পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে আরও যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন
আজ মঙ্গলবার (৯ মে) দুটি মামলার শুনানিতে উপস্থিত থাকতে ইসলামাবাদ হাইকোর্টে এসেছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও দেশটির প্রধান বিরোধী দল তেহরিক -ই- পাকিস্তানের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান। কিন্তু, আদালতের চত্বর থেকেই তাকে আটক করেছে দেশটির আধা-সামরিক বাহিনী রেঞ্জার্স। খবর দ্য ডনের।
তবে পাকিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাস আছে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে।
দেশটির শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম দ্য ডনের প্রতিবেদন সূত্রে এসব ঘটনাক্রম তুলে ধরা হলো টিবিএসের পাঠকদের জন্য।
১৯৬০ এর দশক:
পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী (সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এসময়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আইয়ুব খান। নির্বাচিত সরকার বাতিল অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে তাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরে ১৯৬০ সালে এই অধ্যাদেশ লঙ্ঘনের দায়ে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬২ সালে 'রাষ্ট্র-বিরোধী কর্মকাণ্ডে' জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে করাচির কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্যান্য বন্দিদের থেকে পৃথক করে বিশেষ সেলে রাখা হয়।
১৯৭০ এর দশক:
১৯৭৩ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ক্ষমতায় থাকার সময় (১৯৭৪ সালে) তিনি একজন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন এই অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও এই গ্রেপ্তারের কোনো আইনি-ভিত্তি নেই এমন রায় দিয়ে পরে তাকে মুক্তি দেন লাহোর হাইকোর্ট। কিন্তু এর তিন দিন পর সামরিক আইনের ১২ ধারায় আওতায় তাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়।
এই ধারার অধীনে সামরিক আইন বাধাহীনভাবে চলার পক্ষে কোনো ব্যক্তি হুমকিস্বরূপ হলে তাকে গ্রেপ্তারের অধিকার দেওয়া হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। এই আইনের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে আপিলের সুযোগও ছিল না।
এরপর ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল তা কার্যকর করা হয়।
১৯৮০ এর দশক:
আগস্ট ১৯৮৫: দুই মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেনজির ভুট্টো। প্রথমবার ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের আগস্ট পর্যন্ত; এবং দ্বিতীয়বার ১৯৯৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসক জিয়াউল হকের আমলে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালের আগস্টে তার ভাইয়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে দেশে ফিরলে তাকে ৯০ দিনের জন্য গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
আগস্ট ১৯৮৬: করাচিতে স্বাধীনতা দিবসের এক র্যালিতে সরকারের বৈধতা অস্বীকার করায় দ্বিতীয়বারের মতো বেনজিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৯০ এর দশক:
মে ১৯৯৮: বেনজির ভুট্টোর বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন লাহোর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
জুন ১৯৯৮: সরকারি হিসাবরক্ষণ কমিটিও বেনজিরের বিরুদ্ধে একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
জুলাই ১৯৯৮: লাহোর হাইকোর্টের বেঞ্চ তার বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
এপ্রিল ১৯৯৯: প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কাস্টমস জালিয়াতি ঠেকাতে একটি সুইস কোম্পানিকে নিয়োগ করেছিল বেনজিরের সরকার। ওই কোম্পানির থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে লাহোর হাইকোর্টের বেঞ্চ তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন এবং সরকারি পদে দায়িত্ব পালনের অযোগ্য ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণাকালে দেশে ছিলেন না বেনজির। পরবর্তীতে উচ্চ আদালত এই রায় ও দণ্ডকে বাতিল করেন।
অক্টোবর ১৯৯৯: সম্পত্তি-সম্পর্কিত এক মামলায় আদালতে হাজিরা না দেওয়ায় বেনজিনের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পুনরায় জারি করেন লাহোর হাইকোর্ট।
২০০০ এর দশক:
সেপ্টেম্বর ২০০৭: ১৯৯৯ সালে এক সামরিক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের এক সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত হন নওয়াজ শরীফ। এরপর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফিরে আসেন স্বদেশে। তাকে বহনকারী বিমানটি ইসলামাবাদে অবতরণ করা মাত্রই, বিমানবন্দর সিল করে দেয় নিরাপত্তা বাহিনী। এর কয়েক ঘণ্টা পরই তাকে আটক করে সৌদি আরবের জেদ্দায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
নভেম্বর ২০০৭ সাল: জেনারেল পারভেজ মোশাররফের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লং মার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন বেনজির। এই কর্মসূচিতে তার অংশ নেওয়া ঠেকাতে তাকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সিনেটর লতিফ খোশা-র বাড়িতে এক সপ্তাহ গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
২০১০ এর দশক:
জুলাই ২০১৮: পাকিস্তানের দুর্নীতি-দমন সংস্থা ন্যাশনাল একাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (ন্যাব) দুর্নীতির অভিযোগে নওয়াজ শরীফ ও তার কন্যা মরিয়মকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে দুই মাস পরেই এই দণ্ড স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ডিসেম্বর ২০১৮: সৌদি আরবে পারিবারিক মালিকানাধীন একটি ইস্পাত কারখানা থাকার ঘটনায় নওয়াজকে আবারো গ্রেপ্তার করা হয় এবং সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে চিকিৎসার জন্য তাকে দেশত্যাগের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর তিনি আর পাকিস্তানে ফেরেননি।
জুলাই ২০১৯: পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) দলের শহীদ খাকান আব্বাসী ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই তাকে দুর্নীতির অভিযোগে আটক করে ন্যাব। এরপর জামিন মঞ্জুর হওয়ায় ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তাকে আদিয়ালা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
২০২০ এর দশক:
ন্যাবের দায়েরকৃত এক অর্থপাচার মামলায় লাহোর হাইকোর্ট জামিন আবেদন নামঞ্জুর করলে ২৮ সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হন পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ। এর প্রায় সাত মাস পর লাহোরের কোট লাখপত কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।
মার্চ ২০২৩: একজন বিচারককে হুমকি প্রদান এবং তোষাখানা মামলায়– পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেপ্তার ঠেকাতে ইমরানের বাসভবনের বাইরে অবস্থান নেন দলীয় নেতাকর্মীরা। এসময় তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
মে ২০২৩: আজ ৯ মে আল-কাদির ইউনিভার্সিটি ট্রাস্ট মামলায় ইসলামাবাদ হাইকোর্টের চত্বর থেকে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।