জ্বালানি সংকট: জার্মানদের মোমবাতি জমা করার হিড়িক!
জার্মানিতে মোমবাতি প্রস্তুতকারী হওয়ার এটিই উপযুক্ত সময়! কিন্তু কেন?
ইউরোপিয়ান ক্যান্ডল ম্যানুফ্যাকচারার্স আসোসিয়েশন-এর টেকনিক্যাল ডিরেক্টর স্টিফেন থম্যান জানান, জার্মানিতে এখন মোমবাতির চাহিদা অনেক বেশি।'
জার্মানিতে মোমবাতি ব্যবসায়ের প্রসার ঘটে করোনা মহামারির সময়ে। সেসময় সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে, দেশবাসী বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় কাটাতে থাকেন। মোমবাতি শিল্প অনুমান করেছিল লকডাউনের পর ব্যবসায়ের ব্যাপ্তি সীমিত হয়ে আসবে। কিন্তু এর পরপরই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। খবর এনপিআর-এর।
যুদ্ধের আগে জার্মানির অর্ধেকের বেশু প্রাকৃতিক গ্যাস আসত রাশিয়া থেকে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইউ)-এর দেশগুলোর মধ্যেই জার্মানিই ছিল রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। এই গ্যাস ব্যবহৃত হতো বিদ্যুৎ উৎপাদন, শীতে বাসাবাড়ি উষ্ণ রাখা এবং কলকারখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে।
যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কমাতে থাকে। কিন্তু জার্মান অর্থনীতি রাশিয়ান গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। ফলে দেশটির রাজনীতিবিদেরা আমদানি পুরোপুরিভাবে বন্ধ করতে আগ্রহী হননি।
তবে, জার্মানিতে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। পুতিন সরকারের দাবি, বাল্টিক সাগরে একটি বড় গ্যাস পাইপলাইনের মেরামতের প্রয়োজন, তাই রপ্তানি বন্ধ।
এরপর সেপ্টেম্বরে, একই পাইপলাইনের কিছু অংশ রহস্যজনকভাবে বিস্ফোরিত হয়। কীভাবে এবং কেন এটি ঘটল, কর্মকর্তাদের মধ্যে তা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। তবে কারণ যা-ই হোক না কেন, জার্মানিতে রাশিয়ান গ্যাসের আমদানি এখন প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
এখন জার্মানির লক্ষ্য হলো, দেশের জ্বালানী অর্থনীতিতে পরিবর্তন আনা এবং গ্যাসের ব্যবহার কমানো। এবং এতে মোটামুটি সফলও হচ্ছে দেশটি। তবে জ্বালানির উচ্চ দাম এবং ঘাটতি ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কায় জার্মানরা বেশ উদ্বেগের মধ্যে আছেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই মোমবাতি কিনে মজুত করছেন তারা।
জ্বালানি সরবরাহে পরিবর্তন
জার্মান সরকার গ্যাসের ব্যবহার কমাতে এবং এর জ্বালানি সরবরাহে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করছে। শীতপ্রধান দেশে শীতের সময় বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এই চাহিদাকে মাথায় রেখে, শীতে যেন বড়সড় ঘাটতির সম্মুখীন হতে না হয়-চলতি বছরের মার্চের দিকে জার্মান সরকার গ্যাসের চাহিদা কমানোর লক্ষ্যে কিছু নতুন ব্যবস্থা্র দ্বারস্থ হয়।
যেমন, গরম পানির ব্যবহার কমান, রাত ১০টার পরে বিজ্ঞাপন বিলবোর্ড এবং স্মৃতিস্তম্ভের আলো নেভানো, ব্যক্তিগত সুইমিং পুলে হিটিং বন্ধ করা এবং কিছু সরকারি ভবনে তাপমাত্রা কমিয়ে রাখতে দেশবাসীদের উৎসাহিত করছে সরকার।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য দেশটির সকল সরকারি ভবনে এখন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।
চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত বন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা যায়, গ্যাসের চাহিদা ২০ শতাংশে কমিয়ে আনতে পারলে এবং সেই সাথে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎসের পরিবর্তন করতে পারলে, কোনো বড়সড় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ছাড়াই জার্মানি শীতকাল পার করতে সক্ষম হতে পারে।
জার্মান সরকার ঠিক এ কাজটাই করছে। ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি, আমদানির দেশও পরিবর্তন করা হচ্ছে। দেশটি রাশিয়ার বদলে নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, বেলজিয়াম, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে গ্যাস আমদানি করছে। এসব 'নন-রাশিয়ান উৎস' থেকে গ্যাস আমদানি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোও স্থাপন করা হচ্ছে।
জ্বালানির ধরনেও বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে সরকার। প্রাকৃতিক গ্যাসকে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে সৌরশক্তি দিয়ে। এছাড়াও বাড়ান হয়েছে কয়লার ব্যবহার।
তবে গ্যাসের চাহিদা কমানোর উদ্যোগ এবং জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি ও এতে বৈচিত্র্য আন্নার সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আগের বছরের তুলনায় চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চারগুণ বেড়েছে৷ এরপর থেকে দাম কিছুটা কমলেও, যুদ্ধ শুরুর আগে যে দাম ছিল তার চেয়ে বর্তমান দাম এখনো অনেক বেশি। নতুন উৎস ব্যবহার সত্ত্বেও, সরবরাহ কমে যাওয়া এবং পরিবহনে আগের চেয়ে ব্যয়বহুল বলে এখন গ্যাসের এই চড়া দাম।
শীতকাল পার করার মতো জ্বালানি মজু্ত আছে বলে দেশবাসীদের আশ্বস্ত করেছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিএক্স-এর অর্থনীতিবিদ বেল মল একই কথা বলেন। তিনি জানান, 'জার্মানির অরাকৃতিক গ্যাসের রিজার্ভ প্রায় ১০০ শতাংশ রয়েছে, যেটি অন্তত পরবর্তী আড়াই মাস কাটাতে যথেষ্ট হবে।'
তবে তা সত্ত্বেও জার্মানদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বেন বলেন, 'গ্যাসের মজুত মুঠোফোনের ব্যাটারির মতো। ধরুন, কোথাও ভ্রমণ করতে গিয়ে দেখলেন, ফোন চার্হার সাথে নেননি। তখন আপনার ফোনে ১০০ শতাংশ চার্জ আছে জেনেও আপনি নিশ্চয় খুশি হবেন না। কারণ আপনি জানেন এই চার্জে আপনার সর্বোচ্চ একদিন চলে যাবে।'
মোমবাতি ব্যবসায়
রাশিয়ার সাথে ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষের পর, জ্বালানির নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বিদ্যুতের দাম হয়েছে আকাশচুম্বী। এছাড়া জার্মানিতে যেহেতু বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয়, তাই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শঙ্কাও বেড়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বড়সড় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের আশঙ্কা নেই। তবে একই সাথে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য পেওস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে দেশবাসীদের।
জনগণ কীভাবে জ্বালানি সাশ্রয় করবে তার কিছু নির্দেশনা দিয়েছে দেশটির ফেডেরাল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড ক্লাইমেট প্রোটেকশন। সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড ডিসেস্টার এসিস্ট্যান্সও একই পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, বাসাবাড়ি উষ্ণ রাখার পরিবর্তে গরম কাপড়চোপড় পরিধান বাড়ান, ফ্ল্যাশলাইট রাখা এবং পর্যাপ্ত ব্যাটারি ও মোমবাতি মজু্ত করে রাখা।
এর ফলে মোমবাতির চাহিদা বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে মোবাইল হিটারের চাহিদা, যার দরুন, পাওয়ার গ্রিডের সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়ার ভয়ে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছে দেশটির ইউটিলিটি এজেন্সি।
তবে সবকিছু মিলিয়ে জার্মানি রাশিয়ান জ্বালানি থেকে সরে আসতে পারছে বলে মনে করেন জার্মান অর্থনীতিবিদেরা।
জার্মানির বর্তমান লক্ষ্য হলো ২০৩৫ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ১০০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া।
বন ইউনিভার্সিটির রাজনীতিবিদ মরিটজ কুন বলেন, 'দিনশেষে যেখানে পৌঁছাতে চাচ্ছি, আমরা সেদিকেই আগাচ্ছি। লক্ষ্য ছোঁয়াকে আরেকটি দ্রুততর করছি মাত্র।'