ইউক্রেনকে যে গুচ্ছ বোমা পাঠানো হচ্ছে তা প্রায়ই বিস্ফোরিত হতে ব্যর্থ হয়
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ক্লাস্টার (গুচ্ছ) বোমা পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে শুক্রবার (৮ জুলাই)। তার আগে পেন্টাগন থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য ক্লাস্টার বোমার চেয়ে বেসামরিকদের জন্য কম বিপজ্জনক হবে এবারেরগুলো।
ক্লাস্টার বোমা অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। খোলা জায়গায় ছোট ছোট গ্রেনেড ফেলে সাঁজোয়া যান ধ্বংস করতে বা সৈন্যদের মারতে ক্লাস্টার বোমা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু দেখা যায় যে, অনেক বোমাই তাৎক্ষণিক বিস্ফোরিত হয় না। কয়েক বছর কিংবা দশক পর সেগুলোর ওপর পা রেখে বেসামরিকদের নিহত কিংবা গুরুতর আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পেন্টাগন জানিয়েছে, যেসব ক্লাস্টার বোমা তারা ইউক্রেনে পাঠাবে সেগুলোর ব্যর্থতার হার মাত্র ২.৩৫ শতাংশ। ক্লাস্টার অস্ত্রের সাধারণ হারের তুলনায় যা অনেক ভালো। তবে পেন্টাগনের নিজস্ব বিবৃতিই ইঙ্গিত দেয় যে, আগের গ্রেনেডগুলোর ১৪ শতাংশ ব্যর্থতার হার নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্রের সফলতার হার নিয়ে ধোঁয়াশার চিত্র।
ইউক্রেনকে দেওয়া ক্লাস্টার মিউনিশনগুলো থাকে ১৫৫ মিলিমিটার আর্টিলারি শেল- এ। মাঝ-আকাশে ৭২টি ছোট গ্রেনেড ছেড়ে দেওয়ার আগে এগুলো প্রায় ২০ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম। সাধারণত ফুটবল মাঠের চেয়ে বড় ডিম্বাকৃতির এলাকাজুড়ে গ্রেনেডগুলো ছড়িয়ে পড়ে বিস্ফোরিত হয়।
পেন্টাগন কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ইউক্রেনে যে শেলগুলো পাঠাবেন সেগুলো ১৯৯১ সালে অপারেশন ডেজার্ট স্টর্মে ব্যবহার হওয়া ক্লাস্টারগুলোর চেয়ে উন্নত। তবে বাস্তবতা একটু বেশি জটিল। কারণ নতুনগুলো মূলত আরো বেশি দূর যেতে পারে, কিন্তু একই ধরনের গ্রেনেড ধারণ করে। যেগুলো বিস্ফোরিত না হওয়ার হার গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি।
বোমা নিষ্ক্রিয়করণে প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আল ভোসবার্গ বলেন, ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের পর ইউক্রেনে যুদ্ধ শেষ হলে অবিস্ফোরিত গ্রেনেডের ঝুঁকি সম্পর্কে বোঝাতে বেসামরিক নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে।
তিনি বলেন, ইউক্রেনীয় সেনাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলো মাটি থেকে হাত দিয়ে সরানো যায় না।
বর্তমানে অলাভজনক মাইন-ক্লিয়ারেন্স সংস্থা গোল্ডেন ওয়েস্ট পরিচালনা করেন ভসবার্গ। তিনি বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে বিপুল অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পড়ে থাকে। সেগুলো সরাতে অনেক কষ্ট করতে হবে। এটি একটি ধীর ও পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া ।
তবে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনকে ক্লাস্টার বোমা দেওয়া ছাড়া তাদের হাতে খুব কম বিকল্প ছিল। কারণ ইউক্রেনের আর্টিলারি শেল এমন সময়ে কমে আসছে, যখন পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে তারা রাশিয়া থেকে অধিকৃত অঞ্চল পুনদর্খলের চেষ্টা করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে বলেন, রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এগুলো (ক্লাস্টার) ব্যবহার করে আসছে। ইউক্রেন রাশিয়ার তৈরি ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছে। এখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ক্লাস্টার চেয়েছে।
তিনি বলেন, ইউক্রেন কোনো বিদেশি মাটিতে ক্লাস্টার ব্যবহার করবে না। এট তাদের দেশ, যা তারা রক্ষা করছে। তাদের নাগরিকদের রক্ষা করছে। নাগরিকদের ঝুঁকি কমাতে যেকোনো অস্ত্র ব্যবহারে তারা ইচ্ছুক।
১০০টির বেশি দেশে এই ধরনের অস্ত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এই অস্ত্রের কারণে নিহত কিংবা আহত হওয়া অর্ধেকের বেশি মানুষই বেসামরিক নাগরিক। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন ক্লাস্টার মজুত কিংবা ব্যবহার নিষিদ্ধ করার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
পেন্টাগনের মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল প্যাট্রিক এস রাইডার বলেন, প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে ব্যাপক পরীক্ষার পর দেখা গেছে, ইউক্রেনে সরবরাহ করতে চলা ক্লাস্টারগুলোর গ্রেনেড বিস্ফোরণে ব্যর্থতার হার ২.৩৫ শতাংশ। এর অর্থ হলো, প্রতি দুটি ক্লাস্টারের মধ্যে তিনটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকবে। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে গ্রেনেডগুলোর ব্যর্থতার হার আরো সাতগুণ বেশি বলে জানিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা।
শুক্রবার সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে প্রতিরক্ষা বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি কলিন এইচ কাহল বলেন, ইউক্রেনে পাঠানো অস্ত্রগুলো ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে পাঁচবার পরীক্ষা করা হয়েছে।
পরীক্ষার সময়কাল হিসেব করে অনুমান করা যায়, ক্লাস্টার যুদ্ধাস্ত্রগুলোর নাম এম৮৬৪ প্রজেক্টাইল। ১৯৯৬ সালে সেগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পেন্টাগনের এক বিশ্বাসযোগ্য সূত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে নিশ্চিত করেছেন, ২০২০ সালে অ্যারিজোনায় শেষবার পরীক্ষা করা ক্লাস্টারগুলো এম৮৬৪।
পেন্টাগন ক্লাস্টারের ব্যর্থতার হার নিয়ে যে দাবি করছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে, যুদ্ধের পর রণাঙ্গনে কাজ করা বোমা নিষ্ক্রিয়করণে যুক্ত কর্মকর্তারা এম৮৬৪-সহ অন্যান্য ক্লাস্টার বোমার অবিস্ফোরিত থাকার হার নিয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন। তারা বলছেন যে দেশেই তৈরি হোক না কেন ব্যর্থতার হার মার্কিন দাবির চেয়ে অনেক বেশি।
অ্যারিজোনার যে জায়গায় মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ ক্লাস্টারের পরীক্ষা করেছে, তা সমতল ভূমি। সেখানের মাটি শক্ত এবং কোনো গাছপালা নেই, যা বিস্ফোরকের সফলতার জন্য আদর্শ জায়গা। কিন্তু যুদ্ধে বোমাগুলো বিভিন্ন অবস্থায় ব্যবহার করা হয়। তাই সাধারণতই ব্যর্থতার হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আর পানি, বালি, কাদা কিংবা নরম মাটিতে পড়লে অবিস্ফোরিত থাকে বেশিরভাগ গ্রেনেড। কারণ এম৮৬৪-এর গ্রেনেডগুলো সাঁজোয়া যান কিংবা বাঙ্কারের মতো ভারী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
বোমা নিষ্ক্রিয়করণে বিশেষজ্ঞ ভসবার্গ বলেন, গ্রেনেডের সফলতা নির্ভর করে কোথায় পড়ছে তার উপর। নরম কিছুতে পড়লে প্রত্যাশিত সাফল্য না-ও আসতে পারে। হালকা ওজনের গ্রেনেডগুলো প্রায়ই গাছে আটকে যায়। আর বিস্ফোরণে ব্যর্থ হয়।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের এক জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা স্বীকার করেন যে, ইউক্রেনে পরিবেশগত কারণে ক্লাস্টারগুলোর কর্মক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে।