‘রাশিয়ার যুদ্ধজয়ের নতুন কৌশল’
বিশ্ববাসীর নজর ইউক্রেনের দিকে। এই যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব এরমধ্যেই অনুভব করছে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে অগণিত জনতা। তাই এর চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে নেই প্রচার-প্রচারণা ও অনুমানের অন্ত। পর্যবেক্ষকরা এখনই মনে করছেন, জয় যে পক্ষেরই হোক না কেন- পৃথিবীর ভূরাজনীতি তাতে চিরতরে বদলে যাবে। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে নেই কোনোপক্ষই। প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। রাশিয়াও নিয়েছে যুদ্ধ জয়ের নতুন কৌশল। এনিয়ে ফরেন অ্যাফেয়ার্স ম্যাগাজিনে মতামত নিবন্ধ লিখেছেন সমর কৌশলবিদ এবং অস্ট্রেলীয় সামরিক বাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল মিক রায়ান। টিবিএসের পাঠকের জন্য নিবন্ধটির পরিমার্জিত ও সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ করেছেন নূর মাজিদ।
এবারের বড়দিনটা প্রিয়জন হারানোর শোকে থাকবে ইউক্রেনবাসী। উৎসবের দিনটা হবে তাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার ১০ মাসের মাইলফলক। সত্যিই যে শঙ্কা একসময় তাদের কাছে অকল্পনীয় ছিল, তাই রূপ নিয়েছে বাস্তবে। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর– এই প্রথম এত প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা শুরু হয়েছে ইউরোপের মাটিতে। এতে প্রাণহানি হয়েছে হাজার হাজার, বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে লাখো মানুষ। দেশটির সিংহভাগ এলাকা এই তীব্র শীতের মওসুমে বিদ্যুৎহীন। ফলে শারীরিকভাবে দুর্বল ও বৃদ্ধদের অনেকেই এবার ঠাণ্ডায় মারা পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বড়দিন রাশিয়ার জন্যও নিষ্ঠুর এক বাস্তবতার প্রতীক হয়ে আসবে। কারণ মস্কো ভেবেছিল, দুয়ারে টোকা দিলেই ধসে পড়বে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ। ভেবেছিল সামরিক অভিযান হবে- সংক্ষিপ্ত আর বিজয় তিলকে উজ্জ্বল। সে ঘোর কেটে যায় অচিরেই। ইউক্রেনের রণাঙ্গন আধুনিক যুদ্ধ কীভাবে লড়তে হয়– রাশিয়াকে সেই শিক্ষা দিয়েছে। দিয়েছে জাতীয় অদম্যতার বোঝাপড়া। যুদ্ধের ময়দানে এবং সমর্থক অঞ্চলে– অব্যাহতভাবে রাশিয়ার সামরিক শক্তিহানি করেছে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা। এতে শুধু যুদ্ধের ময়দানে নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও রাশিয়ার মর্যাদাহানি করেছে তারা। সাধারণ সেনা, কর্মকর্তা ও নাগরিকদের কাছেও সম্ভ্রম হারিয়েছে ক্রেমলিন।
ইউক্রেন সুচতুর কৌশলে লড়েছে যুদ্ধ। যেখানে ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি হবে বেশি– এড়িয়ে গেছে তেমন লড়াই। আবার সুযোগ পেলেই, ক্লোজ কমব্যাট বা একেবারে চোখাচোখি দূরত্বের লড়াইয়ে লিপ্ত হচ্ছে। দুর্দান্ত কাজ করেছে তাদের এসব কৌশল। ফলে কিয়েভের অগ্রযাত্রা থেকে বিশাল রুশ বাহিনীকে হঠিয়ে দেয় তারা। দখলমুক্ত করতে পেরেছে উত্তরপূর্বের খারকিভ প্রদেশ। গুরুত্বপূর্ণ ডনবাস অঞ্চলের কিছু অংশকেও মুক্ত করেছে। আর সর্বশেষ তারা খেরসন মুক্ত করেছে। এটাই ছিল রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনের একমাত্র প্রাদেশিক রাজধানী। এই হার মস্কোর জন্য লজ্জা বয়ে এনেছে।
রাশিয়াকে এখনই অবশ্য পরাজিত বলার সময় আসেনি। তার শক্তি নিঃশেষ– সে দাবিও হবে অতি-রঞ্জন। তাছাড়া, অভিজ্ঞ জেনারেল সের্গেই সুরভিকিনকে নতুন করে ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন পুতিন। সুরভিকিন এ পদে নিয়োজিত তার পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ এবং নির্দয়। দায়িত্বগ্রহণের পর তিনি যুদ্ধ কৌশলে প্রথম যে সংযোজন আনেন; তা হলো- ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামো ধ্বংসের সর্বনাশী ধারা। যুদ্ধাঞ্চলে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর এই কৌশলে তিনি সিরিয়াতেই হাত পাকিয়েছেন। তবে তিনি বাস্তবতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হন না। সুরভিকিনের উদ্যোগের ফলেই খেরসন থেকে পিছু হটে আসার সুযোগ পেয়েছে রুশ সেনারা। নাহলে তাদের ইউক্রেনীয় আক্রমণের ফাঁদে আটকা পড়ার ঝুঁকি ছিল। সুরভিকিন তাদের জীবন রক্ষা করেছেন। এর আগে কিয়েভ বা খারকিভ থেকে পিছু হঠার ঘটনা যতোটা বিশৃঙ্খলভাবে হয়েছে– তার পুনরাবৃত্তি খেরসনে হয়নি সুরভিকিনের ঘনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানে। এটা খুবই সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করেছেন তিনি।
সুরভিকিনের দায়িত্বগ্রহণ ইউক্রেনে রাশিয়ার আরেকটি কৌশল বাস্তবায়নের শুরু করেছে। পুতিন বুঝতে পেরেছেন, তিনি হয়তো কিয়েভের দখল নিতে পারবেন না, তবে দেশটির চারটি প্রদেশকে অন্তত হস্তগত করতে পারবেন। সেজন্যই ডনেটস্ক, খেরসন, লুহানস্ক ও ঝাপোরিঝিয়াকে কিছুদিন আগে রুশ ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। এই পরিকল্পনারই গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবায়নকারী হলেন সুরভিকিন। রুশ প্রেসিডেন্টের আশা, অব্যাহত যুদ্ধ এবং শীতকালের নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে ইউক্রেনকে বিপুল পরিমাণ সহায়তা দান থেকে সরে যেতে বাধ্য হবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। একইসঙ্গে, পুনরায় রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি শুরু করতে চাইবে ব্রাসেলস।
তিনি বিশ্বাস করেন, ইউক্রেনের প্রতি সম্ভাব্য এই সমর্থন হ্রাস– বাস্তব রূপ নিলে নতুন একটি সফল রুশ অভিযানের দুয়ার খুলে দেবে। আর এ ধরনের অভিযান সুষ্ঠু, ধারাবাহিক ও নির্বিঘ্নে বাস্তবায়নে– সামরিক শক্তি পুনর্গঠনে তিনি সুরভিকিনের ওপর আস্থা রাখছেন।
রুশ সামরিক বাহিনী বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত; এসব কাটিয়ে সাফল্যের পথে ধাবিত হওয়া সুরভিকিনের জন্য বেশ কঠিন। যেমন সেনাদের নিম্ন মনোবল ও ধ্বংস হওয়া সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণের কাজটা সহজ হবে না। তবু নিজের অধীনে বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ধরে নেওয়া যায়, এই মুহূর্তে তিনি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যঅর্জন-নির্ভর যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়নেও ব্যস্ত।
এবার তিনি আগের ভুলগুলোকে অধ্যয়ন করছেন অবশ্যই। ইতঃপূর্বে রাশিয়া যে কায়দায় আক্রমণ করেছে, তাতে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। এই কম সেনা ঘনত্বের সুযোগটাই পেয়ে যায় ইউক্রেন। এবং সুবিধেমতো দুর্বল স্থানে হামলা চালিয়ে ক্ষতি করতে থাকে। এবার সুরভিকিনকে মোকাবিলা করতে হলে– তার নব-কৌশল ও পরিকল্পনা সম্পর্কে আগে থেকে জানতে হবে ইউক্রেনকে। নাহলে হারাবে লড়াইয়ে সুবিধেজনক অবস্থানে থাকার সুবিধা। একইসঙ্গে, ধরে রাখতে হবে অব্যাহত পশ্চিমা সমর্থন। আর তা নিশ্চিত করতে, ইউক্রেনীয় কমান্ডারদের যুদ্ধ কৌশলে উদ্ভাবনী স্মাক্ষর রাখতে হবে।
রাশিয়া দমেছে, কিন্তু ময়দান ছাড়েনি
এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির দিকে যারা একনিষ্ঠ নজর রাখছেন, তারা জানেন– ২০২৩ সালে রাশিয়া যা করবে তা খুব অভিনব কিছু নয়। যেমন ন্যাটোই আগ্রাসনের জন্য দায়ী– এ প্রচারণা চালিয়ে চীন, ভারতসহ নিরপেক্ষ অন্যান্য দেশের মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় যোগ না দেওয়াটা ধরে রাখতে চাইবে। সংঘাতে নিজ দেশবাসীর সমর্থন ধরে রাখতেও অপপ্রচার চালিয়ে যাবে ক্রেমলিন। যুদ্ধ ঘিরে যখন অতিরিক্ত সেনাদের তলব করা হয়েছে, তার মধ্যে এই সমর্থন ধরে রাখাটা বিশেষত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সমর্থন থাকলেই সামনে আরও মানুষকে সেনাসার্ভিসে যুক্ত করা যাবে। একারণেই এমনকী স্বৈরাচারীদেরও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মনোযোগ দিতে হয়।
পুতিন 'জ্বালানি যুদ্ধ'ও চালিয়ে যাবেন। গ্যাস থেকে ইউরোপকে বঞ্চিত রাখবেন এই আশায় যে, এতে তারা নিজ স্বার্থে কিয়েভের ওপর যুদ্ধ-বিরতিতে রাজি হওয়ার চাপ দিতে থাকবে। শীতে তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে ইউরোপের চাপটাও বাড়বে বলে পুতিন আশা করছেন।
ইউক্রেনের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে আরও হামলা পরিচালনাকেও উৎসাহিত করবেন তিনি। পুতিনের হিসাবে অনুসারে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলা শুধু ইউক্রেনের জনগোষ্ঠীকেই শীতে নাজেহাল করবে না– একইসঙ্গে দেশটিকে বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়াকেও ব্যয়বহুল করে তুলবে। একে তো যুদ্ধ, তার ওপর যে দেশে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহই নেই– সেখানে ইউক্রেনের ঘোর মিত্র দেশের বিনিয়োগকারীরাও আসতে চাইবেন না। আক্রমণও যদি বিনিয়োগকারীদের ঠেকাতে নাও পারে– তারপরও ব্যাপক অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হবে ইউক্রেনকে। যেমন চলতি বছরের জুলাই থেকেই একারণে বিদ্যুৎ রপ্তানি বন্ধ করতে হয়েছে কিয়েভকে।
তবে রাশিয়ার কৌশলের অন্যকিছু দিক হবে একেবারেই নতুন। আর এই পরিবর্তনে সুরভিকিন রাখবেন কেন্দ্রীয় ভূমিকা। এপর্যন্ত যা দৃশ্যমান– তাতে স্পষ্ট এই জেনারেলের প্রতি পুতিনের রয়েছে গভীর আস্থা। প্রথম কোনো সামরিক নেতার প্রতি তার এতোটা সমর্থন দেখা গেছে বলে সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স এর পরিচালক এভ্রিল হাইন্স।
সুরভিকিন সামরিক অভিযানের দৈনন্দিন তথ্য জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্টকে। আর পুতিন যদি মনে করেন, যুদ্ধ-সম্পর্কে তাকে সঠিক ও নির্জলা সত্য পরিবেশন করা হচ্ছে– তাহলে তিনি রাশিয়ার সামনে থাকা অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দিকে মনোনিবেশের সুযোগ পাবেন। আর তখন যুদ্ধ-পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা পাবেন সুরভিকিন। প্রয়োজন অনুসারে ব্যবহার করতে পারবেন, রাশিয়ার বিপুল বিচিত্র অস্ত্র সম্ভারের বিভিন্ন উপকরণ এবং বিশেষ বাহিনীগুলোকে।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে, রাশিয়ার বহুধা-বিভক্ত সামরিক কমান্ড ও ভাড়াটে যোদ্ধা গোষ্ঠীগুলোকে একক নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনার প্রয়াস পাবেন তিনি। এর মাধ্যমে রাশিয়ার বিমান ও স্থলবাহিনীকে একযোগে অভিযান পরিচালনায় যুক্ত করতে পারবেন। ফলে স্থাপন করা যাবে- যুদ্ধ তৎপরটার সাথে তার দেশের তথ্য প্রচারের সঙ্গতি। অর্থাৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম যেভাবে সাফল্যের কথা তুলে ধরে, তার সাথে তাল মিলিয়েই সফলতা বয়ে আনবে স্থল ও বিমান শক্তির যৌথ অভিযান।
তবে সেনাবাহিনী সুসংহত করার গেলেই– সেনারা যুদ্ধের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে যাবে- এমন নয়। সুরভিকিন এমন বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেটি ভুগছে নিম্ন মনোবলে। প্রতিনিয়ত সেনা হতাহত হচ্ছে তাদের, হারাচ্ছে উন্নত অনেক সরঞ্জাম।
এপর্যন্ত পাওয়া তথ্যপ্রমাণ ইঙ্গিত দেয়, হতাহত রুশ সেনাদের প্রতিস্থাপনকারী নতুন সেনারা এই যুদ্ধের জন্য দরকারি কঠোর প্রশিক্ষণ পায়নি। তাই শীতকালটা রক্ষণাত্মক কৌশলেই থাকবেন সুরভিকিন। এই সময়টা তিনি নিজ বাহিনীকে যতোটা সম্ভব ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে চাইবেন। আর একইসঙ্গে নতুন অভিযানের জন্য তাদের প্রস্তুতও করে তুলবেন এসময়ে। যেসব সেনা ইউনিটের জনশক্তি কমেছে, সেখানে নতুন ভর্তি হওয়া সেনাদের পাঠাবেন। তার আগে রাশিয়ায় তাদের দেওয়া প্রশিক্ষণের মান উন্নত করার উদ্যোগ নেবেন।
রাশিয়ার চলমান জরুরি শিল্পোৎপাদনকে কাজে লাগিয়ে সুরভিকিন আরও বেশি সংখ্যায় ও উন্নত মানের অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা করবেন। প্রধান প্রধান সরবরাহ রুট নিরাপদ করতেও নানাবিধ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেবেন। ভবিষ্যতের আক্রমণ অভিযান মাথায় রেখে– নতুন করে গড়ে তোলা হবে রসদ সরবরাহের নেটওয়ার্ক ও গোলাবারুদের মজুদ।
আক্রমণ অভিযানের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নের সমস্ত খুঁটিনাটি ত্রুটি দূর করতে সুরভিকিন যথাসম্ভব সতর্ক হবেন। যুদ্ধের ময়দানে রুশ সেনারা যেন এক লক্ষ্য অর্জনে লড়ে– সেটাই চাইবেন তিনি। তার পূর্বসূরী রুশ কমান্ডাররা যেমন ছোটখাটো লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়েও বিপুল শক্তিক্ষয় করেছেন বা বিক্ষিপ্ত পরিকল্পনায় হামলা করেছেন– সেসব ভুলের পুনরাবৃত্তি ঠেকানোই তার অভিপ্রায়। আর এটা করা গেলেই, রণাঙ্গনে থমকে যাবে ইউক্রেনের অগ্রযাত্রা।
আবার ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় হামলা অব্যাহত রেখে তিনি ইউক্রেনীয় এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পদকে (যেমন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) এই ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর দিকেই বেশি নিয়োজিত রাখতে পারবেন। ফলে কিয়েভের আক্রমণ অভিযান হারাবে দরকারি শক্তি। তাছাড়া, ইউক্রেনের বেসামরিক অবকাঠামোর এই ধবংসের চিত্র দুর্ভাগ্যজনক হলেও– রুশ জনগণকে উদ্দীপ্ত করে। ফলে এ ধরনের হামলায় রাশিয়ার ক্ষতি নেই কোনো, বরং পায় অসম এক সুবিধা; যেহেতু ইউক্রেন একই হারে রাশিয়ার অবকাঠামো ধ্বংসের সামর্থ্য রাখে না। যদিও ক্রিমিয়া সেতু ও বিভিন্ন সময় রুশ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে বেশ সাড়াই ফেলে দিয়েছে কিয়েভ।
সম্প্রতি ঐতিহাসিক লরেন্স ফ্রিডম্যান লিখেছেন, 'যুদ্ধের ময়দানে জিতছে ইউক্রেন; কিন্তু, কৌশলগত পর্যায়ে তারা রাশিয়ার ওপর পাল্টা-আঘাত হানার সামর্থ্য রাখে না।"
'ইকোনমি অভ ফোর্স' নামক এক ধরনের ছদ্ম-সামরিক মিশনও চালিয়ে যাবেন সুরভিকিন। এর মাধ্যমে এমনভাবে সামরিক কার্যক্রম চালানো হয়- যাতে শত্রু সেটিকে গুরুতর হুমকি মনে করে নিজেদের সেনাশক্তি ও উপকরণকে তা প্রতিরোধে নিয়োজিত করে। এবং দিনশেষে দেখা যায় তা পণ্ডশ্রম ও সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়; পুরো বিষয়টিই ছিল বিরোধীপক্ষের ছলনা।
এর একটি ক্লাসিক উদাহরণ বেলারুশে রুশ সেনাদের উপস্থিতি। ইউক্রেনের সাথে সীমান্ত রয়েছে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্রটির। সেখানে ছোট ছোট সেনা কন্টিনজেন্ট মোতায়েন রেখে– ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীকে ওই সীমান্তে সেনা মোতায়েনে বাধ্য করেছে মস্কো। ফলে এই সেনাদের দেশরক্ষার সংগ্রামে সরাসরি কাজে লাগাতে পারছে না কিয়েভ।
শত্রুকে এভাবে অনর্থক কাজে ব্যস্ত রেখে, নিজ বাহিনীর সাফল্যের পথ আরও কন্টকমুক্ত করতে চাইবেন সুরভিকিন। এরপর পুর্নদ্যমে শুরু করবেন স্থল অভিযান, যার মাধ্যমে পুতিন যেসব প্রদেশকে রুশ ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত করেছেন– সেগুলোর সিংহভাগ এলাকার দখল নিতে পারবে রাশিয়া।
কিন্তু, অভিজ্ঞ এ জেনারেল জানেন, ইউক্রেনও হৃত ভূমি পুনরুদ্ধার করতে চাইবে। আর সেটা ঠেকাতেই তিনি সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা (পরিখা, বাঙ্কার, পিলবক্স, ট্যাংক ট্র্যাপ ইত্যাদি) গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন।
রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় রুশীকরণ বা রুশভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির মতো রাজনৈতিক পদক্ষেপও নিতে পারেন তিনি। খেরসনেও রাশিয়া একাজ করেছিল। একইসঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইউক্রেনীয় রিভিনার বদলে চালু করা হবে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলে লেনদেন। বদলে ফেলা হবে স্কুলের শিক্ষাক্রম। অনেক শিশুকে রাশিয়ায় পাঠানো হবে–যাতে রুশ দম্পতিরা তাদের পালক নেয়।
নিঃসন্দেহে সুরভিকিন অতি-চতুর ও নিষ্ঠুর। কিন্তু, এখনও রাশিয়াকে হারানোর সুযোগ আছে ইউক্রেনের। কিয়েভের আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের সফল প্রচারণা ক্যাম্পেইনগুলো বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্রগুলোর জন্য অধ্যয়ন ও মুল্যায়নের বিষয় হতে পারে। যুদ্ধের ময়দানেও তারা পরিবর্তিত রুশ কৌশলের সাথে খাপ খাইয়ে পাল্টা আঘাত হানার সামর্থ্য প্রমাণ করেছে। সবশেষ পরিস্থিতি অনুসারে, রদবদল আনছে যুদ্ধ কৌশলে, সামরিক সংগঠনে। তাদের মনোবলও বেশ চাঙ্গা। তারপরও বলতে হয়, যুদ্ধে 'নিশ্চয়তা' নামক কোনো জিনিস নেই। আগে জয় যতই পাক, মিত্রদের সমর্থন ধরে রাখতে না পারলে– রুশ ভাল্লুকের থাবায় আরও ক্ষতবিক্ষত হতে হবে ইউক্রেনকে। আর তাতে পুতিনের নতুন কৌশল কার্যকর বলেই প্রমাণিত হবে। অন্যদিকে ইউক্রেন জিততে থাকলে প্রমাণ হবে– পুতিনের এই নতুন জয়ের মন্ত্রও আগেরগুলোর মতোই পথভ্রষ্ট, অপরিণামদর্শী।