যেকারণে শ্রীলঙ্কার দুর্দশা সহসাই শেষ হচ্ছে না
গত মে মাসে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয় বা খেলাপি করে শ্রীলংকা। এসময় উত্তাল ছিল দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আর আমজনতার দুর্ভোগ পৌঁছায় চরমে। সংকট কিছুটা লাঘবে, ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটি এখনও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২৯০ কোটি ডলারের উদ্ধার প্যাকেজের অপেক্ষা করছে। সত্যিকার অর্থেই, বৈদেশিক মুদ্রার বড় ঘাটতি দেশটির। এমনকী নেই জ্বালানি আমদানির দরকারি সম্পদ। অর্থনীতি দিনে দিনে আরো গভীর খাদের অতলে হারাচ্ছে। এক বছরেই দ্বিগুণ হয়েছে দারিদ্র্য হার; ধস নেমেছে সার্বিক উৎপাদন ও সেবা খাতে, উল্লম্ফন করেছে মুল্যস্ফীতি। যেকারণে এক দশকের অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এসব ঘটনায় প্রশ্ন জাগে– বৈদেশিক ঋণ পুনর্গঠনের কাজটি কবে এতোটা কঠিন হয়ে পড়লো?
বিশ্ব পরিস্থিতি যখন এতোটা নাজুক ছিল না, তখন দরিদ্র দেশগুলো খেলাপি হতো ধনী দেশগুলোর কাছে। প্যারিস ক্লাব নামে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানসহ অন্যান্য শীর্ষ দাতা দেশগুলো এবং আইএমএফ নিজ সদস্যদের মধ্যে এই ঋণের বোঝা হ্রাসের উদ্যোগ ভাগ করে নিত। কারণ, সংকটে থাকা অবস্থায় ঋণগ্রহীতা দেশের থেকে ঋণ আদায় সম্ভব নয়। এই অবস্থায় দেশটির দুর্ভোগ অব্যাহত রেখে দাতাদের কারোরই লাভ ছিল না।
কিন্তু, শ্রীলঙ্কা দেনা সংকটে পড়েছে ২১ শতকে এসে। যখন দাতাদের মধ্যেও রয়েছে পরস্পর-বিরোধী স্বার্থের দ্বন্দ্ব। যেমন- ব্ল্যাকরক ইনকর্পোরশন, মরগ্যান স্ট্যানলির মতো বৃহৎ পশ্চিমা সংস্থাগুলো ১২.৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণদাবি আদায়ে নিজস্ব জোট গঠন করেছে। এটা শ্রীলঙ্কা সরকারের বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া মোট ঋণের অর্ধেক অংশ। অপরদিকে, শ্রীলঙ্কাকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ঋণদাতা চীন ও ভারত। দিল্লি বা বেইজিং কেউই চায় না– এই সংকট পুঁজি করে অপরপক্ষ অর্থনৈতিক বা ভূরাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে এগিয়ে থাকুক।
দাতাদের এই বহুমুখী দ্বন্দ্বের চাপে নাজেহাল, অবরুদ্ধ শ্রীলঙ্কা। এই অবস্থায় দেনার ভার লাঘবে সবচেয়ে বড় ঋণদাতার দিকেই নির্ভর করার কথাও ভাবছে। এজন্য দেনা সংস্থাপনে 'মোস্ট ফেভার্ড ক্রেডিটর' নীতি গ্রহণ করতে চায়। এর মাধ্যমে বেইজিংকে ঋণ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবচেয়ে ভালো শর্ত প্রস্তাব করা হবে।
এককালে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ঋণদাতার এই অবস্থান ভারতের থাকলেও, আজ সেখানে চীন। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার নেওয়া মোট ঋণের ৫২ শতাংশই দিয়েছে বেইজিং। কলম্বো চীনকে আকর্ষণীয় সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে ঋণের একটি বড় অংশ মওকুফ চাইতে পারে।
তবে এই অগ্রাধিকারের আশ্বাসও দেনা নিয়ে আলোচনায় গতি আনতে পারেনি। বিপদের ওপর বিপদ, সম্প্রতি নিউইয়র্কের আদালতে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অর্থদাবির মামলা করেছে হ্যামিলটন রিজার্ভ ব্যাংক। সব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, আইএমএফ এর সাথে চুক্তির পরও অব্যাহত থাকবে কলম্বোর দুর্দশা।
অতীতে বিদেশি একটি সংস্থার দেনা মেটাতে না পেরে আর্জেন্টিনাও ঋণ মামলায় জড়ায়। অর্থদাবি পূরণে দেশটির রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাজেয়াপ্তের দাবি করেছিল বিদেশি সংস্থাটি। ফলে ২০০১ সালের ঋণ খেলাপির ১৫ বছর পরে এসেও সংস্থাটির আইনজীবীরা প্রেসিডেন্টের বিমান বা নৌবহর বাজেয়াপ্তের দাবি করবে বলে শঙ্কায় ছিল বুয়েনস আইরিস।
২০১৬ সালে ইলিয়ট ম্যানেজমেন্ট নামক সংস্থাটির অর্থদাবি পূরণ করা হয় এবং তারা আদালতের প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। কিন্তু, এটা কোনো একক ঘটনা নয়। বরং দিনে দিনে বাড়ছে বেসরকারি সংস্থার ঋণ আদায়ে সরকারগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করার ঘটনা।
যেমন ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে ১০ শতাংশেরও কম অর্থনৈতিক সংকট কবলিত দেশগুলোকে মামলার সম্মুখীন হতে হতো। বর্তমানে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক দেশকে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জুলিয়ান শুমাখারসহ অন্যান্য গবেষকদের তথ্যমতে, অন্তত ৩ শতাংশ দেনা পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সরকারগুলো যে ধরনের মামলার শিকার হচ্ছে, তা অস্বাভাবিক। এমনকী বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রেও এ ধরনের কড়া আইনি পদক্ষেপ নজিরবিহীন।
গবেষকরা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, 'অর্থদাবি নিয়ে বিরোধের ফলে, এত বেশি পরিমাণে মামলা আদালতে গড়ানোর মতো আইনিক্ষেত্র রয়েছে বলে অন্তত আমাদের জানা নেই'।
এই বাস্তবতায়, শ্রীলঙ্কাকে আরো চাপের মধ্যে রেখে বাড়তি সুবিধা আদায়ে কিছু বিনিয়োগকারী সচেষ্ট হবে– এর জোর আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশি সংস্থাগুলো সরকারি বন্ড কিনে এই ঋণ দেয় বা বিনিয়োগ করে। তাদের ওপর যত বেশি লোকসান আরোপ করা হবে, ততো বেশি সম্ভাবনা রয়েছে- তারা এগুলো বিক্রির চেয়ে হাতে রাখাই শ্রেয় মনে করবে। তাছাড়া, বন্ড ক্রেতাদের লোকসান কম রাখলে– আইএমএফকে দ্বিতীয়বারের মতো পুনরুদ্ধার তহবিল দানে রাজি করাতে পারবে না কলম্বো।
সার্বিকভাবে আন্তর্জাতিক বন্ডে ৫০ শতাংশ ছাড়; দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের ২৫ শতাংশ দেনা মওকুফ হলেও- আগামী ১০ বছরে শ্রীলঙ্কা সরকারের দেনার বোঝা জিডিপির ১৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বন্ডের বর্তমান সুদহারে। যা বর্তমানে জিডিপির ১২০ শতাংশ বলে জানিয়েছে শ্রীলঙ্কার একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ভেরিটে রিসার্চ। নীতি গবেষণা সংস্থাটির প্রক্ষেপণ অনুসারে, বর্তমান বৈদেশিক ঋণের ম্যাচুরিটির মেয়াদ ১০ বছর বর্ধিত করা হলেও এই বোঝা জিডিপির ১০১ শতাংশে নামবে।
সংকট এখানেই শেষ নয়, স্থানীয় মুদ্রায় নেওয়া ঋণ ব্যবস্থাপনাও হবে যথেষ্ট জটিল। যেমন ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়ার পর ৬০ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের পুঁজির বড় অংশই হারিয়েছে। স্থানীয় বন্ড বাজারের এই দুর্দশাকে আপাতত অস্তিত্ব রক্ষার মতো শল্যপাচার হিসেবে দেখা হতে পারে।
এরমধ্যে, ভাগ্য সহায় হলে– চা রপ্তানি, টেক্সটাইল ও পর্যটন খাতের সুবাদে বর্তমানে উৎপাদনে যে ১২ শতাংশ সংকোচন দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব হতে পারে।
ডলারের চাঙ্গাভাব এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ধীরে ধীরে লঘু হতে থাকায়– পণ্য সংকটের অবসান হতে পারে, যা মূল্যস্ফীতিকেও কমাবে।
তবে দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আস্থা ফিরতে হবে বিনিয়োগকারীদের। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রণিল বিক্রমাসিংহ যথার্থই বলেছেন, যখন দেশে অর্থনীতি বলেই কিছু নেই– তখন তা সংস্কারের চেষ্টাও বৃথা। একটি সচল আর্থিক ব্যবস্থা অবশ্য রয়েছে। এটিকে দৃঢ় করতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ম্যান্ডেট পরিবর্তন করে হংকং এর মতোন নির্দিষ্ট বিনিময় হার ভিত্তিক কারেন্সি বোর্ড চালু করা যেতে পারে।
আইএমএফ এর তাগিদে শ্রীলঙ্কার নতুন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইন করা হয়েছে, এতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত একটি স্বাধীন মুদ্রানীতি গ্রহণে সক্ষম কাঠামো গড়ার নীতিমালা রয়েছে। ফলে বর্তমানের অবাস্তব ঋণচুক্তিগুলোকে হয়তো সংকট কেটে গেলে রক্ষা করতে চাইবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকশে ও তাদের প্রভাবশালী পরিবারের অদূরদর্শী, বিধ্বংসী নীতি দেশটির বর্তমান অবস্থার জন্য সিংহভাগ দায়ী। এই সংকটকালে পাওনাদারদের অর্থদাবি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার চেষ্টাকে ব্যাহত করছে। তবু আশা করা যায়, ২০২৩ সাল– ২২ মিলিয়ন জনতার দ্বীপরাষ্ট্রটির জন্য আরো সুপ্রসন্ন ভাগ্য আনবে, আনবে আরো অর্থ ও উদ্ধারের নতুনতর আইডিয়া।