তুরস্কের রাজনীতিতে এরদোয়ানের ২০ বছরের আধিপত্য কি আরও দীর্ঘ হচ্ছে?
আজ তুরস্কে ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। রজব তৈয়ব এরদোয়ানের শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হচ্ছে।
বিগত দুই দশক ধরে তুর্কি রাজনীতিকে আধিপত্য বিস্তার করে রয়েছেন রজব তৈয়ব এরদোয়ান। এবারে আরও পাঁচ বছরের জন্য নিজ শাসনকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে নেমেছেন নির্বাচনে।
এরদোয়ান তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট এবং সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবারের নির্বাচনকে সবচেয়ে কঠিন বলেই মনে করা হচ্ছে। এরইমধ্যে তিনি ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনদফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
৬৯ বছর বয়সী এরদোয়ান রক্ষণশীল রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তুরস্কের নীতি নিয়ে বিতর্ক উস্কে দেওয়ার খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯২০ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী নীতিমালাকে প্রতিষ্ঠা করেন।
ক্ষমতায় থাকার ক্ষেত্রে কামালের ১৫ বছরের রেকর্ডকে পাঁচ বছর আগেই অতিক্রম করেন এরদোয়ান। ২০১৪ সালে ভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে নিজ জনপ্রিয়তার বিজয় ধ্বজা তুলে ধরেন তিনি। তিনি একটি গণভোটেও বিজয় অর্জন করেন আর এ গণভোটের মধ্য দিয়ে তুরস্কের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।
জীবনযাত্রার ব্যয় দুঃসহ হয়ে উঠছে
তুরস্কের অর্থনীতি ধারাবাহিক অন্তহীন মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবন যাত্রার ব্যয়ভারে দুঃসহ হয়ে উঠছে। নিত্য-পণ্যের বাড়তি দামে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ। আর এমন ঘোরতর পরিস্থিতির মধ্যে রোববার নির্বাচন হতে চলেছে দেশটিতে।
তুরস্কের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের গত ফেব্রুয়ারির প্রলয়ঙ্করী ভূ-কম্পনের জের টানতে হয়েছে এরদোয়ানকেও। তার ওপর সৃষ্টি হয়েছে বাড়তি চাপ। ভূ-কম্পন উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলায় এরদোয়ান সরকারের ভূমিকাকে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করছে দেশটির মানুষ। ভবন নির্মাণের নীতিমালা বাস্তবায়নে তুর্কি সরকারের নিদারুণ ব্যর্থতার প্রসঙ্গে টেনে আনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের অকালে জীবন নাশের ঘটনায় এই ব্যর্থতার ভূমিকা রয়েছে।
ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিরোধীদের শক্তিশালী ঘাটি হিসেবে পরিচিতি ঐতিহাসিক নগরী আঙ্কারার ২৯ বছর বয়সী বাসিন্দা ফোরকান ওজবিলজিন আল জাজিরাকে বলেন, "এরদোয়ানকে এবারে যেতে হবে। এক ব্যক্তির এ শাসনের ফলেই দেশটিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।"
তার শাসনের কারণেই ঠিকাদাররা অমন ঠুনকো ভবন তৈরি করে পার পেয়েছে এবং এ সব ভবন ধসে হাজার হাজার মানুষ অকালে প্রাণ হারিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
তবে প্রেসিডেন্টের এরদোয়ানের বিপুল সংখ্যক সমর্থক রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এরদোয়ান যে সব সাফল্য অর্জন করেন তারা তা তুলে ধরেন। তুরস্কের চলমান সমস্যা মোকাবেলায় একমাত্র তিনিই যোগ্য ব্যক্তিত্ব বলেও ভাবছেন তারা।
ঐতিহাসিক ইস্তাম্বুল নগরীর রক্ষণশীল ফাতিহ্ অঞ্চলের দোকানি আহমেদ গোককাইয়া বলেন, "গত ২০ বছরে ভালো সময়ের মতো মন্দ সময়ও গেছে। আমাদের প্রেসিডেন্টকে ভূ-কম্পন জনিত বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করা যায় না। তুরস্কের প্রতিটি ভবন কী একাই তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন? তিনি দেশটির জন্য কি করেছেন তা তো আমরা নিজেদের চোখেই দেখেছি। কাজেই আমরা কখনোই তাকে ছেড়ে যাবো না।"
রাজনৈতিক উত্থান
এরদোয়ানের রাজনৈতিক জীবনের উত্থান ঘটেছে ১৯৭০'এর দশকে ইস্তাম্বুলের বেয়োগ্লু থেকে। ইস্তাম্বুল নগরীর এ অঞ্চলে কাসিমপাসাতে রয়েছে তার শৈশবের বসতবাড়ি। অঞ্চলটি ইসতিকাল এভিনিউর জমকালো ঢালে অবস্থিত শ্রমজীবী মানুষদের আবাসিক এলাকা। এই এভিনিউর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গোল্ডেন হর্ন বা স্বর্ণ শৃঙ্গের স্রোতধারা।
নাজিমুদ্দিন এরবাকানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টির বিয়োগ্লু যুবক শাখার প্রধান নিযুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ১৯৭৬ সালে প্রথম রাজনৈতিক ভূমিকায় নামেন এরদোয়ান। এরবাকান পরবর্তীতে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন এবং তাকেই এরদোয়ানের অভিভাবক মনে করা হয়।
রাজনৈতিক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুলের মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এরদোয়ান। নগরীর জনজীবন সে সময় বায়ু দূষণ, বর্জ্য অপসারণ এবং বিশুদ্ধ পানির সংকটের মতো নানা সংকটের ধুঁকছিল। মেয়র এরদোয়ান এসব সংকটের মোকাবেলা করেন।
চার বছর বাদেই বিতর্কিত কবিতা আউড়ে তিনি আদালতের কোপানলে পড়েন। তিনি কবিতায় বলেন, 'মিনারগুলো আমাদের বেয়নেট, গম্বুজগুলো আমাদের হেলমেট, মসজিদগুলো আমাদের সেনানিবাস এবং বিশ্বাসীরা আমাদের সৈনিক।' ধর্মীয় বৈষম্য উস্কে দেওয়ার দায়ে চার মাসের কারাবাস ঘটে তার বরাতে।
১৯৯৯ সালের জুলাইয়ে কারাগার থেকে ছাড়া পান তিনি। তবে তখনো রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে তার ওপর ঝুলছে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। দুই বছর বাদে এরদোয়ান গঠন করেন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা একে পার্টি।
গঠনের মাত্র পনর মাসের মাথায় তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে জয়লাভ করে একে পার্টি। তবে নিষেধাজ্ঞা জারি থাকায় তখনই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারেননি এরদোয়ান। পরবর্তী মার্চে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।
এরমধ্য দিয়ে দুই দশক ক্ষমতায় থাকার সূচনা হলো। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এরদোয়ানের রাজনীতিতে নাটকীয় রূপান্তর তারা দেখতে পেয়েছেন।
পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় ২০টি বছর
বেশির ভাগ ভাষ্যকার মনে করেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বাসনায় এ কে পার্টির শাসকের প্রথম এক দশক কেটেছে তুরস্কে সরকারের গণতান্ত্রিক সংস্কার তৎপরতায়। ক্ষমতা ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর বজ্র-মুষ্টি শিথিল করে দেন এরদোয়ান। নারী এবং সংখ্যালঘুদের অধিকারের বিষয়ে গুরুত্ব দেন। সব মিলিয়ে দেশে এবং বিদেশে উদারবাদী হিসেবে প্রশংসিত হলেন তিনি।
কিন্তু গত ১০ বছর তার ভূমিকা পাল্টে যায়। দশ বছর আগে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ এবং ২০১৬ সালে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর এ ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান এরদোয়ান। সমালোচকরা বলেন, এবারে এরদোয়ান অধিকাহারে স্বৈরাচারী নীতিমালারই অনুগমন করছেন।
মার্কিন ভিত্তিক তুর্কি নেতা ফতেহউল্লাহ গুলান তার সমর্থকদের দিয়ে এ অভ্যুত্থানের তৎপরতা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলে তুর্কি সরকার। গুলান অনুসারীদের বিরুদ্ধে তুরস্কব্যাপী ধর-পাকড় এবং ছাঁটাই পর্ব চলতে থাকে। হাজার হাজার তুর্কিবাসীকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। ঠেলে দেওয়া হয় কারান্তরালে।
সমালোচকরা মনে করেন, এরদোয়ান বিরোধীদের লক্ষ্যবস্তু বানানোর বিষয়টি আড়াল করা হয় অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারি অভিযানের মাধ্যমে। 'গুলানবাদী' বলা মানেই হলো যে কোনো বিরোধীপক্ষের ওপর রাজনৈতিক কালিমা আরোপ ।
২০১৫ সালে জাতীয় নির্বাচনে হোঁচট খেয়ে এরদোয়ানের সাফল্যের কাহিনিতে টোল পড়ে। নির্বাচনে এ কে পার্টি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ফলে উগ্র-জাতীয়তাবাদীদের সাথে মিত্রতা গড়তে হয়। আর ত্যাগ করতে হয় কুর্দি শান্তি প্রক্রিয়া।
চার বছর বাদে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ পেলেন এরদোয়ান। ইস্তাম্বুল এবং আঙ্কারাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নগরীগুলোতে স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধীরা নির্বাচিত হন। ইস্তাম্বুলে বরং নাকানি-চুবানি একটু বেশিই হয়। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একে পার্টি বিক্ষোভ করে। এরই জেরে সেখানে ফিরতি ভোটাভুটি হলে আগের বারের চেয়ও বেশি পার্থক্যে বিজয়ী হয় বিরোধী প্রার্থী।
এবারে নির্বাচন দৌড়ে নেমে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ওয়াদা করতে হয়েছে এরদোয়ানকে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিয়ে বিল এনেছেন। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য পেনশন, সরকারি কর্মিবাহিনীর বেতন এবং ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দেন।
রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল, সেতু নির্মাণে একে পার্টির অভূতপূর্ব রেকর্ডের কথা তুলে ধরেন এরদোয়ান। তিনি তুর্কি জনগোষ্ঠীর জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা বলছেন। সামরিক ক্ষেত্রে ড্রোন বা উড়োযান নির্মাণের মতো মর্যাদাসূচক প্রকল্পের সূচনা করার বিষয় আলোকপাত করছেন এবারে তিনি।
আল জাজিরা থেকে অনুবাদে সৈয়দ মূসা রেজ