সাংবাদিকদের জায়গা নিতে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা!
জার্মানির সর্ববৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা অ্যাক্সেল স্প্রিংগার মিডিয়া গ্রুপ তাদের মালিকানাধীন দুটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি একসময় সাংবাদিকদের জায়গা নিয়ে নিতে পারে বলে কর্মীদের সতর্কও করেছে তারা। খবর দ্য গার্ডিয়ান-এর।
অ্যাক্সেল স্প্রিংগার-এর সিইও মাথিয়াস ডেফনার কর্মীদেরকে দেওয়া এক অভ্যন্তরীণ চিঠিতে বলেন, স্বাধীন সাংবাদিকতাকে সর্বোচ্চ ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়া কিংবা সরাসরি এটিকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির রয়েছে।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানিতে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে এক্সেল স্প্রিংগার। জার্মানিতে তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি সংবাদপত্র বিল্ড ও ডি ওয়েল্ট-এ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়েছে তারা।
প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের সংবাদ প্রকাশনার ক্ষেত্রে কাজে লাগতো এমন অনেক সেবাকেই অপ্রয়োজনীয় করে তুলছে অটোমেশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। সে কারণেই বাধ্য হয়ে কিছু কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে। ঠিক কতজন কর্মী ছাঁটাই করা হবে তা উল্লেখ না করলেও; কোনো প্রতিবেদক, লেখক ও বিশেষ সম্পাদকদের কাউকে ছাঁটাই করা হবে না বলে নিশ্চিত করেছে মিডিয়া জায়ান্টটি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী হইচই ফেলে দিয়েছে ওপেনএআই এর তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির চ্যাটবট 'চ্যাটজিপিটি'। এক্সেল স্প্রিংগার এর সিইও মাথিয়াস বলেন, চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুলগুলো তথ্যের ক্ষেত্রে 'বিপ্লব' ঘটাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এছাড়া, 'তথ্য একত্রিকরণের' ক্ষেত্রেও সাংবাদিকদের চেয়ে এটি ভালোভাবে কাজ করবে বলে মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।
"একটা প্রকাশনা সংস্থার ভবিষ্যতে সফলভাবে টিকে থাকার জন্য এই পরিবর্তনটা বুঝতে পারা অত্যাবশ্যক। যারা সবচেয়ে সেরা অরিজিনাল কন্টেন্ট বানাতে পারবে, তারাই টিকে থাকবে", বলেন মাথিয়াস।
কর্মীদেরকে দেওয়া চিঠিতে মাথিয়াস বলেন, মিডিয়া আউটলেটগুলোকে অবশ্যই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মূল ভাষ্যের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। তাহলেই প্রতিটি ঘটনার পেছনের 'সত্যিকার মোটিভ (উদ্দেশ্য)' বের করার জন্য সাংবাদিকদের কাজ বহাল থাকবে।
তবে নিজেদের কন্টেন্ট তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে এক্সেলই প্রথম প্রকাশনা সংস্থা নয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাজফিড ঘোষণা দিয়েছিল- তারা তাদের কন্টেন্ট এবং অনলাইন কুইজকে 'উন্নত' করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে।
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম ডেইলি মিরর এবং ডেইলি এক্সপ্রেস ইতোমধ্যেই সাংবাদিকতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। চ্যাটজিপিটির মতো মেশিন লার্নিং প্রযুক্তিগুলোর সুবিধা ও সীমাবদ্ধতাগুলো খুঁজে বের করতে তারা একটি ওয়ার্ক গ্রুপ গঠন করেছে বলে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন গ্রুপটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
২০২২ সালের নভেম্বরে লঞ্চ হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারী পেয়েছে চ্যাটজিপিটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির কারণে কিছু কিছু চাকরি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে বলে দীর্ঘদিন যাবত যে অনুমান করা হচ্ছিল, সেই আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে চ্যাটজিপিটি।
চ্যাটবট হলো এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গঠন করা হয়। এটি একটি বড় ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল যাকে অসংখ্য ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়। ফলে কোনো ডিভাইসের মাধ্যমে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মানুষের মতো করে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে; অর্থাৎ ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে পারে।
ওপেনএআই বলছে, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং ফ্রম হিউম্যান ফিডব্যাক নামক একটি মেশিন লার্নিং কৌশল ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটি মডেলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এটি কথোপোকথন শুরু, প্রশ্নের উত্তর প্রদান, ভুল স্বীকার, ভুল অনুমান চ্যালেঞ্জ এবং অযাচিত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে সক্ষম।
অন্যান্য চ্যাটবটের মতোই চ্যাটজিপিটিও দ্রুত সময়ে সাড়া দিতে সক্ষম। শুধু তা-ই নয়, আরও কিছু আকর্ষণীয় ফিচার রয়েছে এটির। রচনা লেখা থেকে শুরু করে গানের লিরিক্স লেখা, গল্প লেখা, এমনকি কবিতা লিখতেও নির্দেশ দেওয়া যাবে এই চ্যাটবটকে। আর মার্কেটিং পিচ, স্ক্রিপ্ট, অভিযোগ পত্র লেখা তো আছেই!
কিন্তু চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে যেসব কাজ বা লেখালেখি করা হচ্ছে, সেগুলোর নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাবিদরা চ্যাটজিপিটির কাজের মধ্যে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে রেফারেন্স নকল করা এবং নকল উদ্ধৃতি উল্লেখ করার উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। টেক ওয়েবসাইট সিনেট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল ব্যবহার করে বিভিন্ন আর্টিকেল তৈরি করছে এবং প্রকাশের আগে সত্যিকার সম্পাদকদের দিয়ে তা পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছে বলে জানা গিয়েছিল। গত জানুয়ারিতে টেক নিউজ সাইট ফিউচারিজম জানায়- এআই টুলস দিয়ে লেখা অর্ধেকরও বেশি আর্টিকেলে ভুল থাকার কারণে সেগুলো আবার সম্পাদনা করতে হচ্ছে। এরপরে ওয়েবসাইটটি স্বীকার করে যে, এ প্রোগ্রামের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।