উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বাড়ছে রাশিয়ার সমর্থন, হতাশ পশ্চিমারা
জোর প্রচার-প্রচারণা এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার সুবাদে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাড়ছে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রেমলিনের ধারাভাষ্য মোকাবিলায় পশ্চিমা শক্তিগুলোর ব্যর্থতাও এর অন্যতম কারণ।
চলতি মাসে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পর গত এক বছরে রাশিয়ার পক্ষে সার্বিকভাবে সমর্থন বেড়েছে, কারণ আগে ভূরাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতো এমন অনেক দেশের সাথেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে মস্কো। দেশগুলোর সরকারের প্রতি ক্রেমলিন দিয়েছে সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার বার্তা।
আলোচিত সময়ের মধ্যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জাতিসংঘে ভোটাভুটির ধরন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, আনুষ্ঠানিক বিবৃতিসহ রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্কের পর্যালোচনা করেছে ইআইইউ। এর ভিত্তিতে তাদের পর্যবেক্ষণে জানিয়েছে, আগের বছরে রাশিয়াপন্থী দেশের সংখ্যা ২৯টি হলেও এখন তা ৩৫টিতে উন্নীত হয়েছে।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, "এই ক্যাটাগরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হলো চীন, কিন্তু অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও (বিশেষত দক্ষিণ আফ্রিকা, মালি ও বার্কিনো ফাসো) এই দলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এসব দেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ রয়েছে।" এই পরিস্থিতি, আফ্রিকা মহাদেশে রাশিয়ার প্রতিপত্তি বৃদ্ধির ঘটনাও নির্দেশ করছে।
চলতি মাসের শুরুর দিকে মস্কো গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠক করেছেন বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতির দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। দুই নেতা অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীরতর করার অঙ্গীকার করেছেন।
অন্যদিকে, রাশিয়া ও চীনের সাথে গত ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক মহড়ায় অংশ নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি পানডোর বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর কারণে তার দেশের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। তিনি মস্কোর সাথে 'ক্রমবর্ধমান দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের' প্রশংসা করেন।
গত এক বছরে অবশ্য নিরপেক্ষ দেশের সংখ্যাও বেড়েছে। এসময়ে যা ৩২ থেকে ৩৫টিতে উন্নীত হয়েছে বলে জানিয়েছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ); এসব দেশে বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ বসবাস করে।
পশ্চিমা দুনিয়া ও রাশিয়া উভয় পক্ষ থেকেই অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্যই নিরপেক্ষ দেশের সংখ্যা বেড়েছে। পশ্চিমাদের জন্য এখানেও দুঃসংবাদ। কারণ, তুরস্ক, কলম্বিয়া ও কাতারের মতো যুদ্ধের আগে পশ্চিমাঘেঁষা বলে পরিচিত ছিল এমন অনেক দেশই এখন নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।
"তবে রাশিয়া ও চীন উভয়ে মিলে কোনোরকম জোটের বাইরে থাকা ও নিরপেক্ষ দেশগুলোকে নিজেদের পক্ষে আনার যৌথ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে" বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সে তুলনায়, রাশিয়ার সমালোচনা করা দেশের সংখ্যা ১৩১ থেকে কমে ১২২টিতে নেমে এসেছে। এর বাইরে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন দেশগুলোকে বলা হচ্ছে 'পশ্চিমাপন্থী; বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ এসব দেশে বসবাস করছে। রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন প্রকার নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে পশ্চিমাপন্থী দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সমন্বয় রয়েছে। তারা ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দানেও নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা রাখছে।
এই ব্লকের সবচেয়ে বড় সুবিধা তাদের অর্থনৈতিক অগ্রসরতা। মোট বৈশ্বিক পণ্য ও সেবা উৎপাদনের (জিডিপি) ৬৮ শতাংশই তাদের। অর্থাৎ, অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর দেশগুলো রুশ-বিরোধী অবস্থানে নেই। সম্পদশালী পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোর সাথে বৈশ্বিক দক্ষিণের ব্যবধান যে দিন দিন বাড়ছে, এ ঘটনা সেদিকেও নির্দেশ করে।
ইআইইউ- এর গ্লোবাল ফোরকাস্টিং ডিরেক্টর আগাথে ডেমারাইস মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, "উন্নয়নশীল বিশ্বে রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা খুবই কার্যকরভাবে কাজ করছে। এসব প্রচারণা উপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জমা অসন্তোষকে উস্কে দিচ্ছে। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণেই, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে এমন ধারণাকেও বদ্ধমূল করতে ভূমিকা রাখছে মস্কো।"
ডেমারাইস উল্লেখ করেন যে, বৈশ্বিক দক্ষিণ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর রয়েছে পশ্চিমাদের হাতে সামরিক আগ্রাসন ও উপনিবেশিক শোষণের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা। ফলে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালিয়ে রাশিয়া 'গর্হিত অপরাধ' করেছে বলে পশ্চিমারা যে দাবি করছে, তাতে এসব দেশের সিংহভাগ মানুষ বিশ্বাস করে না। বরং রাশিয়ার সমালোচনা করাকে তারা পশ্চিমাদের দ্বিচারীতা মনে করে। আর বিশ্ববাসীর নজর ইউক্রেন থেকে অন্যদিকে সরাতে রাশিয়া ঠিক এমনটাই চেয়েছিল।
ডেমারাইস বলেন, উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকে মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে রাশিয়া একটি 'আকর্ষণীয়' দেশ – এমন ধারণাও 'অবাস্তব'। এভাবে তারা রাশিয়ার সক্ষমতাকে এবং তৃতীয় বিশ্বের কাছে উদ্ধারকর্তা হিসেবে তার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার শক্তিকে অবমূল্যায়ন করছেন।
বাস্তবতা হলো, রাশিয়া আর চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক অংশীদারত্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে পশ্চিমাদের বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মস্কো ও বেইজিং গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নিয়ে কোনো শর্তও জুড়ে দেয় না।
তিনি বলেন, "অন্যরা আমাদের মতো করে ভাবে না, এই সহজ সত্যটি স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়ে আমাদের ঘাটতি আছে; আর সেটাই উদ্বেগজনক।"
"পশ্চিমা নেতারা মনে করেন, আমরা ইতিহাসের সঠিক পক্ষেই আছি, সেটা হয়তো ঠিকই (ইউক্রেনের ক্ষেত্রে); কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।"
ডেমারাইস মনে করেন, সুসংগঠিত রাশিয়ান প্রচারণাকে মোকাবিলা করতে হলে প্রথমে নিজেদের ভুলত্রুটিকে স্বীকার করে নিতে হবে পশ্চিমাদের। এবং নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য ও কার্যকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।
"আমি মনে করি, (উন্নয়নশীল দেশে) নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে এবং সেগুলো কীভাবে কাজ করে – সে বিষয়ে জ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। রাশিয়া এটাকে তার নিজের সুবিধেমতো ব্যবহার করতে পারছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে দীর্ঘমেয়াদে। রাতারাতি এর কোনো জাদুকরি সমাধান আশা করা যায় না। সার্বিক চিত্রটা (পশ্চিমাদের জন্য) সুখকর নয়।"