২০ হাজার ডলারের ড্রোন ঠেকাতে ৩ মিলিয়নের মিসাইল? ইউক্রেনকে অভয় দিতে পারবে না প্যাট্রিয়ট
ইউক্রেনে মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্যাট্রিয়টকে 'যথেষ্ট পুরনো' হিসেবে অভিহিত করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, এটি রাশিয়ার লক্ষ্য অর্জনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অনেক বিশেষজ্ঞও মনে করেন, এ ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ার জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হবে না। খবর দ্য ইউরেশিয়ান টাইমস-এর।
বরং প্যাট্রিয়টের মাধ্যমে এক প্রকার প্রতীকী রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জিত হবে। প্যাট্রিয়টের প্রযুক্তি, সংখ্যা, লজিস্টিকস ও অর্থনৈতিক দিকগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, এগুলো কোনো ক্ষেত্রই ইউক্রেনের প্রয়োজনের সঙ্গে মেলে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য নতুন করে ১.৮৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। তারই অংশ হিসেবে প্যাট্রিয়ট পেতে যাচ্ছে ইউক্রেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্যাট্রিয়ট মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চেয়ে আসছিল ইউক্রেন।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যয়বহুল, ভারী, ও অল্পসংখ্যক প্যাট্রিয়ট মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোন হামলাকে রোধ করা যাবে না এবং এতে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতিও পাল্টাবে না।
স্রেফ মনোযোগ আকর্ষণ?
ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর এয়ার পাওয়ার স্টাডিজ (ক্যাপস)-এর মহাপরিচালক এয়ার মার্শাল অনিল চোপড়া (অব.) মনে করেন না চলমান যুদ্ধে প্যাট্রিয়ট পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
'সার্বিকভাবে ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে স্টেট-অব-দ্য-আর্ট এ প্রযুক্তি ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করা চ্যালেঞ্জিং হবে। আর্টিলারি সিস্টেমের চেয়ে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক বেশি জটিল হওয়ার কারণে প্রশিক্ষণের জন্যই কয়েক মাস থেকে এক বছর লেগে যেতে পারে,' বলেন তিনি।
চলমান যুদ্ধে যুদ্ধবিমানের চেয়ে ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোন হামলাই আকাশযুদ্ধের রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে এমন দৃশ্যপটে প্যাট্রিয়ট কীভাবে কার্যকর হবে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে চোপড়া বলেন, 'প্যাট্রিয়টের এ স্থানান্তর বাস্তবিক সামরিক ব্যবহারের চেয়ে রাজনৈতিক প্রতীকতাকে বেশি প্রকাশ করবে।'
প্যাট্রিয়ট ব্যবহার করতে প্রায় ৮০ জনের মতো ক্রু-এর দরকার হয়। এছাড়া এটি পরিচালনায় লাগে ভারী ও শক্তিশালী কম্পিউটার, ফেজড অ্যারো রাডার, একটি ফায়ার কন্ট্রোল ব্যবস্থা, ও একটি উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা (লঞ্চার)। এর ফলে এটিকে চলমান উৎক্ষেপণ ব্যবস্থার কাতারে ফেলা যায় না।
মার্কিন থিংকট্যাংক দ্য সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর তথ্যমতে, প্যাট্রিয়ট সারাই, ফায়ার কন্ট্রোল পরিচালনা, ও উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা পরিচালনার কোর্সে সময় প্রয়োজন হয় যথাক্রমে ৫৩, ২০, ও ১৩ সপ্তাহ। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে প্যাট্রিয়ট পৌঁছাতে পারে। তার অর্থ, এসব প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোর সময় অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে।
তবে ইউক্রেন চাইরে এর এস-৩০০ বা বাল্ক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অভিজ্ঞ ক্রুদের প্যাট্রিয়টের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠাতে পারে। এছাড়া এখন পর্যন্ত জানা যায়নি প্যাট্রিয়টের কোন সংস্করণ পেতে যাচ্ছে দেশটি।
বিভিন্ন প্রতিবেদনের খবর, কেবল এক ব্যাটারি প্যাট্রিয়ট পেতে যাচ্ছে ইউক্রেন। ট্রাকে বসানো উৎক্ষেপণ ব্যবস্থা ও চার থেকে আটটি লঞ্চারের মাধ্যমে একটি প্যাট্রিয়ট ব্যাটারি তৈরি হয়। এসব লঞ্চারে মিসাইলের ধরনের ওপর ভিত্তি করে চার থেকে ১৬টি মিসাইল থাকতে পারে।
এ ধরনগুলো হতে পারে, চারটি প্যাক-২ মিসাইল, ১৬টি প্যাক-৩ মিসাইল, বা ১২টি এমএসই মিসাইল। এসব ধরনগুলোর বিভিন্ন মিশ্রণও লঞ্চারগুলোতে ব্যবহার করা যায়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার কিস্তিমাত
প্যাট্রিয়ট নিয়ে ইউক্রেন বর্তমানে কিস্তিমাত পরিস্থিতিতে পড়েছে—পরিচালনায় দীর্ঘমেয়াদি সময়, দামের অনুপাতে কম সাফল্য, সংখ্যায় অল্প, এবং যুদ্ধের মূল থিয়েটার (পূর্ব ও দক্ষিণ) থেকে দূরে হওয়া- যেগুলো রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য।
রাশিয়ার জন্য একটি উচ্চমানের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে প্যাট্রিয়ট। আর প্রয়োজনে এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে বিধ্বস্ত করতে বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা নয় রাশিয়ার।
গত দুই মাসে রাশিয়া ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য মিসাইল (স্যাম) প্ল্যাটফর্ম চিহ্নিত ও ধ্বংস করার কৌশল ঠিক করে ফেলেছে।
কৌশলগত ভূমিকা থেকে সরিয়ে আনা কেএইচ-৫৫এসএম মিসাইলগুলোতে নিশ্চল ওয়্যারহেড বসিয়ে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রলোভনে ফেলতে পারে রাশিয়া।
ডিকয় মিসাইল ধ্বংস করার ফাঁদে পা দিলে প্রকাশিত হয়ে পড়বে ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার অবস্থান। এরপর সু-৩৫'র মতো যুদ্ধবিমান দিয়ে সেগুলোকে ধ্বংস করতে পারবে রাশিয়ান বিমানবাহিনী।
এছাড়া রাশিয়ার টুপোলেভ টু-২১৪আর বিমানগুলো রাশিয়ার আকাশসীমায় থেকেই ইউক্রেনের মিসাইল লঞ্চারের ওপর নজরদারি চালাতে সক্ষম।
সাধারণত, প্যাট্রিয়টের মতো বড় ও নিশ্চল ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নিরাপত্তার জন্য ছোট ধরনের বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে ইউক্রেন যদি এমনটা করতে চায়, তাহলে দেশটিকে ফ্রন্টলাইন থেকে এ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাগুলোকে নিয়ে এসে এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হবে।
তাছাড়া রাশিয়ার ড্রোন হামলার কারণে ইউক্রেনের এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।
ইউক্রেন যদি ফ্রন্টলাইনে প্যাট্রিয়ট মোতায়েন করে, তাহলে গেরান-২ বা ল্যান্সেট-৩'র মতো কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করে রাশিয়া সহজেই এগুলো ওপর হামলা চালাতে পারবে। আর যদি ইউক্রেন কিয়েভের মতো শহরে প্যাট্রিয়ট স্থাপন করে, তাহলে রাশিয়ার জন্য আক্রমণ চালানো কঠিন হয়ে পড়বে।
কারণ, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার সু-৩৫'র মতো যুদ্ধবিমানকে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে এসে হামলা করতে হবে। আর এতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো, প্যাট্রিয়ট ধ্বংস করতে এসে প্যাট্রিয়টের আঘাতেই বিধ্বস্ত হতে পারে বিমানগুলো।
২০ হাজার ডলারের ড্রোন ঠেকাতে তিন মিলিয়নের মিসাইল?
বর্তমান যুদ্ধে ইউক্রেনের অনেক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে রাশিয়া। গোলাবারুদ উৎপাদন করার জন্য ইউক্রেনের নিজস্ব কোনো কারখানা নেই।
অন্যদিকে যদিও পুতিন স্বীকার করেছেন, রাশিয়া গোলাবারুদ সংকটে ভুগছে—তাও একথা ভুললে চলবে না যে রাশিয়ার নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প রয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এ শিল্প এখন আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
যদি রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর তৃতীয় দফায় ড্রোন ও মিসাইল হামলা শুরু করে, তাহলে ইউক্রেন কি ২০,০০০ ডলারের ড্রোন ও প্রতিটি এক লাখ ডলারের ক্রুজ বা ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করতে ৩-৪ মিলিয়ন ডলারের প্যাট্রিয়ট মিসাইল নিক্ষেপ করবে?
প্যাট্রিয়ট মিসাইল হয়তো রাশিয়ার প্রথম সারির যুদ্ধবিমানগুলোর বিরুদ্ধে সমানে-সমানে লড়তে পারবে; কিন্তু কোনোভাবেই এ মার্কিন সামরিক প্রযুক্তির পক্ষে এ যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়ে রাশিয়াকে 'ব্যাকফুটে' নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।