ইউক্রেনে রাশিয়ার নতুন কমান্ডার যেভাবে যুদ্ধকে বদলে দিতে পারেন...
তিন মাস আগে জেনারেল সের্গেই সুরভিকিনকে ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গত সপ্তাহে জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভকে এ দায়িত্ব অর্পণের ঘোষণা দিয়েছে মস্কো। এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক অনেক পর্যবেক্ষককে বিস্মিত করেছে। কারণ, তাদের মতে, সুরভিকিন দায়িত্ব নিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় অনেক উন্নতি সাধন করেছিলেন। অন্যদিকে, যুদ্ধের প্রথম দিকের আগ্রাসন অভিযান, যা পরে বিপর্যয়ে রূপ নেয়– তার পরিকল্পনার জন্য জেনারেল গেরাসিমভই অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু, সুরভিকিনের তুলনায় ক্রেমলিনের আরো বেশি ঘনিষ্ঠজন তিনি। তাই আবারো এই সুযোগ পেলেন।
ভ্যালেরি গেরাসিমভ রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, তার পদবি হলো- চিফ অব জেনারেল স্টাফ। বিশ্বস্ততা তার ওপর এ দায়িত্ব দেওয়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান কম্যান্ডের শীর্ষ পর্যায়ে এ পরিবর্তন নিয়ে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ওপর বিশেষজ্ঞ রব লি'র সাথে আলাপ করেন দ্য নিউ ইয়র্কারের প্রতিবেদক। বিস্তৃত এই সংলাপে রব লির সঙ্গে এ সিদ্ধান্তের পেছনের নানান কারণ নিয়ে কথা বলেন তারা। রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টায় কোথায় অগ্রগতি হয়েছে, আর কোথায় কোথায় হয়নি– তাও উঠে আসে এসময়। মস্কোর ভাড়াটে যোদ্ধাদের সংস্থা– ওয়াগনার মার্সেনারিদের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেন।
দ্য নিউ ইয়র্কার থেকে বিস্তৃত ওই আলাপচারিতার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হলো টিবিএসের পাঠকদের জন্য।
প্রশ্ন: সুরভিকিন, যে জেনারেলের সম্প্রতি পদাবনতি হলো– গত তিন মাসে তিনি তো যুদ্ধের মোড় কিছুটা হলেও রাশিয়ার পক্ষে নিয়ে আসছিলেন বলে জানা যায়। আসলে তার দায়িত্বকালে কী বদলেছে আর কী অপরিবর্তিত রয়েছে?
রব লি: গত কয়েক মাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি হলো- রাশিয়ার সেনা সমাবেশ বা নতুন সেনা ভর্তির উদ্যোগ। খারকিভের অধিকাংশ এলাকা হারানোর পর এবং খেরসনে অভিযান শুরুর পর, গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে তারা এ উদ্যোগ নেয়। তখন এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল রণাঙ্গনে তাদের পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাই এ ধরনের কিছু তাদের করতেই হতো।
এর আগে নতুন সেনা মোবিলাইজেশনের তাগিদকে চেপে রাখেন পুতিন। অনেকে ভেবেছিলেন, তিনি এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের দিবসে ঘোষণা করবেন। তারপর মনে করা হচ্ছিল, গ্রীষ্মকালের কোনো সময়ে। কিন্তু, তিনি সেটা করেননি। রাশিয়ার এই বৈশিষ্ট্যকে কালক্ষেপণ করার কৌশল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়; যার আওতায় পুতিন ইচ্ছে করেই কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেননি এবং ঘটনাপ্রবাহ বিপরীত দিকে মোড় নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন।
সুরভিকিনকে নিয়োগের আগে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার জেনারেলরা খেরসন অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চাইছেন, কিন্তু তাতে সম্মতি দেননি পুতিন। এর ফলে আমি ভেবেছিলাম, সুরভিকিন নিপ্রো নদীর অপর পাড় থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চাইছেন, কিন্তু তাকে সে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সুরভিকিনের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট যৌক্তিকও, কারণ নিপ্রো বেশ প্রশস্ত একটি নদী ও বিশাল এক প্রাকৃতিক বাধা। তাই ইউক্রেনের আক্রমণের মুখে রুশ সেনাদের নদীর এপাড়ে সরিয়ে আনা গেলে, তাদের আরো শক্তিশালী অবস্থানে রাখা যাবে। প্রতিরক্ষা লাইন দৃঢ় হবে। সুরভিকিন যখন পদোন্নতি পেলেন, তখন হয়তো পুতিনও এটা উপলদ্ধি করে আগের অনঢ় অবস্থান থেকে সরে আসেন।
সুরভিকিন যুদ্ধের সার্বিক ভারগ্রহণের পর থেকে এভাবে রাশিয়ার জন্য পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি সাধিত হয়। রুশ সেনারা খেরসন নদীর পশ্চিম পাড় থেকে সরে আসে। তবে এটাও ঠিক এজন্য তাকে দোষারপ করার সুযোগ রয়ে যায়, যার সুযোগে ক্রেমলিনের আরো বিশ্বস্তজনদের এ ব্যর্থতার দায়মুক্তিও দেওয়া যায়।
সে যাই হোক, সুরভিকিনের তত্ত্বাবধানে রাশিয়ার জন্য সার্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হয়েছিল। রুশ সামরিক বাহিনীর মৌলিক ও কাঠামোগত সমস্যা তখনও অনেক ছিল, যা সুরভিকিনকে সামলাতে হয়েছে। কিন্তু, রাশিয়া তখন ইউক্রেনের বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে শুরু করে। যেটা ইউক্রেনের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের অনেক জ্বালানি ও বিদ্যুতের স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। অর্থনীতির সংকট আরো গভীর হয়। একইসঙ্গে, সুরভিকিন রুশ বাহিনীর যুদ্ধের সম্মুখভাগকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরান। সাম্প্রতিক সময়ে, তারা সোলেদার শহরেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট ইউক্রেন, নাকি রাশিয়া– কে এই শক্তিক্ষয়ের, সামর্থ্যের প্রদর্শনের লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত জিতবে– সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ, রাশিয়ার নতুন সেনা ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে; ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রুপ কারাবন্দিদের যুদ্ধে এনেছে।
সুরভিকিন কঠিন এক সময়ে দায়িত্ব নেন, কিন্তু তিনি একা নন– ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে রুশ সেনানায়কদের কাছে পুতিন এমন অনেক কিছু প্রত্যাশা করেছিলেন, যার বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। এ ধরনের লক্ষ্যপূরণের সামর্থ্য ছিল না তাদের হাতে, অথচ পুতিন যেসব এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন, তা না করতে সেনা কর্মকর্তাদের আদেশ দিচ্ছিলেন। এভাবে নিজ সেনানায়কদের ওপর সার্বিকভাবে কিছু সমস্যার ভার পুতিনই চাপান। এতকিছুর মধ্যেও যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখভাগকে স্থিতিশীল করতে তুলনামূলক সাফল্য পান সুরভিকিন। এই অবসরে রাশিয়ার নতুন সেনাভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায়, এখন তাদের অস্ত্রসজ্জিত করে, প্রশিক্ষিত করে, মোতায়েন করা যাবে। এসব ইউনিট মোতায়েন করামাত্র জনবলের দিক থেকে আবারো এগিয়ে যাবে রাশিয়া।
তাই তাদের স্বল্পমেয়াদি কৌশলটি হয়তো ছিল, 'সম্মুখভাগের আসন্ন অবনতি ঠেকানো। দখলীকৃত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা এবং সেনা সমাবেশের জন্য অপেক্ষা করা। সেনা সমাবেশ সম্পন্ন হলেই আক্রমণে ফেরার পরিকল্পনা করা হয়'।
প্রশ্ন: ইউক্রেনে আগ্রাসনের প্রাথমিক পরিকল্পনা জেনারেল গেরাসিমভ-ই করেছিলেন বলে জানা যায়। এটা কতোটা সঠিক?
লি: তিনি ঠিক কী করেছিলেন, সেবিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। তারপরও বলা যায়, চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে নিঃসন্দেহে তিনি (যুদ্ধ-পরিকল্পনায়) একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছেন। যুদ্ধের আগে আমি ভেবেছিলাম, পুতিন হয়তো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেবেন, আর সেই অনুযায়ী জেনারেলরা অভিযানের পরিকল্পনা করবেন। কিন্তু, আসলেই যা হয়েছে, আমি মনে করি সেটা ছিল এফএসবি'র (কেজিবি উত্তরসূরী রুশ গোয়েন্দা সংস্থা) পরিকল্পনা অনুসারে, যেখানে পুতিন ও ক্রেমলিনের মুষ্টিমেয় কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।
তাই আমার মনে হয়, এই পরিকল্পনা রুশ সেনাবাহিনীর ওপর এক প্রকার চাপিয়ে দেওয়া হয়। ফলে তারা এমন এক অপারেশনে নামতে বাধ্য হয়, যা তাদের ডকট্রিন, যুদ্ধ লড়ার কৌশল ইত্যাদির বাইরে ছিল।
গেরাসিমভের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা সন্দেহাতীত, তিনি রুশ বাহিনীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। কিন্তু, এটাকে গেরাসিমভের পরিকল্পনা বলা যায় কিনা– তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
#প্রশ্ন: তাহলে এটা বলা অনুচিত যে, যিনি ব্যর্থতার সূচনা করেছিলেন, আবার তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো?
লি: হ্যাঁ অনেকটা তাই বলতে পারেন। যুদ্ধে এ পর্যন্ত, জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনেককে দায়িত্ব দিয়েছে রাশিয়া। যেমন যুদ্ধের শুরুতে পাঁচজন সিনিয়র কমান্ডার ছিলেন যুদ্ধাভিযানের দায়িত্বে। এরা হলেন, চার সামরিক অঞ্চলের প্রধানেরা এবং রাশিয়ার ছত্রী সেনাদলের প্রধান। এই পাঁচজনকেই পরে অপসারণ করা হয়। এরপর এপ্রিলে কিয়েভ অভিযানের দুই সেনানায়ককে বদলানো হয়।
গেরাসিমভকে দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে আমি মনে করি দুটি কারণ আছে। প্রথমত, রুশ সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এই সংঘাত তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাই যুদ্ধে সর্বাধিনায়কের গুরুদায়িত্বটা খোদ সেনাপ্রধান নিচ্ছেন। এ যুক্তির সত্যতাই বেশি বলে মনে করি, বিশেষত যদি তারা বেলারুশ থেকে আরেকটি আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
তার নিয়োগের পেছনে অন্য ব্যাখ্যাটি হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোনো দ্বন্দ্ব চলছে। যেমন বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, রুশ বাহিনীর কমান্ডাররা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভাজিত। যেমন সুরভিকিনের সাথে ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোঝিনের সম্পর্ক বেশ ভালো বলে জানাচ্ছে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের আরো দাবি, এর বিপরীত শিবিরের হলেন গেরাসিমভ।
অন্য একটি ঘটনার মাধ্যমে এই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক। যেমন গত সপ্তাহে দ্য টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াগনার গ্রুপ দনেয়স্ক অঞ্চলের লবণ খনি-শহর সোলেদার দখল করেছে নাকি করেনি, এনিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবি করেছেন রাশিয়ান মুখপাত্ররা।
সহজভাবে বলা যায়, ওয়াগনার গোষ্ঠীর সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সবার সম্পর্ক সমান না। আর এটা অনেকদিন ধরেই। যেমন সিরিয়া যুদ্ধের সময় রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট জিআরইউ এর সাথে কাজ করেছে ওয়াগনার। যত দিন গেছে এই সম্পর্কে ততোই পরিবর্তন এসেছে। যেমন সিরিয় যুদ্ধে অংশ নেওয়া ওয়াগনারের সাবেক এক যোদ্ধা তার লেখা একটি বইয়ে বলেছেন, সিরিয়ায় সকল সফলতার কৃতিত্ব শুধু ওয়াগনার পাচ্ছে, এনিয়ে দারুণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে তারা এক পর্যায়ে নিম্ন মানের উপকরণ সরবরাহ করতে থাকে ওয়াগনারকে, আবার কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই সহায়তা করেনি।
ইউক্রেনেও কিছুমাত্রায় তা ঘটেছে। রুশ সেনাবাহিনী যখন যুদ্ধের ময়দানে জনবলের অভাব অনুভব করছিল, তখন গুরুত্ব বাড়তে থাকে ওয়াগনার গ্রুপের। রাশিয়াতে কোনো কিছুই পুতিনের অনুমোদন ছাড়া তো হয় না। প্রিগোঝিনও পুতিনেরই ঘনিষ্ঠজন। তাই রুশ সেনারা যখন জনবলহানি পুষিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন বিভিন্ন শহর থেকে সফলভাবে জনশক্তি নিয়োগ করেছে ওয়াগনার। রুশ সেনাবাহিনীর দুর্বল রিজার্ভ ব্যবস্থাও এজন্য দায়ী। এভাবে এপ্রিলে ডনবাসের যুদ্ধে আরো প্রভাব বেড়ে যায় ওয়াগনারের।
এদিকে এই যুদ্ধের মুখপাত্র হিসেবে বারবার হাজির হচ্ছেন প্রিগোঝিন। কখনো জনসম্মুখে বক্তৃতা দিচ্ছেন, কখনো সামরিক পোশাকে নিজেই হাজির হচ্ছেন যুদ্ধাঞ্চলে। বাখমুত ও সোলেদারের যুদ্ধেও কেন্দ্রীয় ভুমিকায় আছে তার ওয়াগনার গ্রুপ। গত কয়েক মাস ধরে এখানেই চলছে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াই।
তবে প্রিগোঝিনের ব্যাপক সমালোচনাও করেছেন একাধিক রুশ জেনারেল। এদের মধ্যে ছিলেন অ্যালেক্সান্ডার লুপিন। প্রিগোঝিনকে কটাক্ষ করার পর তাকে ইউক্রেন যুদ্ধের শীর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে থেকে বাদ দেওয়া হয়। তবে তিনি যা বলেছিলেন, সেটা অনেকেরই মনের কথা। লুপিন বলেছিলেন, প্রিগোঝিন নিজেকে এই যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে জাহির করছেন। হয়তো একারণেই তার ঘনিষ্ঠ সুরভিকিনকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এই ঘটনা আরো ইঙ্গিত দেয়, যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে রুশ বাহিনী ভাড়াটে যোদ্ধার চেয়ে নিজস্ব শক্তি ও সামর্থ্যের যথাসম্ভব কার্যকর ব্যবহারের উদ্যোগ নেবে।
প্রশ্ন: আপনি উল্লেখ করেছেন, ইউক্রেনের বেসামরিক অবকাঠামো ধবংসে রাশিয়া বেশ সফলতা পেয়েছে। এটা করার পেছনে তাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য কী? এটা কি ইউক্রেনীয়দের জীবনমান কেড়ে নিয়ে তাদের মনোবল ভাঙ্গার চেষ্টা? নাকি এর মাধ্যমে কোনো সামরিক লক্ষ্য অর্জনের অভিসন্ধি রয়েছে রাশিয়ার?
লি: আমি মনে করি, এটা যুদ্ধকে আরো ব্যয়বহুল করে তোলার চেষ্টা; ইউক্রেনের জন্য এবং তার সমর্থক পশ্চিমা মিত্রদের জন্যও। যুদ্ধ-কবলিত একটি দেশ হলেও, ইউক্রেনের একটা সচল অর্থনীতি থাকাটা অতি-জরুরি। যুদ্ধের মধ্যেও ইউক্রেনের শহরগুলোয় যেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শহরাঞ্চলে যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও অব্যাহত রাখা দরকার। কিন্তু, বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস করে জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছে রাশিয়া। একইসঙ্গে, ইউক্রেনের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা যাবে না – এমন খাদের তলায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ইউক্রেনকে আর্থিক সহায়তাও তাই এখন বেশি দিতে হবে পশ্চিমাদের। আর এটা তাদের জন্য যেন বোঝা হয়ে ওঠে, সেটাই এখানে রাশিয়ার সামরিক লক্ষ্য।
প্রশ্ন: পশ্চিমা শক্তিগুলো এখন ইউক্রেনে অত্যাধুনিক ট্যাঙ্ক পাঠানোর কথা ভাবছে। এসব ট্যাংক যুদ্ধে কতোটা পরিবর্তন আনতে পারবে?
লি: 'কম্বাইন্ড আর্মস' বলে একটা কৌশল আছে, যেখানে সাঁজোয়া যান, তাদের সমর্থনকারী পদাতিক সেনা ও আর্টিলারি ইত্যাদির সম্মিলিত প্রয়োগ করে সাঁজোয়া অভিযান পরিচালনা করতে হয়। আবার একটি দেশের বিমান শক্তি, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদির সাথেও এর সমন্বয় থাকতে হয়। যদি এই কম্বাইন্ড আর্মস কৌশলের সফল প্রয়োগ হয়, তাহলেই কেবল যুদ্ধে অগ্রগতি করা যাবে। এর একটি অঙ্গ হলো ট্যাংক বা সাঁজোয়া যান। শুধুমাত্রা ট্যাংক দিয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি আশা করা যায় না।
নিঃসন্দেহে ট্যাংক একটি কার্যকর অস্ত্র। ইউক্রেন বর্তমানে যেসব ট্যাংক ব্যবহার করছে, তার চেয়ে পশ্চিমা ট্যাংকগুলো উন্নত এটাও ঠিক। কিন্তু, এই মুহূর্তে ট্যাংকের চেয়েও অন্য ধরনের অস্ত্র সহায়তা বেশি চায় ইউক্রেন। যেমন তারা চাইছে আরো ড্রোন ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। তারা এগুলো পেলে শত্রুর ওপর গুণগত মানে এগিয়ে থাকার সুবিধা লাভ করবে।
তবে আপনি যদি শক্তিশালী অবস্থানে থাকা শত্রুকে হঠাতে আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করতে চান, তাহলে আপনার অনেক ধরনের উপকরণ প্রয়োজন হবে, আর সেসব অস্ত্র যেন একসঙ্গে কাজ করে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ কামানের গোলা মজুত থাকা, যথেষ্ট সংখ্যক সেনাবাহী সাঁজোয়া যান– ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভিহাইক্যাল (এএফভি) দরকার, যাতে সেনাদের শত্রুর পরীক্ষার যতোটা সম্ভব কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
এক কথায় বলা যায়, যুদ্ধের মৌলিক এ দিকগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খুব একটা বদলায়নি। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে, কিন্তু কিছু জিনিস আগের মতোই সমান গুরুত্বের রয়ে গেছে।
ইউক্রেনের জন্য একটি বড় সমস্যা হলো– ন্যাটোভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে তাদের সমরাস্ত্র ও যানবাহন দেওয়া হচ্ছে। এগুলোর যন্ত্রাংশ একটির সঙ্গে অন্যটির মিল খুবই কম। মেরামতে দরকারি লজিস্টিকসও ভিন্ন। ফলে এই জগাখিচুড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করাটা তাদের জন্য এক মাথাব্যথা হয়ে উঠবে। সমস্যা সমাধানে একই ধরনের অস্ত্র ও যানবাহন বেশি সংখ্যায় দেওয়া দরকার। এজন্য জার্মানির লেপার্ড ট্যাংক দেওয়াটা জরুরি। জার্মানির তৈরি এ ট্যাংক বড় সংখ্যায় অনেক ন্যাটোভুক্ত দেশের কাছেই রয়েছে। ফলে সহজের এক ধরনের ট্যাংক দিয়ে ইউক্রেনের সাঁজোয়া বাহিনীকে শক্তিশালী করা যাবে।