দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেভাবে বিশ্বব্যাপী রমজান উদযাপনকে ব্যাহত করবে
চলতি সপ্তাহ থেকেই শুরু হচ্ছে বিশ্বের কোটি কোটি ইসলাম ধর্মালম্বীদের সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। জিনিষপত্রের দামে চড়া আঁচ এবছর রমজানে সইতে হবে তাদের। আল জাজিরা অবলম্বনে
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে, সঙ্গে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বমুখী বিনিময় দর – পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটিয়েছে। অথচ, জীবিকা ও কর্মসংস্থানে করোনা মহামারির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি অনেক দেশেই। তার সঙ্গে বিরুপ জলবায়ুর প্রভাব যোগ হয়ে জীবনযাত্রাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। বিশ্ব অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
বৈশ্বিক দক্ষিণে অবস্থিত অধিকাংশ উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশ। এখানে, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকায় বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান বসবাস করেন। দ্রব্যমূল্যের চড়া দাম এবং অত্যাবশ্যক পণ্যের ঘাটতিতে সবচেয়ে প্রভাবিত জনসংখ্যার মধ্যে তারাও রয়েছেন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-র হিসাবমতে, ২০২২ সালে ৭৯টি দেশের প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিল। এরমধ্যে ১৪ কোটির বেশি মানুষের খাদ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়। ২০২৩ সালেও এই সংখ্যা কমবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে সবচেয়ে বেশি অপুষ্টির শিকার জনগোষ্ঠী রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকায়।
ডব্লিউএফপি-র একজন অর্থনীতিবিদ ফ্রেডরিক গ্রেব বলেন, খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে পরিবারগুলো অন্যান্য পণ্য ও সেবার পেছনে খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি বলেন, 'দরিদ্রদের ৫০ শতাংশের বেশি আয় চলে যাবে খাদ্য কিনতে'।
রমজানে খাদ্য নিয়ে লৌকিকতা আর নানান আয়োজন থাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের। সারাদিনের রোজা রাখার পর ইফতারের টেবিলে নানান রকম ফলমূল, খেজুর, মিষ্টি পানীয়, শরবত ইত্যাদি তো ঐতিহ্য দেশে দেশে। থাকে খাদ্য ছাড়াও বিভিন্ন পণ্য কেনাকাটা, এবং সেসব ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা। কিন্তু, খাদ্যপণ্যের যে চড়া দাম- তাতে এবছরের রমজানে অসম্পন্ন মানুষের ঘরে সুস্বাদু খাবারের আয়োজন শিকেয় উঠবে বলেই অনুমান করা হচ্ছে। সীমিত হবে বিবিধ পণ্যের ব্যবসা। দামি হয়ে ওঠা খাদ্যের বদলে তাদের কী বিকল্প নিম্ন-মানের খাবারই গ্রহণ করতে হবে? আরো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রমজানে এর সামাজিক প্রভাব কতোটা ব্যাপক হবে? এক্ষেত্রে দাতব্যগুলোই বা কতোটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে?
এর সরল অথচ সংক্ষিপ্ততম উত্তর হলো: উচ্চ দামের কষাঘাত দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে রমজানে খাদ্য নিয়ে আয়োজন সীমিতই করতে হবে বহু মানুষকে, এর প্রভাব পড়বে তাদের দৈনন্দিন খাবার কেনা থেকে শুরু করে প্রিয়জনের জন্য ঈদের উপহার কেনার ক্ষেত্রেও। বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা, সামাজিক নেতা এবং মুসলিম পরিবারগুলো এমন অভিমতই ব্যক্ত করেছে। সহায়তার চাহিদাও বাড়ছে মানুষের, যা পূরণে ত্রাণ সংগঠনগুলোর হিমশিম খাবার জোগাড়।
মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা কী?
উপসাগরীয় দেশগুলোর কথা বাদ দিলে, বাকী মধ্যপ্রাচ্যে সুহালে নেই জনতা। ক্ষরা, দুর্ভিক্ষ ও দীর্ঘদিনের সংঘাত এই অঞ্চলের বিভিন্ন অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে গেছে। যেমন বর্তমানে ৯০ শতাংশ সিরিয় নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছেন। ১২ বছরের গৃহযুদ্ধ দেশটির এই করুণ পরিণতি করেছে।
সিরিয়ার যেন দুর্ভাগ্যের অন্ত নেই। গত ফেব্রুয়ারিতে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মারাত্মক এক ভুমিকম্প আঘাত হানে। এতে অন্তত ৫০ হাজার জন নিহত হন। এতে করে, সিরিয়দের জীবনধারণের সংকট আরো নাজুক রূপ নেবে। তুরস্কেও নিত্যপণ্য কেনাকাটা করাটা দিন দিন আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত মাসে দেশটিতে ৫৫ শতাংশের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়।
ভুমধ্যসাগরের অপর পাড়ে মূল্যস্ফীতি রুদ্ধশ্বাস মিশরেও। ফেব্রুয়ারিতে যে হার ছিল ৩২ শতাংশ। দরিদ্রদের ওপর মূল্যস্ফীতির কষাঘাত কমাতে সরকার 'রমজানের মূল্যছাড়ের বাজার' চালু করেছে। এখানে আটা,মাংস ইত্যাদি মৌলিক খাদ্য উপকরণ বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়। অবস্থা এতটাই অবনতিশীল যে রমজানের মাস তিনেক আগেই জানুয়ারিতে এ বাজার চালু করা হয়।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি তারপরও চড়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনবহুল দেশটিতে, গত মাসে যার হার ছিল ৬১.৮ শতাংশ। গ্রেব বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার একবার ১৫ শতাংশ ছাড়ালেই "মানুষের বাসস্থান, স্যানিটেশন ও পরিবহনের মতো অন্যান্য জীবনধারণের মৌলিক ব্যয়গুলোতে তার প্রভাব পড়ে।" মিশরে অবস্থা কতোটা শোচনীয়, তারই প্রমাণ দিচ্ছে রমজানের বিশেষ লন্ঠন বিক্রিতে মন্দা। রমজানের ঐতিহ্যবাহী এই পণ্যের বিক্রিতে এমন দশা আগে দেখা যায়নি।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে জীবনযাপনের ব্যয় নিয়ে সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম হয়তো লেবাননবাসীকেই করতে হচ্ছে। এই দৈন্যের ছাপ বিশেষত রমজানে আরো স্পষ্ট করে চোখে পড়বে – বাসাবাড়ির নৈশ আহার থেকে শুরু করে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে।
স্থানীয় জনসংখ্যার মাথাপিছু হারে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে লেবানন। তার ওপর গত চার বছর ধরেই গভীরতর এক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটে রয়েছে দেশটি। লেবানিজদের প্রাণ ওষ্ঠাগত নজিরবিহীন তিন অঙ্কের মূল্যস্ফীতির চাপে, জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১২৩ শতাংশ।
ঐতিহ্য অনুসারে, নানান সুস্বাদু পদের মাধ্যমে ইফতারের সময়েই নৈশভোজ সারেন লেবাননবাসী; এবারের রমজানে তাদের ৮০ শতাংশই এই রীতি পালন করতে পারবেন না বলে জানাচ্ছে দেশটিতে কাজ করা অন্যতম একটি দাতব্য সংস্থা আমেরিকান নিয়ার ইস্ট রিফিউজি এইড (আনেরা)।
২০১৯ সালের শেষদিক থেকে মার্কিন ডলারের বিপরীতে লেবানিজ পাউন্ড ৯৮ শতাংশ বিনিময় মান হারিয়েছে। এমনকী 'ফাত্তুশ' নামক অতি-সাধারণ সালাদের পদ পরিবেশনপ্রতি ৪,২৫০ পাউন্ড থেকে চলতি বছরেই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,২৫,০০০ পাউন্ডে!
আনেরার প্রেসিডেন্ট শিন ক্যারোল আল জাজিরাকে বলেন, "আপনি যদি ডলারে দাম দেন, তাহলে দেখবেন দাম তেমন বাড়েনি; কিন্তু লেবানিজ পাউন্ডে দিলে আঁতকে উঠবেন। এভাবে লেবানিজদের ক্রয়ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।"
২০১৯ সালে মাত্র ৫০ ডলার দিয়েই অভাবী পরিবারগুলোর জন্য সারা মাসের মৌলিক খাদ্যপণ্যের পার্সেল কিনে দিতে পারতো আনেরা। কিন্তু, এখন একই সেবা দিতে তাদের দুই-তিনগুণ বেশি ডলার ব্যয় করতে হয়।
চলতি বছর প্রায় ১৫ লাখ লেবানিজ নাগরিক এবং সেদেশে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখ সিরিয় শরণার্থীও (মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ) খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিম (ডব্লিউএফপি)।
অলাভজনক সহায়তা সংস্থা কেয়ার- এর লেবানন শাখার মুখপাত্র প্যাট্রিসিয়া খোদের বলেন, খাদ্য সংগ্রহের ধরন বদলে মানুষ মানিয়ে চলার চেষ্টা করছে। "তারা এখন দিনশেষে মুদিবাজারে যায়, যাতে উচ্ছিষ্ট ধরনের পণ্য কিনতে পারে। এসব মানুষ যখন খাদ্য সহায়তার পার্সেল পায় না, তখন প্রতিবেশীদের থেকে খাবার ধার করে।"
ইফতারের জন্য লেবাননের বিখ্যাত পদ মশলাযুক্ত লেবানিজ কোফতা, কালাম নামের পেস্ট্রি পণ্য এবং কাঠবাদাম ও পাইন নাট মেশানো খেজুরের জুস। কিন্তু, এগুলো কেনার সাধ্য এখন দেশটির বেশিরভাগ পরিবারেরই নেই।
কেউ স্রেফ রুটি খেয়ে দিন গুজরান করছে, যা পাওয়াও সৌভাগ্য। কারণ এক পিস রুটির দাম ২০১৮ সালে ১,৫০০ লেবানিজ পাউন্ড থাকলেও তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৯ হাজার পাউন্ডে। খোদের বলেন, "তারা রুটির ওপর কোনোরকম মশলা ছড়িয়ে বা কলা দিয়ে খাচ্ছেন, কারণ কলা বর্তমানে সবচেয়ে স্বস্তা ফল।"
খাদ্য যখন অপর্যাপ্ত, জ্বালানিতেও নেই সরকারের ভর্তুকি তখন ঈদুল ফিতর মলিনই হবে; রমজানে পরিবার ও বন্ধুস্বজনদের নিয়ে পানাহারের আয়োজনটাও হয়তো সীমিত হবে। শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়েই চলবে ইফতার পর্ব।
খোদের বলেন, ইচ্ছে থাকলেও- "মানুষের হাতে টাকা নেই, তারা নিরুপায়।"
এশিয়ার হালচাল: 'আমার আয় যথেষ্ট নয়'
একই রুঢ় বাস্তবতায় দিন কাটাচ্ছেন পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদবাসী ইলেকট্রিশিয়ান বোরহান। অন্য পদবির বালাই নেই তার। এই নামেই তাকে সবাই চেনে।
পাকিস্তানেও মূল্যস্ফীতি লাগামহীন। উচ্চ মূল্যস্ফীতি হারে পিষ্ট হচ্ছে ২০ কোটি জনসংখ্যা। গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি হার ছিল অর্ধ-শতকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিদেশি দেনার বিপুল ভার পাকিস্তানের ওপর, যা মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রাও নেই। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রটি তারমধ্যেই গত বছর ভয়াল এক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বানের পানিতে লাখ লাখ একর আবাদি জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, স্থানীয় উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরো চরমে উঠেছে খাদ্য সংকট। মুদ্রা সংকটের কারণে আমদানি বাড়িয়ে চাহিদা পূরণের উপায়ও বন্ধ সরকারের।
বোরহান দেশটির কোটি কোটি খেটে খাওয়া সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরই প্রতিনিধি। তবুও তিনি স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে দিনে অন্তত একবেলা খাবার জোগাতে পারছেন। অন্য অনেকেরই অনাহারে দিন কাটছে।
৪৫ বছরের বোরহান আল-জাজিরাকে বলেন, "গত কয়েক মাসে মূল্যস্ফীতি এতোটা বেড়েছে যে বাড়িভাড়া ও বিদ্যুৎ, পানি ইত্যাদি ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতেই আমার প্রাণান্তকর দশা। পরিবারের ভরণপোষণে আমার আয় আর যথেষ্ট নয়।"
এরমধ্যেই রমজান চলে আসায় আরো হতাশ শোনায় বুরহানের কন্ঠস্বর। পরিবারের জন্য ভালোমন্দ খাবার হয়তো কিনতে পারবেন না, সরকারের ভর্তুকিমূল্যে বিক্রি করা আটার ওপরই নির্ভরশীল তিনি।
"কিন্তু, এই আটাও দামি হয়ে উঠেছে। আগে ৬০০ রুপিতে যে ২০ কেজির আটার বস্তা কিনতাম, এখন তার দাম ১,১০০ রুপি' - বোরহান বলছিলেন।
আবাসন ও নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ওপর নির্ভর করে বোরহানের রুজিরোজগার। সার্বিক অর্থনীতির যে মন্দা তার প্রভাব পড়েছে এ খাতেও। নতুন প্রকল্প হচ্ছে না সেভাবে, কাজ জোগাড় করাই আরেক সংগ্রাম। অভাবের তাড়নায় বিক্রি করেছেন একমাত্র মোটরকারটি। ভালো মানের বেসরকারি স্কুল থেকে তিন সন্তানকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করিয়েছেন কম বেতনের সরকারি স্কুলে।
রমজান শেষেই ঈদ। বাচ্চাদের অনেক আশা থাকে বছরের এই দিনটাকে নিয়ে। কীভাবে তাদের মুখে সামান্য হাসিটুকু ফোটাবেন- জানেন না বোরহান। বলেন, "প্রতি সন্ধ্যায় সবাই মিলে কিছু খেতে পারলেই আমি সন্তুষ্ট থাকব। এবার আমার কোনো সন্তানের জন্যেই নতুন কাপড় হয়তো কেনা হবে না।"
রমজানে বছরের অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি খরচ করেন পাকিস্তানীরা, তাই এসময়ে মূল্যস্ফীতি আরো বাজে রূপ নেওয়ার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
ইসলামাবাদ-নিবাসী একজন অর্থনীতিবিদ সাকিব শেরানি বলেন, সরকারি তথ্য অনুসারেই গত এক বছরে পাকিস্তানীদের ক্রয় ক্ষমতা ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে। কিন্তু, নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে প্রকৃত চিত্রটি আরো নাজুক।
ইসলামাবাদ-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট পলিসি ইনস্টিটিউট- এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাজিদ আমিন বলেন, দেশজুড়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও এই সংকট মোকাবিলার যথাযথ উদ্যোগ নিতে পারছে না সরকার।
দৃশ্যপট তুলে ধরে তিনি বলেন, "আগে দেশে যা হয়েছে তাকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বলা যায়, এখন সেটা গোলযোগের রূপ নিয়েছে। ফলে সরকার খাদ্যপণ্যের দামও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না।"
এশিয়ার অন্যান্য প্রান্তেও তীব্রতর এই সংগ্রাম।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া। নতুন এক জরিপ গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটির ৭০ শতাংশ জেড প্রজন্মের (যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে) ভোক্তারা গতবছরের একই সময়ের তুলনায় এবারের রমজানে নিজেদের জন্য কম কেনাকাটার কথা ভাবছে। তাদের এক-তৃতীয়াংশ জানিয়েছে, তারা এই মাসে কোথাও বেড়াতে যাবেন না। ৪৩ শতাংশ উপহার কেনার পেছনে ব্যয় কমাবেন বলেও জানান।
ইন্দোনেশিয়ার হাল পাকিস্তানের মতো নয়, মূল্যস্ফীতিও অনেক কম বা মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ। তারপরও এটা দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। রমজানের আগে দেশটিতে খাদ্য ও পানীয়ের দামও তড়তড়িয়ে বেড়েছে।
চলতি বছরের রমজানে বিস্কুট, পাউরুটি ও তেলের মতো নিত্যপণ্যের চাহিদা – গত বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কমবে বলে এ মাসের শুরুতেই এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের নিচে থাকলেও– কয়েক দশকের মধ্যে দ্রব্যমূল্যে এমন আঘাত আর আসেনি। জীবনযাপনে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের। বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাদের ঈদ উদযাপন দূরে থাক, আগে টিকে থাকার চিন্তাই করতে হচ্ছে। কারণ, রমজান মাসে তাদের জন্য খাদ্য বাজেট কমানোর ঘোষণা দিয়েছে ডব্লিউএফপি।
আফ্রিকা:
কেনিয়ার ১৭ শতাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন। তবু রমজান ও ঈদ ঘিরে সাধ্যের মধ্যেই উদযাপনের চেষ্টা থাকে। এবছর অবশ্য ভিন্ন এক রমজান মাসের প্রস্তুতি নিচ্ছেন শেখ জুমা নগাও। কারণ, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি কেনিয়ানদের শান্তি কেড়ে নিয়েছে।
সামাজিক একটি প্রতিষ্ঠান– কেনিয়ান মুসলিম ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নগাও বলেন, "জিনিসপত্রের দাম এতো বেশি যে বেশিরভাগ কেনিয়ান দিনে তিন বেলা খেতে পারে না।"
দেশটিতে এনিয়ে বিক্ষোভও হচ্ছে ব্যাপক। গত সোমবার রাজধানী নাইরোবিসহ বেশ কয়েকটি শহরে জীবনযাপনের উচ্চ আয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে জনতা। এনিয়ে রাজনৈতিক সহিংসতাও হয়েছে।
তার ওপর খরার প্রকোপে ভুগছে কেনিয়া। গত বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত দেশটির ৫৪ লাখ মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানির অভাবে ছিল। গম দিয়ে তৈরি এক ধরনের খাদ্য উগালি দেশটিতে প্রধান খাদ্য। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য আমদানি ব্যাহত হওয়ার দরুণ যার দাম অনেকটাই বেড়ে গেছে।
শুধু কেনিয়া নয়, কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের সরবরাহের ওপর আফ্রিকান অনেক দেশই নির্ভরশীল। জাতিসংঘের হিসাবমতে, গত বছরে যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে এসব দেশের ৪০ শতাংশ গম আমদানির উৎস ছিল।
কেনিয়ার অর্থনীতি এখন মন্দা দশায়, নগোও আশঙ্কা করছেন, এবছর অবস্থাসম্পন্ন মুসলমানদের যাকাত দানেও তার প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, "এবছর মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়তো যাকাত দিতে পারবে না।" দুঃসংবাদ এখানেই শেষ নয়। নগোও আরো বলেন, "সাধারণত আমরা পরিবারের সদস্যসহ সবাইকে দাওয়াত দেই, মন্দ অর্থনীতি এই প্রথাকেও ঝুঁকিতে ফেলেছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, অন্তত এই প্রথাটা যেন টিকে থাকে।"