিয়া বলেন, তার সাথে ভালো আচরণ করা হয়। তার নিয়োগকর্তা তাকে আইফোন, পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার ও জুতা কিনে দিয়েছেন। দেশে থাকাকালীন তার এগুলো কেনার সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু তিনিও কাতারের নতুন আইন মোতাবেক কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না।
গ্ল্যাডিয়া এবং আলথিয়ার মতো বহু কর্মী কাতারে চলে যান। কারণ একটাই, দেশে অর্থ উপার্জনের উৎস খুঁজে না পাওয়া।
আলথিয়ার সঙ্গে আরও অনেক গৃহকর্মী থাকেন। থানি রাজপরিবারে কাজ করা নারীদের বড় একটি সুবিধা হলো, তারা নিজেদের জন্য আলাদা শয়নকক্ষ ও রান্নাঘর পান।
ভিডিও কলটির আলাপচারিতায় পাশে থাকা ফিলিপাইনের অন্যান্য কর্মীরাও যোগ দেন। ফেইসবুক এবং টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেক গৃহকর্মীদের খাবার ভিক্ষা এবং সাহায্য চাইতেও দেখেছেন বলে জানান তারা। আলথিয়া বলেন, "অনলাইনে প্রায় এরকম ভিডিও চোখে পড়ে। তাদের দেখে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয়। প্রতিটা দিন আমার কাছে যেন 'রূপকথার গল্প'।"
তবে তাদের কাজের প্রাসাদটিকে 'সিন্ডারেলার রাজপ্রাসাদের' সাথে তুলনা করেন তিনি। খানদানি ও আভিজাত্যে ভরপুর এ বাড়িতে তাদের কাজ শুরু হয় ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে। রান্নার কাজ সেরে রাজপরিবারের সদস্যদের খাওয়া শেষেই সকালের নাস্তা সারেন তারা। এরপর একে একে কক্ষগুলোতে ধোঁয়ামোছার কাজ শেষে আবার দুপুরের খাবার প্রস্তুত করে দিতে কাজে নেমে পড়েন।
রাজপ্রাসাদটিতে বহু কর্মী কর্মরত আছেন বলে, তাদের কাজের ভার তুলনামূলকভাবে কম। কাজের ফাঁকে দুপুর তিনটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান তারা। এরপর রাজপরিবারের রাতের খাওয়া শেষ হলে চাইলে রাজপ্রাসাদের বাইরে যেতে পারেন। আরেকটি বড় সুবিধা হলো, রাজপরিবার গৃহকর্মীদের পাসপোর্ট নিয়ে রাখেনি।
কিন্তু আইন অনুযায়ী সাপ্তাহিক ছুটি নেই। তাই সপ্তাহের শেষেও কাজ করে যেতে হয় আলথিয়াদের।
পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর অভিজাত পরিবারগুলোতে ফিলিপাইনের নারীদের নিয়োগ দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছেন মেরি গ্রেস মোরালস। রাজপরিবারের কাজের সুযোগ পাওয়া বেশ ঈর্ষণীয় বলে মনে করেন তিনি। তার ভাষায়, 'রাজপরিবারের লোকজন খুবই উদার।'
কর্মীদের নিজ দেশে থাকাকালীন কঠিন অবস্থার সাথে তুলনা করে তিনি মন্তব্য করেন, 'রাজপ্রাসাদটিতে কাজ করতে এসে এই গৃহকর্মীরা মোটা হয়ে যান। রাজপরিবার তাদের ভালোভাবে ভরণপোষণ করে।'
রাজপরিবারে কাজ পেতে হলে প্রয়োজন নির্ধারিত বয়স ও সৌন্দর্য
রাজ পরিবারে কাজ করার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয় বলে জানান মেরি; গৃহকর্মীদের বয়স হতে হবে ২৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে এবং 'দেখতে ভালো হতে হবে।'
রাজপরিবারের কাজ করা অনেক কর্মী কাতার ত্যাগের পর কিছু অভিযোগ করেছেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন কর্মী (একজন দেহরক্ষী, বাকি দু'জন ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক এবং গৃহ শিক্ষক) নিউইয়র্কে কাতারের আমিরের বোন শেইখা আর মায়াসা বিনতে হামাদ বিন খালিফা আল থানি ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই তিন কর্মীর অভিযোগ, ওভারটাইমের অর্থ ছাড়াই তাদের দিয়ে লম্বা সময় কাজ করান হতো। তবে এ অভিযোগ নাকচ করে কোনো দায়ভার নেননি রাজপরিবারের ওই দম্পতি।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)-এর আরব দেশগুলোর আঞ্চলিক পরিচালক রুবা জারাদাত বলেন, সংস্থাটি নতুন নিয়মের আওতায় ন্যূনতম মজুরি, সাপ্তাহিক ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি, ওভারটাইমের জন্য বাড়তি অর্থ প্রদান বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা নজরদারি করে। এই আইন পুরোপুরি কার্যকর করিকে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন তিনি।
এসব বিষয়ে কথা বলতে কাতারের রাজপরিবার ও লন্ডনে কাতার দূতাবাসের সঙ্গে বিবিসি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।